জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-(৪৫)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম 
পর্ব-৪৫

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দে Yueh-chi শাখার যাযাবর জাতি কুষানগণ, প্রতিবেশী হুনদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে। কুষান শাসক Kunjula Kandphises,ভারতবর্ষে প্রবেশ করলে তাকে ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মীয় আচরণ মেনেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই শাসক, বিশেষজ্ঞদের মতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তার শাসনকালে প্রচলিত মুদ্রায় 'ধর্মস্থির' 'ধর্মস্থিত' 'সত্যধর্মস্থির' শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। এই মুদ্রার অপর দিকে শিব বা শিবচিহ্ন খোদিত দেখা যায়। খ্রিঃ প্রথম শতাব্দে কুষাণ রাজবংশ শ্রেষ্ঠ সম্রাট কনিষ্কের (রাজত্বকাল খ্রিঃ ৭৮ থেকে ১৪৪) আমলে সমগ্র উত্তর ভারতে কুষাণদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে এবং তিনি সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় মানুষ হয়ে ওঠেন। তার রাজত্বকালে শিল্পে সাহিত্যে ভারতের বিপুল সমৃদ্ধি লাভ হয়। নানা ধর্মীয় সংঘাত মোকাবিলা করে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। তিনি বৌদ্ধদের সম্মেলন আহ্বান করেন এবং মহাযান শাখার পত্তন তার রাজত্বকালেই হয়। তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধারক ও বাহক হলেও জরথুস্ত্র, গ্রিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন না। এই সময়ে রোমানদের সঙ্গে প্রভূত বাণিজ্যিক উন্নতি হয় এবং চীন দেশের সঙ্গে তার যোগাযোগের কারণে চীন দেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ ত্বরান্বিত হয়। তিনি পেশোয়ারে তার রাজধানীর সন্নিকটে বিশাল বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীকালে আরব ও চৈনিক পরিব্রাজকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি বৌদ্ধ দার্শনিক, লেখক, সাহিত্যিক যথা অশ্বঘোষ, পার্শ্ব, বসুমিত্র প্রমূখদের সম্মানিত ও উৎসাহিত করেন। সম্রাট কনিষ্ক 'শকাব্দ'র সূচনা করেন (খ্রিঃ ৭৮ শতক) কনিষ্ক রাজবংশের সর্বশেষ রাজা বাসুদেব (খ্রিঃ ১৪২-১৭৬)। তার রাজত্বকালের পর দক্ষিণভারতে স্থানীয় রাজাদের উত্থান ঘটে। 
খ্রিঃ পঞ্চম শতাব্দে কুষাণদের উৎখাত করে এবং গান্ধার অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্মের নিদর্শনগুলি ধুলিস্যাৎ করে হুনগণ ভারতজয়ের আক্রমণ শাণিত করে এবং উত্তর ভারত ও মধ্যভারতের বেশ কিছু অংশে তাদের আধিপত্য কায়েম হয়। হুনদের প্রধান ও বিক্রমশালী রাজা Toramana -র পুত্র মিহিরাকুল (Mihirakula) ভারতবর্ষের বিশাল অংশ তার শাসনে আনতে সক্ষম হন। প্রবল প্রতাপশালী ভারত শাসক যশোবর্মন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে সাম্রাজ্য বিস্তারে ভাটা পড়ে। মিহিরাকুল শৈব ছিলেন। হুন জাতির ঐতিহ্য ও পরিচয় আজও বহন করে চলেছে ভারতের রাজপুতগণ। একাদশ খ্রিঃ চেদিরাজ কর্ণ হুন রাজকুমারী অহল্যাদেবীকে বিয়ে করেন। এইভাবে বহির্দেশীয় সংযোগগুলি ভারতের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনকে বর্ণময় করে তোলে শুধু নয়, মানবসম্পর্কের বুনিয়াদ ও সামাজিক দিকগুলি নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়। বহির্দেশীয়দের ভারতে অনুপ্রবেশ ও বসবাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই হয়ে এসেছে। এর ফলে কাল স্রোতের কলধ্বনিতে উদ্গীত যে মহাজীবন ভারতবর্ষকে বৈচিত্র্যময়তায় পরিস্নাত করেছে এবং বিবিধের মহামিলনে ভারতীয় মানুষের যে আবির্ভাব ঘটেছে তার অবিনাশী প্রভাবেই ভারতসত্তার আবির্ভাব। 
ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বিষয়টির প্রতি যেভাবে দৃষ্টিদান করেছেন তা হল: "The fundamental trait of this (Scil Indian) civilization may be described as a Harmony of Contrast,or as synthesis creating a Unity out of Diversity. Perhaps more than any other system of civilization,it is board and expansive and all-comprehensive,like life itself,and it has created an attitude of acceptance and understanding which will not confine itself to a single type of experience only,to the exclusion of all others."
ভারতীয় মানুষের সংমিশ্রণে ভারতবর্ষে এমন বহু কুসংস্কার দৃঢ়মূল ছিল যার প্রভাব একবিংশ শতাব্দের ভারতবর্ষেও যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। এই কুসংস্কারগুলি মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে বিদ্যমান ছিল ও এই কালসীমার মধ্যে কুসংস্কারগুলি দূরীকরণের চেষ্টাও অব্যাহত ছিল। তবুও এগুলির উচ্ছেদ ঘটানো এখনোও সম্ভব হয়নি যেমন বাল্যবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, বহু বিবাহ, অসমবয়সী বিবাহ, যৌতুক গ্রহণ, পর্দাপ্রথা, শুধুমাত্র নারীদেরই বৈধব্যপালন, সতীদাহ, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, জুয়া খেলা বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বাল্য বিবাহের প্রচলন এক বিরাট সামাজিক ক্ষত। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর (ষোড়শ শতাব্দ) চন্ডীমঙ্গল কাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী কন্যার নয় বছর বয়সে বিবাহ সম্পন্ন হলে তা ভগবানের আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হত। মেয়ের ১০ বছর বয়স অতিক্রান্ত হওয়া পারিবারিক ও সামাজিক কলঙ্কের কারণ হয়ে উঠত। সম্রাট আকবর প্রথম এই ভয়ঙ্কর সামাজিক ও পারিবারিক ব্যাধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফরমান জারি করে ছেলেদের বিয়ের বয়স ১৬ এবং মেয়েদের ১৪ বছরের বেঁধে দিয়েছিলেন। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের সম্মতি ব্যতিরেকে বিবাহ সংঘটিত হবে না, এমন আইন ও বলবৎ করেছিলেন এবং বিষয়টি তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে কোতোয়াল নিয়োগ করেছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলন অসম্ভব ছিল। সম্রাট এই বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হননি। তিনি অসবর্ণ বিবাহ সমর্থন করতেন, কারণ বিবাহসূত্রে বহুবর্ণের সংমিশ্রণে প্রজন্মের দৈহিক ও মানসিক ক্ষেত্রে যে বিকাশ হয় তার সত্যতাকে তিনি মান্যতা দিতেন। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অসবর্ণ বিবাহে কোনোপ্রকার বাধা নিষেধ ছিল না। আজও নেই। কিন্তু খুব নিকট সম্পর্কের মধ্যে মুসলমানদের বিবাহ প্রথাকে তিনি মান্যতা দিতে চাননি। 
উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা, হিন্দু রাজাদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। স্বনামধন্য বহু বিদেশী পর্যটক এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন: "Hindus take but one wife and never divorce her till death except for the cause of adultery.They could marry a second time only if the wife prove to be barren." মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল: Marry whatever woman you like, either three each or four each." আকবর ফতেপুর সিক্রিতে অবস্থিত তার 'ইবাদত খানা'য় (প্রার্থনা গৃহ) উলামাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই ভয়ঙ্কর কুপ্রথার বিলোপ ঘটিয়ে ফরমান জারি করেন- 'স্ত্রী-সন্তান ধারণে অক্ষম না হলে কোনো মুসলমান একটির বেশি দুটি বিবাহ করতে পারবেন না।' কারণ বহু বিবাহ পারিবারিক শান্তির সহায়ক তো নয়ই, বরং পুরুষ ও নারীর স্বাস্থ্যহানিরও কারণ। যুবক মুসলমানদের মধ্য বয়স্কা মহিলাদের বিয়ে করার পর প্রথার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। 
হিন্দুদের মনুস্মৃতি অনুযায়ী বিয়েতে বরের বয়স কনের বয়সের তুলনায় বেশি হতেই হবে- এই যে অনুশাসন ছিল, মুসলমানদের ক্ষেত্রে সামাজিক আইনগত এই বাধ্যবাধকতা ছিল না। বয়স্ক রমণীর সম্পত্তির লোভে তরুণ যুবক অসম বয়সের বিয়েতে সহজেই সম্মত হত। আকবর ফরমান জারি করে এই প্রথা বন্ধ করলেন। শুধু তাই নয়, মেয়ের বয়স যদি ছেলের তুলনায় ১২ বয়সের বছরের বেশি হয়, তবে সেই বিয়ে আইনত অসিদ্ধ বিবেচিত হবে বলে ফরমান জারি করলেন। দুঃখের বিষয়, এই ফরমান পরবর্তীকালে বহাল থাকেনি। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. প্রথম দিকের পর্ব গুলি পড়তে চাই।

    ReplyDelete