নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-পর্ব-(৪৪)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
ভারতবর্ষ ও ধর্ম
বিশেষজ্ঞদের প্রত্যয় হল, এই ভারতীয় মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এবং যার মূলে ছিল নিষাদ (অস্ট্রো-এশিয়াটিক),কিরাত, (মোঙ্গোলীয় বা সিনো-টিবেটান), দ্রাবিড় এবং আর্যদের কালজয়ী প্রভাব। আর্যগণ, যারা সকল জাতির শেষে এসে এই ভারতীয় মানুষের জাগরণ ঘটিয়েছিলেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের অবদান সঞ্চারিত করেছিলেন, তা সম্ভবপর হয়েছিল একমাত্র কালোত্তীর্ণ সংস্কৃত ভাষার দৌলতেই এবং এই ভাষার সমৃদ্ধিতে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের দান সবচেয়ে বেশি। হিন্দুত্বের প্রসারে সর্বস্তরে যোগদানের ভাষা সংস্কৃত। যার ফলিত সম্ভারে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উত্থান সারা ভারতবর্ষ ও বহির্ভারত তথা বহির্বিশ্বে সম্ভব হয়েছিল। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান আচার-আচরণ প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে আর্য উপাদানগুলি বহু সংমিশ্রণে নবায়িত হল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর্যগণ সবদিক দিয়ে সম্ভ্রান্ত মানব সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হলেও তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রাক আর্য আদি অধিবাসীদের প্রভাবগুলি অক্ষুন্ন থাকল। যুগে যুগে বহির্দেশীয় নানা জাতির ভারত অভিযান ও আক্রমণ- উল্লেখযোগ্যভাবে জাতিগুলির মধ্যে রয়েছে পার্সি, গ্রিক, আভির, কুষাণ, হুন, গুর্জর যারা ভারতীয় মানুষের অঙ্গ হয়ে পড়ল।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দ থেকে খ্রিঃ পঞ্চম শতাব্দ পর্যন্ত কালসীমায় কি ভাবে বহির্দেশীয় মানুষ ভারতীয় জীবনের ওপর প্রভাব ফেলেছিল তার একটা সাধারণ পরিচয় পেতে সমসাময়িক বাস্তবকে বিচার করতে হবে। সেই সময়ে সমাজ জীবনে প্রাচীন কোনো বিশেষ আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল না যার প্রয়োগ দ্বারা- এ দেশে যেই অনুপ্রবেশ করুক বা সময়ান্তরে বিজয়ী হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করুক, তাকে একটা বিশেষ ধর্মীয় বা সামাজিক আচরণের মধ্যেই দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে হবে। অপরদিকে অন্য বাস্তব সত্য ছিল যে, যারা অভারতীয় তারা সকলেই আসলে ক্ষত্রিয় হলেও বর্ণসঙ্কর-জনিত কারণে শূদ্র; যেহেতু তারা আর্য-ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে উদাসীন ছিল।
পরবর্তীকালে বহির্দেশীয় জাতিবর্গ চতুর্বর্ণ প্রথায় হিন্দুসমাজের অঙ্গ ও অংশ হয়ে পড়ল এবং বর্ণাশ্রয়ী জীবনে আর্যধর্ম পালনে তার অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। যবন জাতি বলে চিহ্নিত ও পরিচিতগণ বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তিস্রোতে মিশে গিয়ে হিন্দু ধর্মের মহিমা অক্ষুন্ন রাখল। তাছাড়া বহু বহির্দেশীয় ভাষার শব্দসম্ভার ভারতীয় ভাষায় মিশে গিয়ে সমাজবন্ধনের কাজটিকেও এগিয়ে দিল। শুধু ভাষা নয়, আচরণিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জাতির ধর্মীয় অনুশাসনগুলি ভারতীয় ধর্মজীবনকে সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করল। ইরানীয়দের পার্সি ধর্ম- Avesta ভাষা বিশ্বাসগত নানা দিক ও ধর্মীয় আচার আচরণের সঙ্গে বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের প্রভূত মিল রয়েছে। ইরানে Achaemenianদের রাজত্বকালে এই সম্পর্কের বুনিয়াদ দৃঢ় হতে থাকে। Achaemenian সম্রাট Darius (খ্রিঃপূঃ ৫৫২-৪৬৮) র অধীনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থাকার ফলে এই সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।
বেহিসটুন (Behistun) শিলালিপিতে (খ্রিঃ পূঃ ৫২০-৫১৮) জানা যায়, বর্তমান পেশোয়ার রাওয়ালপিন্ডি জেলা দুটির অন্তর্গত ভারতের গান্ধার সহ কমপক্ষে ২০টি প্রদেশ তার অধীনে ছিল। ভারতবর্ষের গান্ধার তার অধীনে থাকার মূলে আকেমেনিয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা Cyrus-র (সাইরাস খ্রিঃপূঃ ৫৫৮-৫৩০) অবদান ছিল। ডেরিয়াসের প্রধান কীর্তি ভারতের সিন্ধু উপত্যকা বিজয়। গ্রিক ঐতিহাসিক Herodotus (খ্রিঃ পূঃ ৪৮৪-৪৩০/৪২০) এর বর্ণনা অনুযায়ী ডারিয়াস ভারতের উত্তর-পশ্চিমের ২০টি প্রদেশে তার অধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। গান্ধার জয় সহ এই আধিপত্য স্থায়ী হয়নি। গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-৩২৬ শতাব্দে ভারত আক্রমণ করার আগেই এই অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু ইরানের বহু নাগরিক স্থায়ীভাবে ভারতে থেকে যায়। এর ফলে তাদের সামাজিক আচরণ, ধর্মীয় বহু বিষয় ভারতবাসীগণ আত্মসাৎ করেন, যেমন তক্ষশীলায় ইরানীয় ধর্মের প্রথা অনুযায়ী মৃতদেহকে না পুড়িয়ে সুউচ্চস্থানে খোলা জায়গায় অনাবৃত রেখে দেওয়া হত। এই শবদেহ শকুন বা অন্য পাখিদের ভোগ্য হিসেবেই পরিত্যক্ত করা হত। ইরানি প্রথা অনুযায়ী কুমারী মেয়েদের বিয়ের বাজারে বিয়ে দেওয়া হতো। এই প্রথা ব্যাবিলনবাসীদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। ভাষার ক্ষেত্রে ইরানীয়দের প্রভাব লক্ষণীয়।
ভবিষ্যপুরাণ অনুযায়ী কৃষ্ণপুত্র শাম্বর কুষ্ঠ রোগ নিবারণকল্পে সূর্যপূজার উদাহরণ রয়েছে। তিনি চন্দ্রভাগা নদীর তীরে মিত্রাবনে এই উদ্দেশ্যে সূর্যমন্দির তৈরি করেছিলেন। সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে নূতন করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করলে, তার অকাল মৃত্যুর কারণে তা সম্ভব হয়নি। তার উত্তরাধিকারী সেলুকাস (Seleucus খ্রিঃ পূঃ ৩৫৮-২৮১) সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সন্ধি করে ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে হেরাত কান্দাহার কাবুল মাকরান প্রভৃতি ভারতের ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির অধিকার লাভ করেন, যা পরবর্তীকালে সম্রাট অশোকের (খ্রিঃ পূঃ ৩০৪-২৩২) (যিনি ভারতের প্রসিদ্ধ মৌর্য সম্রাট ছিলেন) সঙ্গে গ্রিক শাসনকর্তাদের সুসম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করেছিল। ভাষা শিল্প ও ধর্মাচরণ প্রভৃতির মধ্যে দিয়েই গ্রিকগণ ভারতীয় মানুষের অঙ্গ হয়ে ওঠেন। ইউয়েন সাঙ সপ্তম খ্রিস্টাব্দে মুলতানে অবস্থিত অপূর্ব সুন্দর সূর্যমন্দির দর্শন করেছিলেন, তা তার বিবরণ থেকে জানা যায়। রোমানগণ ভারতে বাণিজ্য স্থাপনের অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিলেন। জলপথে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য রোমানগণ ভারতে বহু বাণিজ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেন এবং বাণিজ্যের কারণেই ভারতে রোমানদের প্রচুর মুদ্রা আদান প্রদান করা হত। ভারতে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের কারণগুলির মধ্যেই এই কারণটিও উল্লেখযোগ্য।
মূলত যাযাবর প্রকৃতির মানুষ শকগণ ভারতের গ্রিকদের আধিপত্য খর্ব করতে চেষ্টা করেন এবং ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। তারা জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-আচরণগুলি আত্মসাৎ করেন। তাদের মুদ্রায় ভারতের দেবদেবীদের- যেমন শিব, উমা, গজলক্ষী মূর্তির প্রচলন হয়। ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে শিলালিপিতে বিধৃত রয়েছে শকদের সঙ্গে ভারতবর্ষের নিবিড় সংযোগের স্বাক্ষর। আমাদের এই ভারতবর্ষ বহু ধর্মের মিলন ভূমি। কিন্তু সব ধর্মের উপর মানুষের হৃদয়। তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- "মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নেই"।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments