জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(৪২)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(৪২)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম

দৈনন্দিন জীবনচর্চার ক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার-আচরণ ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনকে একসূত্রে বেঁধেছে বলেই বহু জাতি ও ধর্মের দেশ এই ভারতবর্ষে কোথাও সংহতির অভাব নেই। জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই জাতককে কয়েকটি ঋণ স্বীকার করতে হয়-দেবঋণ, পিতৃঋণ, ঋষিঋণ ও মনুষ্যঋণ। চতুর্বর্ণে সংযুক্ত মানবজীবন জাগতিক ক্ষেত্রে আপন আপন বৈশিষ্ট্যগুলির উৎসারণের মধ্য দিয়ে জীবন-ধর্ম পালনকে ঈশ্বরের কাজ মনে করে সংসার ক্ষেত্রে আপন পরিচয়টিকে দৃঢ় করে। স্বধর্মপালন থেকে সে বিযুক্ত নয়, বরং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে তা তাকে অপরের সঙ্গে শ্রদ্ধা সম্মান প্রসন্নতায় পূর্ণ রাখে। কোথাও বিরোধের অবকাশ থাকে না। আত্মজ্ঞান লাভ করে বর্ণাশ্রমিক এক একটি স্তরকে অতিক্রম করে উচ্চতম আধ্যাত্বিক স্তরে উন্নীত হবার ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। 

প্রাচীন ভারতবর্ষের মানুষ তার সীমিতকালে সমগ্র জীবনকে অনন্ত মহাজীবনের অংশ হিসেবে উপলব্ধি করে ও স্বধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে পরমের চরণে সমর্পিত হতে তীর্থযাত্রীর মত যাত্রা শুরু করে। ভারতবাসীর এই মানসজীবন একবিংশ শতাব্দে কতখানি বিবর্তনের পথে প্রাগ্রসরমান হয়েছে, তার আত্মজীবন কতখানি বিধ্বস্ত হয়েছে; তার আধ্যাত্বিকতার পথে কোন কোন উপাদান কি কি ভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে- তার কারণগুলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দুএকটি মত উল্লেখ্য- যেমন এই অবক্ষয়ের পিছনে বিপুলভাবে কাজ করছে বস্তুবাদী পাশ্চাত্য জীবনধারার নির্বিকার অনুকরণ ও অনুসরণ। ভোগসর্বস্ব দৈনন্দিন জীবনের টানে প্রাচ্যজীবনে নেমে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে ফলে ভারতীয় জীবনে তার কী প্রতিফলন ঘটেছে; পাশ্চাত্যই বা কতখানি প্রাচ্যকে আত্মস্থ করেছে- সে বিচার বিশ্লেষণ বহু দিক দিয়েই করা হয়েছে বা হচ্ছে। বিশিষ্ট পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ ড. রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের 'হিন্দু ধর্ম' গ্রন্থটির আলোচনা প্রসঙ্গে যে সত্যানুসন্ধান করেছেন, তার নির্যাস হল: 

১। হিন্দুধর্ম বহু শতাব্দ ধরে বিভিন্ন ধর্মের মূল উপাদানগুলিকে গ্রহণ করে তার কলেবর বৃদ্ধি করেছে;
২। বৈদিকযুগের সংস্কৃতি এই ধর্মকে 'হিন্দুধর্ম' বলে উল্লেখ করেনি, করেছে 'সনাতন ধর্ম' বলে; 
৩। সনাতন ধর্ম হচ্ছে সেই ধর্ম, যে ধর্মের কোন আদি বা অন্ত নেই; যে ধর্ম মানুষের ধর্ম, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়; 
৪। বৈদিক সংস্কৃতিতে বহু দেবতার স্বীকৃতি, কিন্তু সেখানে প্রতিমা বা মূর্তিপূজা নেই; 
৫। মূর্তিপূজা অবৈদিক সংস্কৃতির দান 
৬। অবৈদিক সংস্কৃতি- বৌদ্ধ জৈন ধর্ম সংস্কৃতি; 
৭। বৈদিক সংস্কৃতি ভক্তিমার্গকে স্বীকার করেনি;
৮। উপনিষদে মুখ্যভাবে জ্ঞানের কথা, 'তত্ত্বমসি',অয়মাত্মা ব্রহ্মা' 'আবিরাবির্মাএধি'- অর্থাৎ হে স্বপ্রকাশ! তুমি আমার মধ্যে স্বপ্রকাশ হও;
৯। হিন্দু ধর্মে জ্ঞান ও ভক্তি মিশেছে, ভক্তিমার্গ অবৈদিক সংস্কৃতির অঙ্গ। জ্ঞান ও ভক্তির মিশ্রণে গীতা; 
১০। হিন্দুধর্মের বিশাল সৌধ রচনায় ইসলাম বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রভাব অপরিসীম; 
১১। মালাবার উপকূলে প্রথম ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আগমন ঘটে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দে। শঙ্করাচার্যের কাল খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দ। শঙ্করের 'ব্রহ্মৈব সত্যম'- 'ব্রহ্ম একমাত্র সত্য'- এই দর্শন, ইসলামের একেশ্বরবাদকে আত্মসাৎ করার ফল; 
১২। ভক্তিদর্শন ভারতবর্ষে সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রধান স্তম্ভ। মধ্যযুগীয় কবিদের উদ্ভবের ফলে এই সংস্কৃতি সমন্বয় আশাতীতভাবে ভারত জীবনকে এক করে রেখেছে। এখানে সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের কোন ভূমিকা নেই। কবীর জাতিতে তাঁতি, দাদু ধুনুরি, রুইদাস মুচি ছিলেন। লালনের বাউলগান সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে মনের মানুষের সন্ধান করেছে। হিন্দুধর্মের বিশ্বরূপ ও সামগ্রিক রূপ জানতে হলে বাউল সংগীতের সুর ও বাউল সংগীত জানা দরকার। 
১৩। শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন সমন্বয়ের দর্শন, ভক্তিমার্গের সহজ সরল অনুসরণ, উপনিষদের প্রাঞ্জল লোকায়ন;
১৪। বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রার্থনা: 
'অসতো মা সদ্গময় 
তমসো মা জ্যোতির্গময় 
মৃত্যোর্মামৃতংগোময়।'
অসৎ থেকে সৎ-এ, অন্ধকার থেকে আলোয়, মৃত্যু থেকে অমৃতে জীবনের উত্তরণ এই মন্ত্রে। এই একই ধ্বনি রবীন্দ্রনাথের গানে: 
'আপনি বরিয়া লয়েছিলে মোরে না জানি না জানি কিসের আশে। 
লেগেছে কি ভালো, হে জীবননাথ 
আমার রজনী আমার প্রভাত- 
আমার নর্ম, আমার কর্ম, তোমার বিজন বাসে? 
বর্ষা শরতে বসন্তে শীতে 
ধ্বনিয়াছে হিয়া যত সংগীতে 
শুনেছো কি তাহা একলা বসিয়া আপন সিংহাসনে? 
মানসকুসুম তুলি অঞ্চলে 
গেঁথেছ কি মালা, পড়েছ কি গলে- 
আপনার মনে করেছ ভ্রমণ মম যৌবন বনে? (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments