জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-৪৩ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-(৪৩)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম 


রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের "যত মত তত পথ"- এই দর্শনের উপস্থাপনে, স্বামী বিবেকানন্দের " জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর" এই বাণীর মধ্যে এবং সর্বোপরি শ্রী অরবিন্দের অতিমানবের (Superman) রূপান্তরিত হওয়ার দর্শনের মধ্যে ঈশ্বর ও মানুষের নিবিড় আধ্যাত্মিক সম্পর্কটিকে উপলব্ধি করতে হবে;
শ্রী অরবিন্দ একেশ্বরবাদ বা বহু-ঈশ্বরবাদ কোনো তত্ত্বকেই মানেননি। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন সত্যকে এবং মানুষকে। আর মহাভারতের যে উদ্যোগ 'নেন মনুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং কিঞ্চিৎ' যার প্রতিফলন ঘটেছে চণ্ডীদাসের- 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই' এবং এই উক্তির উপর ভিত্তি করেই শ্রী অরবিন্দ উন্নত মানবতার দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন:
"A mighter race shall inhabit the moral's world,
On nature luminous tops, on the spirits ground, 
The Superman shall reign as king of life, 
Make earth almost the mate and peer of heaven, 
And lead towards God and Truth man's ignorant earth, 
And life towards Godhead his immorality.'
শ্রী অরবিন্দের মতে দর্শন ও ধর্মের মধ্যে যে সম্পর্ক তা না বুঝলে ধর্মের বিশুদ্ধ রূপটিকে ধরা যায় না। দর্শন হচ্ছে সত্যানুসন্ধান, আর ধর্ম হচ্ছে সেই পরিদৃষ্টমান সত্যকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করার পথ। যে দর্শন এমন সত্যকে খুঁজে দিতে পারে না; যে সত্যকে জীবন বাস্তবায়িত করা যায় না, সে দর্শন 'মৃত দর্শন',তার কোনো যথার্থতা নেই। পক্ষান্তরে দর্শন দৃষ্ট যথার্থ সত্যকে যে ধর্ম বাস্তবায়িত করে না, অন্য কোনো তত্ত্ব প্রয়োগ করে, সে ধর্ম যথার্থ ধর্ম নয়। সে হচ্ছে ধর্মতন্ত্র, যাকে আমরা Fanaticism বা Obscurantism নামে অভিহিত করতে পারি। 
রবীন্দ্রনাথ এই ধর্মতন্ত্রকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন:
'হে ধর্মরাজ, ধর্ম বিকার নাশি
ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি। 
যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে
ভাঙো ভাঙো, আজই ভাঙো তারে নিঃশেষে-
ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।'
'A mighter race shall inhabit the mortal's world... ' বলে শ্রী অরবিন্দ মানুষের অদম্য আত্মশক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের ৮০ বৎসর পূর্ণ হওয়ার দিনে 'সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধে য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ যে সভ্যতার দান শেষ পর্যন্ত 'মানব পীড়নের মহামারী' রূপে বিশ্ববিনাশী আকার ধারণ করতে দেখেও ".. মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব"...এই বিশ্বাসে দৃঢ় থেকে " পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে"-ই মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে, এমন প্রত্যয় নিয়ে, সেই মহামানবকে তাঁর মানসনেত্রে প্রত্যক্ষ করে ১৯৪১ খ্রিঃ মানুষের জয়গান গেয়েছিলেন:
ওই মহামানব আসে। 
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে। 
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ, 
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-
এল মহাজন্মের লগ্ন। 
আজি অমারাত্রির দূর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন। 
উদয় শিখরে জাগে 'মাভৈঃ মাভৈঃ'
নবজীবনের আশ্বাসে। 
'জয় জয় জয় রে মানব- অভ্যুদয়'
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে। 
কবির এই বিশ্বাস ও নির্দ্বিধ প্রত্যয়ের পিছনে যে সুস্পষ্ট কারণ বিদ্যমান, তা হল এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই মানুষের ধর্মের উত্থান ঘটেছিল। বিশ্বের সমস্ত ধর্মের উৎপত্তিস্থল এই পূর্বদিগন্তের মানুষ ও মানব সভ্যতার দান। এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই উদগত প্রাচ্যবাণী মানুষকে সত্য ও শান্তির পথ কি এবং তা পালন করে অনুশীলনের দিকগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে বিশ্ববাসীকে ভাবতে শিখিয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ অপ্রতিহতগতিতে জীবনের খোঁজে যে জয়যাত্রা রচনা করেছে, তার মহিমান্বিত রূপ পূর্ব দিগন্ত থেকেই উদ্ভাসিত হয়েছে; বিজয়ী বিজিত শেষ পর্যন্ত একসূত্রে সহস্র জীবনের বন্ধন রচনা করেছে এই পূর্বদিগন্তে এসে। যে একদিন সংগ্রামী হয়ে জয় করতে এসেছে, সে শেষ পর্যন্ত পরাজিতের কাছে পরাজয় স্বীকার করেছে এবং প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেছে। পূর্ব দিগন্তের কি সেই অন্তঃশক্তি, যার টানে পাশ্চাত্যের মানুষ আজও প্রাচ্যের দিকে তাকিয়ে আছে? আজকের মানবজীবন পুলকিত ও আন্দোলিত এবং প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, তবু কোথায় এবং কেন সেই মানুষের অন্তর্দহন- তার হদিশ পেতে হলে, সারা বিশ্বের মানুষ কেন প্রাচ্যের দিকে তাকিয়ে, সুখ ও ঐশ্বর্যের ওপরে অতিরিক্ত যে মহাজীবনের আনন্দ তা লাভ করার জন্যে উন্মুখ হয়ে পড়েছে- তার অনুসন্ধানে নিয়োজিত হতে হলে ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই "Indian Man" কে খুঁজতে হবে যার বহুস্তরীয় আত্ম অভিব্যক্তির ইতিহাসে ধরা রয়েছে মানব সভ্যতার সার্বিক ইতিবৃত্ত এবং যে ইতিহাসে অর্ঘ্য ও অঞ্জলিতে বিধৃত রয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের নানা অবদান। আমরা আবারও ফিরে তাকাব এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার হয়ে সারা পৃথিবীতে মানব সভ্যতার যে উৎসারণ ঘটেছে তার দিকে এবং মননের আলোকে প্রত্যক্ষ করব, একবিংশ শতাব্দে সেই সভ্যতার রূপ ও বৈভব অহংকার আস্ফালন জয়-পরাজয়ের বিবর্তন ক্ষেত্রগুলি এবং ধর্মের মানুষ ও মানুষের ধর্মের অবস্থান ও অভিমুখ কোন লক্ষ্যে উপনীত হতে চাইছে এবং কোন অভিপ্রায় বুকে নিয়ে মানুষ তার জয়যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চাইছে? আর এই নিরূপণের কাজ করতে গিয়ে 'জাতীয় মানুষ' তথা "Indian Man" কে জানতেই হবে। এই "Indian Man" কবির অন্তর্লোকের আলোকে উদ্ভাসিত 'মহামানব' এক বিশেষ মহামানবিক সত্তা, যা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বমানবতা বোধের অধীশ্বর, যার জন্ম অতি সাধারণ মানুষের অন্তরে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments