জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-১০/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ১০

পিসিদের বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে আসি। ওখানে দুপুরে খেয়ে, বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে একদিকে যেমন আনন্দও হচ্ছে, অন্যদিকে  মেজকাকারা চলে গেছেন দেখে মনখারাপও লাগছে। চারিদিক কেমন যেন শূন্যতা গ্রাস করেছে। মামাবাড়িতেও একটা পরিবর্তন হয়েছে, ওই অল্প সময়ে সেটা বুঝতে পারিনি। পরিবর্তনটা হল মামারা হাঁড়ি আলাদা করে নিয়েছে। বড়মাসি ছোটমামার ভাগে, মেজমাসি বড়মামার ভাগে। এখন এক বাড়িতেই আছেন। ছোটমামা বাড়ি  বানাতে শুরু করেছে, সম্পূর্ণ হয়ে গেলেই বড়মাসিকে সঙ্গে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে দেবেন।
      এদিকে আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। স্কুল যেতে হবে। তার আগে বই কিনতে হবে। পুরনো বইয়ের কথা একজনকে বলে রেখে ছিলাম। বুকলিস্ট মিলিয়ে দাম হিসেব করে মেজদা নিয়ে রেখেছে। পুরনো বই হলে কমদামে পাওয়া যায়। তবে কিছু বই কিনতেই হয়। পরদিন থেকে স্কুল যাওয়া শুরু করলাম। স্কুলে তখন  পোর্টস চলছে। আমি এসবে অংশগ্রহণ করতাম না। আমি অংশগ্রহণ করতাম আবৃত্তি, তাৎক্ষণিক বক্তব্য, সমবেত সঙ্গীত ইত্যাদিতে। নাটকে ওই একবারই  অংশগ্রহণ করেছিলাম। প্রথমদিকে স্কুলে আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম, পরে আমিই হয়ে গেলাম মধ্যমণি। পড়াশোনার জন্য নয়, আমি ওদের থেকে অনেক এডভান্স ছিলাম। সাজপোশাকে, কথাবার্তায় জেনারেল নলেজে আমি অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলাম(নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে কী হাল হয়েছিল,সে তো আগেই জানিয়ে ছিলাম)। এর কারণ আমার বিশ্বের সমস্ত কিছু জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। নিয়মিত খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন পড়তাম, সুযোগ পেলেই রেডিওর খবর শুনতাম। সিনেমা দেখতাম। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ক্লাসের সব মেয়েরা আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়ত। বড়দিদিরা তুমি করে কথা  বলত। শিক্ষকরাও বিশেষ নজরে দেখতেন।
    আমাদের টিফিন নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ ছিলনা। রুটি পরটা  ফ্যানাভাত,
পান্তা  নতুন চালের খুদেরজাউ, মুড়ি, যা মা খেতে দিতেন, তাই খেয়ে মায়ের দেওয়ে কিছু খুচরো পয়স নিয়ে স্কুল যেতাম। আইসক্রিম, চানাচুর ইত্যাদি কিনে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেতাম, ওরাও খাওয়াত। টিফিনের সময়টাতে আমারা কয়েক জন বন্ধু গল্প করতে করতে কখনো নদীঘাট, কখনো জঙ্গলের রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে ফিরে আসতাম। এই সময় আমরা নানন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। পড়াশোনা, সিনামা, পুজোর গান, প্রেম, বিয়ে সব বিষয়েই, বিশেষ করে আমার অগ্রহ ছিল বেশি। বাবা একসময় পড়ে থাকা হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে একটা রেডিও কিনেছিলেন। তখন  গ্রামে ২/১ জনের বাড়িতেই রেডিও থাকত।  পাড়ায় আমাদের আর ছোট ঠাকুরদাদের রেডিও ছিল। আমাদের সময়ে বাবার উপস্থিতিতে আমরা গান বা নাটক শুনতে লজ্জাবোধ করতাম। বাবা বাড়িতে না থাকলে রেডিওর গান শুনতাম। মেজকাকাদের রেডিও ছিলনা, একটা কলেরগান, মানে গ্রামোফোন ছিল। তাতে একদিন সিরাজোদ্দল্লা নাটক শুনে ছিলাম।  কি একটা  প্রয়োজনা মেজকাকা ওটা বিক্রি করে দিয়ে ছিলেন। রবিবার দুপুরে শোভানারাদি  আমাদের রেডিতে অনুরোধের আসরের গান শুনতে আসত। রেডিও কেনার আগে বাবার একটা হেডফোন ছিল। তারজন্য বাড়ির দুপাশে মস্ত লম্বা দুটো বাঁশের আগায় তার লাগানো থাকত। তাকে বলা হত এরিয়াল। তার সঙ্গে জুড়ে থাকা একটা তার মনে হয় হেডফোনের সঙ্গে জুড়ে থাকত। আমি মাঝে মাঝে কানে  লাগিয়ে শুনতাম আর অবাক হতাম! কোথা থেকে মানুষ কথা বলছে? মনে পড়ে, মহালয়ার ভোরে বাবার সঙ্গে আমিও রেডিওতে মহালয়া শুনতাম। আবার রমজান মাসে ভোরে ঢাকা থেকে প্রচারিত ইসলামি গান শুনতাম। মা শোবার ঘরের এককোণে জনতা স্টোভে গান শুনতে শুনতে সেহেরীর খাবার তৈরি করতেন।
    গত শতাব্দীর সাতের দশকে গ্রাম ও শহরের অনেক পার্থক্য ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা এত সহজ ছিলনা বলেই শহর আর গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, পেশা, বিনোদন, সংস্কৃতির মধ্যে একটা ব্যবধান ছিল। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতির উৎসগুলি বহমান ছিল। নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে গ্রামের মানুষ এই ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রতা  বজায় রেখে চলত। গ্রামীণ সংস্কৃতি বেঁচেছিল সমহিমায়। তখন গ্রামের মানুষ  সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিত। ভাদুগান তুসুগান, বাউলগান, পটের গান, সত্যপিরের গান, ছাদ পেটানোর গান, পাল্কির বেহারাদের গান, নৌকা বাওয়ার গান, পুতুলনাচের গান, মদারিদের গান, সাঁওতালিগান, পালাগান, কেষ্টযাত্রা, আরও নানারকম নাচগান ছিল। কবে থেকে যে অপসংস্কৃতি এসবকে গ্রাস করতে শুরু করেছে বুঝতে পারিনি। পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে সময়ের দাবি মেনে ধিরে ধিরে সব কিছুই বদলায়। তা বলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া কি ঠিক? কিন্তু সেটাই হতে থাকল।
      আগেই বলেছি আমাদের গ্রামের উত্তরে বয়ে চলেছে শিলাবতী নদী। নদীর ওপারের গ্রামটির নাম দেউলকুন্দ্রা। নদী তখন একুলে বয়ছিল। ওপারের পাড় ছিল অনেক উঁচু। ওপরে উঠলেই মস্ত চাটান। তারপর চওড়া উঁচু বাঁধ, যাতে বন্যার জল গ্রামে ঢুকতে না পারে। বাঁধের দুপাশে ছিল মস্ত বড় বড় প্রাচীন গাছ। গাছের ডালপাতার ছায়ায় ঢাকা এই রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় গৌতম মুণির আশ্রমের কথা মনে হত। এই রাস্তা দিয়ে কেন যেতাম সেটাই বলা হয়নি। ওই বাঁধের নীচে, নদীর দিকে কলকাতা প্রবাসী খোকাবাবু নামে এক ভদ্রলোক ত্রিপল খাটিয়ে ১৯ পয়সা টিকিটের একটা সিনেমা হল খুলেছিলেন। ডাইনামোতে চলত। পুরনো সব সিনেমা দেখানো হত। যার ফলে মাঝে মাঝে ফিল্ম কেটে যেত। এই নিয়ে গ্রামের দুষ্টু ছেলেরা গান বেঁধেছিল, ‘খোকাবাবুর সিনেমা/ ঢরঢরে তার ডাইনামা।ঘন ঘন  ফিলিম কাটে/ খোকাবাবুর মাথা ফাটে’। খোকাবাবু তবুও হাল ছাড়েননি। বর্ষাকালে বন্ধ রাখতে হত, তারপর আবার চালানো হত। এইভাবে কয়েক বছর চলার পর উনি একটি সুন্দর, ছিমছাম সত্যিকার সিনেমা হল বানালেন। টিকিটের দাম ছিল, সামনে ৫০ পয়সা, তারপর ৬৫ পয়সা, একেবারে পিছনে ১ টাকা ৫ পয়সা। তিনটে শো হত। আমাদের বাড়ি থেকে সিনেমা হলের গান শোনা যেত। পৌষের রাতেও নদীর ঠাণ্ডা জল পার হয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। তবে মায়ের যা কড়া শাসন ছিল, সিনেমা যাওয়ার খুব একটা সুযোগ পেতাম না। দিদিরা এলে বা কখনো ছোট ঠাকুমার বৌমাদের সঙ্গে যেতে দিতেন। নদী পারাপারের  অসুবিধার জন্যই মাঝে মাঝে এই হলও বন্ধ থাকত। আমি শেষবার এখানে সিনেমা দেখেছি শরৎচন্দ্রের ‘আলো’, মেয়েকে কোলে নিয়ে। তারপর কবে যে বন্ধ হয়ে গেছে, জানিনা। এখন ওটা গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে শুনেছি।
    গ্রামে সারা শীতকাল জুড়েই বিভিন্ন ধরনের মেলা বসত, এখনও বসে।তবে ৫০/৬০ বছর পূর্বের গ্রামীণমেলা আর এই ২১ শতকের মেলার মধ্যে আনেক পার্থক্য। তখন গ্রামীণ মেলায় গ্রামের মানুষের তৈরি এবং প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি হত। শহরের দোকান দেখা যেত না। বেশিরভাগ মেলা হয় নতুন ধান ওঠার সময় পৌষ সংক্রান্তিকে উপলক্ষ্য করে। মেলায় পাঁপড়ভাজা, জিলিপির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও সাদা সাদা কদমা বিক্রি হত। দোকানের গ্যালারির মত পাটাতনে  বড় থেকে ছোট কদমা সাজানো থাকত। বড় মেলাগুলোতে চাষের যন্ত্রপাতি, কোদাল, লাঙ্গলের ফাল, হাঁসুয়া, কাটারির সঙ্গে লোহার চাটু, খুন্তি তেলের পলা, ঝুড়ি, কুলো ধুচুনি বিক্রি হত। আর হত চুড়ি, ফিতে, আলতা, কুমকুম পুঁতিরমালা, আয়না-চিরুনি, চুলের ক্লিপ, ফিতে, মাটির ও প্লাস্টিকের পুতুল, খেলনা ইত্যাদি। শীতকাল ছাড়াও  দোলমেলা, গাজন বা চড়কমেলা, রথেরমেলা, দুর্গাপুজোর মেলা হত।
    আমাদের গ্রামে হত রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর মেলা। আমাদের কাছে এই দুর্গাপুজো ছিল এক অনাবিল আনন্দের উৎস ছিল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি বাদ দিলে সেইসময় দুর্গাপুজো ছিল আপামর বাঙ্গালির কাছে সামাজিক উৎসব। হিন্দু মুসলিম, ধনী-দরিদ্র সবার কাছেই উৎসব হিসেবে সমান আনন্দের ছিল। আশপাশের অনেকগুলি গ্রামের মধ্যে একমাত্র আমাদের গ্রামেই দুর্গাপুজো হত। গড়বেতায় সর্বমঙ্গলার মন্দির থাকায় তখন ওখানেও দুর্গাপুজো হত না। গড়বেতা থানায় খুব জাঁকজমক করে কালীপূজো হত। এখনো নিশ্চয় হয়।
    সেইসময় রাজনৈতিক পরিবেশ অন্যরকম ছিল। উৎসব, মেলা ইত্যাদিতে পার্টির দাদাদের মাতব্বরি করতে দেখা যেত না। গ্রামের মানুষরাই সব করতেন। তখন আমাদের কে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, কে রাজ্যপাল? এগুলো মনে রাখতে হত। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নাম পরে জেনেছি, কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চিনতাম, তাই তাঁর মৃত্যুও আবছা মনে পড়ে। মনে পড়ে ওনার জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে। এরপর মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র সেন। এই প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্য মন্ত্রীর নামের মধ্যে ওই ছোটবেলায় বেশ একটা মজার মিল খুঁজে  পেয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী মানেই নামের সঙ্গে ‘লাল’ থাকবে। যেমন- জহরলাল, গুলজারিলাল, লালবাহাদুর। তেমন মুখ্যমন্ত্রীর নামের সঙ্গে ‘চন্দ্র’ থাকবে। যেমন-প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন।
                                            (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments