জ্বলদর্চি

ভূতমানুষ /শ্রীজিৎ জানা

ভূতমানুষ

শ্রীজিৎ জানা



ঈশিতা কখনো ভূত দেখেনি। ভূতকে তার ভীষণ ভয়।মেজ জেঠু তার ভয়ের কারণ। যত রাজ্যের ভূতের খবর তার কাছে পাওয়া যাবে। বহুবার নাকি তার ভূতদর্শনও ঘটেছে। গাঁয়ের জয়েন্ট ফ্যামিলি মানেই সারাক্ষণ ঘরদোর থাকবে সরগরম।ঈশিতাদের বাড়িটাও তার বাইরে নয়। জেঠু জেঠিমা,কাকা কাকিমা তার উপর একগাদা ভাইবোন,কাজের লোক- যেন ছোটখাটো একটা পাড়া বলেই তার মনে হয়। ভালোও লাগে তার। একবিন্দু মনখারাপ করার ফুরসত থাকেনা। থইথই আনন্দ আর হুল্লোড়। দুপুর আর রাতের আহারপর্ব তে দেখবার মতো! মা জেঠিমা কাকিমারা খেতে দিতে ঘেমেনেয়ে একসা। মুখে তবু তাদের লেগে থাকে তৃপ্তির হাসি। বড় জেঠুর হুকুম,
-- রাতে হেঁসেল দোরে দশটায় পঙ্গত বসবে। যে যেখানেই থাকো এক পঙ্গতে খাওয়া চাই।
জেঠুর কথা অমান্য করে এমন সাহস বাড়িতে তেমন কারো নেই।তারপর  যেই ভোজনপর্ব শেষ অম্নি মেজ জেঠুকে ছেঁকে ধরে সবাই। অখিলচন্দ্র খোলে তার ভৌতিক গল্পের ঝাঁপি। 
ঈশিতার ভূত দেখা ওই অখিলচন্দ্রের চোখ দিয়েই। ভূতেরা অশরীরী! এদিকওদিক নিমেষে যাতায়াত করতে পারে তারা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তাদের চেহারা বিকট,ভয়ঙ্কর! গলা টিপে ধরতে পারে,ঘাড় মটকে রক্ত চুষে নিতে পারে,গলায় দড়ি দিতে,বিষ খেতে,ট্রেনের চাকায় মাথা দিতে বাধ্য করাতে পারে। ছায়া মূর্ত্তি ধারণ করে ভয় দেখাতে পারে। আরো কতরকমের যে তাদের ভয়ানক  স্বভাবচরিত্র তা শুধু অখিলচন্দ্রই জানে।  এখন ঈশিতাও খানিকটা জানে।গেছো,মেছো,মামদো,ঝাঁপড়ি,পেত্নি, জেলেভূত,ব্রহ্মদৈত্য, স্কন্ধকাটা আরো কত রকমের ভূতেদের নামের সাথে তার জান পহেচান হোয়ে গ্যাছে। তবে কোনদিন কোন ভূতকে চাক্ষুষ  করেনি সে। শুধু ছোটবেলার একটা কথা সে আজও কাউকে বলতে পারেনি। অনেকদিন পর্যন্ত তার সেই কথাটাই মনে বদ্ধমূল ছিল,ভূত গলায় দড়ি দিতে সত্যিই বাধ্য করায়। 
বেশ কয়েকবার তার চোখে পড়েছে একটা ছায়ামূর্তি মেজ জেঠুর ঘর থেকে রোজ রাতে তপি মাসীর ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।  তপিমাসি তাদের বাড়িতে কাজ করে। বিধবা,পাশে দুটো গ্রাম পেরিয়ে তাদের বাড়ি। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর তার একটা  ছোট মেয়ে আছে। কিছুদিন ছাড়া ছাড়া সে বাড়ি যায়। সারাদিন মুখ গুঁজে কাজ করে যায়।মেজ জেঠুকে দেখলেই কেন যে আড়ষ্টভাব ফুটে উঠতো ঈশিতা তখন বুঝতে পারতো না।
কিছুদিন পর বাড়িতে চাপা ফিসফিসানি কথাবার্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। অখিলচন্দ্র আর সেভাবে গল্প শোনাতে চায় না। বাড়ির বড়দের  কারো চোখে  আগুন,কারো মুখে  কালো মেঘ যেন লেগে থাকে দিনমান। বাড়িময় অস্থির করা চাপা গুমোট। 
এরই মাঝে হঠাৎ একদিন  বাইরের ঘর থেকে তপিমাসির গলায় ফাঁস লাগানো দেহটাকে পুলিশ এসে নামায়।গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে যেত হয়তো কিন্তু কোকিলচন্দ্রের দাপটে সব থিতিয়ে যায়। থানার বড়বাবু তখন প্রায়শই রাতে আসতেন। আর হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন। 
একদিন তো তপিমাসির মা এলো বড়বাবুর সাথে। তারপর সেও বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ পর। চোখ মুছতে কেউ দেখলো না তাকে। গলার স্বর শোনা গেল না এতটুকু। চোখের আগুন,মুখের কালো মেঘ,গাঁ'ময় ফিসফিসানি কোথায় যেন উবে গেল। কেউ কোনো কথা বল্ল না তপিমাসির মৃত্যু নিয়ে। ছোট্ট ঈশিতা ভেবেই নিল ছায়াভূত তপিমাসিকে গলায় দড়ি দিতে বাধ্য করেছে। কতদিন সন্ধে নামলেই অমন গমগম করা ঘরটা যেন নিস্পন্দ হোয়ে গেল।
তারপরই ঈশিতারা চলে আসে শহরে। যদিও তাদের আসাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। অপর্ণা বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই নিখিলকে বোঝাতে থাকে,
---বাড়ি তো নয়,যদুবংশ! এত চিলচীৎকারের মাঝখানে আমি ফুরিয়ে যাবো। তুমি অন্য কোথাও একটা বাড়ি নাও প্লিজ।
প্রথম দিকে এই কথায় কোন পাত্তা দ্যায়নি নিখিল।যত দিন যায় বন্ধ ঘরের ভিতর উত্তেজনা সহ্যের সীমা ছাড়ায়। ছোট্ট ঈশিতা আধো ঘুমচোখে দ্যাখে দুটো মানুষের ছায়া রাতদুপুর অব্দি চাপা স্বরে কথা ছোঁড়াছুড়ি করছে।  যেভাবে খালবিলের মাছ নিয়ে জেলেভূত আর মেছোভুতরা পরস্পর লড়াই করে।একে অপরকে খামচে, চড়িয়ে ক্লান্ত হোয়ে শুয়ে পড়ছে বিছানায়। রণক্লান্ত দুজন তার দুদিকে ঘুমে অচেতন। ঈশিতা শুধু ঘুমের ভান কোরে শুয়ে থাকে।
  বর্তমান ঠিকানাকে আধা শহর বললেই মানায়। বাজার এলাকা থেকে ভিতরে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠে তারা। মুখোমুখি দুটো রুম,পাশে এক প্রস্থ রান্নার জায়গা। বাড়িটার আশেপাশে আরো দু'চারটে বাড়ি থাকলেও, সেগুলো পিঠোপিঠি দাঁড়িয়ে নেই। অনেকটা ছাড়াছাড়ি। রাস্তাঘাটের সব লাইটগুলো সেভাবে জ্বলে না এখানে। থকথকে পিচকালো অন্ধকার মাঝেমাঝে ডাঁই হোয়ে থাকে। এদিকটায় লোকজনের যাতায়াত খুব বেশি নেই। অপর্ণার পছন্দসই যে হয়নি বাড়িটা তা নিখিলকে স্পষ্টই জানায়,
---সেই তো ভাড়া গুনতেই হবে, বাজার ঘেঁষা বাড়ি নিতে তো পারতে।
--- পারতাম কিন্তু ভাড়াটা দ্বিগুণ হয়ে যেত।
---- রাত করে তুমি বাড়ি ফেরো,ইতুর স্কুল থেকে ফিরতে বিকেল হোয়ে যায়,একা থাকি,ভয় করে।
---একাই তো থাকতে চেয়েছো!
কথার আঁচে অপর্ণার ছ্যাঁকা লাগলেও প্রত্যুত্তর করে না। নিখিল অফিস বেরিয়ে যায়।
ভূত একা মানুষকে ভয় দেখায়। পড়তে বসে ঈশিতা ভাবে মা সারাদিন বাড়িতে একা থাকে নিশ্চই কোন ভূতের কাছে এই খবরটা পৌঁছে গ্যাছে। এবার ঠিক ভূত তাদের বাড়ির আনাচেকানাচে উঁকি মারবে। স্কুলেও টয়লেটে  একা যেতে তার ভয় করে। সবেমাত্র প্রাচী তার খুব ভালো বন্ধু হোয়ে উঠেছে। ঈশিতা তার ভয়ের কথা লজ্জায় প্রাচীকে বলতে পারে না।

তারপর প্রাচী একদিন টিফিন আওয়ারে তার ভূত দেখার গল্প শোনায়। তার শোবার ঘর আলাদা। সেটাই তার পড়ার ঘর। স্যারেরা ওই ঘরেই তাকে পড়ায়, বকুনি দ্যায়,মারে,আদরও করে। ইংলিশ পড়ান সৌভিকবাবু। না পড়া হলেও কিচ্ছু তেমন বলেন না। গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে গ্রামার শেখান।সারা গায়ে ক্যামন একটা শিরশিরানি অনুভব করে। ক্যামন যেন ঘোর লাগে তার শরীরে। দরজা বন্ধই থাকে। মাঝে একবার শুধু তার মা স্যারকে চা- টিফিন দিয়ে যায়। সাথে একমুঠো হাসি স্যারের চোখে যেন ইচ্ছে করেই তার মা ঢেলে দিয়ে যায়। স্যার চেয়ে থাকে নিষ্পলক ভাবে। প্রাচীর চোখ এড়ায় না সেসব।
কোন কোন দিন সৌভিকবাবুর আদর করার ধরণ বদলে যায়।গা ঘেঁষে বসতে বলেন। হাতের শক্ত আঙুলগুলো পিঁপড়ের মতো সারা পিঠ জুড়ে চরে বেড়ায়। ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে থাকে। হঠাৎ থমকে যায়। তারপর রাতে যখন প্রাচী একা বিছানায়,ঘুমের ভিতর সারা শরীরময় চড়ে বেড়ায় অজস্র পিঁপড়ে। চিৎকার করে উঠে প্রাচী। মা- বাবা পাশের ঘর থেকে ছুটে আসেন,
---কী হোলো প্রাচী সোনা
---আমার সারা গায়ে কত পিঁপড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে দ্যাখো!
----কোথায় পিঁপড়ে?
মা তাকে বুকের ভিতর টেনে নেয়। বাবা মাথায় হাত বুলোতে থাকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে প্রাচী।

অপর্ণা চেয়েছিল আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ।অম্নি ঘষলেই তার থেকে জিন্ বেরোবে! হুকুম আকা- বলে সব ইচ্ছে পূরণ করবে তার। কিন্তু নিখিলকে ঘষে- আছড়ে কিস্যু যে মিলবে না তা সে ভালোমত জেনে গ্যাছে। কোনক্রমে ওই হট্টমেলা থেকে তাকে যে ফুসলে আনতে পেরেছে সেটাই তার অর্ধেক জয়। বাকিটা সে নিজে থেকেই করবে। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তার কয়েক কদম যাত্রা শুরু হয়েছে।

সব শরীরেরই খিদে আছে। চোখ খিদেটাকে বাড়ায়।ঘরে একশো পদ থাকলেও বাইরের খাবার অনেকের কাছে চরম উপাদেয়। অপর্ণা খাদ্য সম্ভার মেলে ধরে ফ্যামিলি পার্টিতে। সুজন দত্ত,এগিয়ে এসে কমপ্লিমেন্ট দ্যায়,
--নাইস লুকিং বৌদি!
---থ্যাংকস!
---ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, কাম এন্ড জয়েন্ট উইথ মি
--আমি ওসব নিই না
----সফট্ বানিয়ে দিচ্ছি।
অফিসের সিনিয়র কলিগ। নিখিল ঘাড় নেড়ে সম্মতি দ্যায়। অপর্ণা এগিয়ে যায়।

নিখিলের ফিরতে রাত হয়। আজকাল অপর্ণার ঔজ্জ্বল্য গ্রামের বাড়িতে,আত্মীয়স্বজনদের মনে অনেক কথার জন্ম দ্যায়। সেসব কথাকে পাত্তা দ্যায় না সে। শিগগির একটা ফ্ল্যাট নেবে তারা। সুজন দত্তের হাত ধরে নিখিল পদোন্নতি করেছে। ঈশিতা এখন বড় হয়েছে। সামনেই মাধ্যমিক। মা তার সারাদিন বাড়িতে থাকে না। আর যদিও থাকে তা আবার নিজের ঘরেই। শুধু চাপা স্বরের কথা,হাসির শব্দ দরজা ভেদ করে ওর দিকে ছুটে আসে। বাবা বাড়ি ফেরার আগে মাঝেমধ্যে কেউ একজন সন্ধের সময় তার মাকে গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে যায়। বারান্দা থেকে ঝাপসা আলোয় লোকটাকে ভূতের মতো দেখায়। অথবা সত্যিই ভূত। ভূতকে সবাই ভয় পায়। তার বাবাও ভয় পায়,নইলে কেন মায়ের সব আচরণ মুখ বুজে সয়ে নেয়। কতবার তার মাকে শাসাতে শুনেছে পাশের ঘর থেকে,
---বেশি গলাবাজি করতে এসো না। আজকে যে পজিশনে আছো না সব আমার জন্য। তোমার মুরোদ আমার জানা আছে।

প্রাচীই তার একমাত্র নীলাকাশ অথবা একটা সবুজ মাঠ অথবা একটা  কুসুম রোদ্দুরে ডুবডুব বিকেল। যেখানে ঈশিতা আনন্দে ডানা মেলতে পারে। একবিন্দু মন খারাপ থাকে না। প্রাচী'র সঙ্গে কখনোকখনো তর্ক হয়। ওই একটাই বিষয় তাদের -ভূত। ঈশিতার জোরালো মত ভূত অশরীরী আর শরীরি দুটোই। দেহহীনের চেয়ে দেহীরা বেশি ক্রূর,ভয়ঙ্কর। প্রাণহীনের কসুর মাফ করা যায়, প্রাণযুক্ত ভূতকে কখনো নয়।
---ওদের কে কেন তাহলে তুই ভূত বলিস?
---ওরা ভূত নয়,ভূতমানুষ।
প্রাচী বান্ধবীর কথার সাথে কথা জুড়ে দ্যায়। বাসে, ট্রেনে,ভীড়ে কত ভূতদের গরম নিঃশ্বাস ঘাড় বরাবর নীচের দিকে নেমে যায়। তাদের তপ্ত পুংচিহ্ন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসর। অনেক বার ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে গ্যাছে সে। তবে অনেকের ভূতকে খুব ভালো লাগে। রসালো ভূতের গল্প অনেকেই শুনতে চায়। 
প্রাচী চায় না। চায় না এমন একটা ভূত বাসস্টপ থেকে ইদানীং তাকে ফলো করছে রোজ। স্পষ্ট করে তাকে কখনো দেখেনি। একা একা ফিরতে ভয় করে।
ঈশিতা শুনে গর্জে উঠে। একবার সে ভূতের মুখোমুখি হতে চায়। ভূতেদের উপর রাগ তার ছোট থেকেই। অশরীরি ভূতেরা ভয় দেখায় শুধু,মানুষ মারে কিনা তার কোন হাতে নাতে প্রমাণ মেলেনি,যতসব গল্পকথায় লেখা। অথচ শরীরিরা প্রতিমুহূর্তে মারছে প্রাণে মনে,ঘরে। ভয় দেখাচ্ছে, শাসাচ্ছে। ঘর ভাঙছে। নৃশংস শরীরি ভূতের সাথে লড়াই সারাক্ষণ।  কোনো ওঝা এদের শায়েস্তা করতে পারে না। আইনও এদের অনেকক্ষেত্রে ভয় পায়। তবু প্রাচীকে  দৃঢ় গলায় জনায় আর সে ভয় পাবে না। প্রাচী বাধা দ্যায় বান্ধবীকে। খামোখা ভূতেদের পাল্লায় পড়তে নিষেধ করে।
এরই মাঝে দু'একবার ঈশিতা বাসস্টপে নেমে পড়ে প্রাচী 'র সাথে। জোর করেই প্রাচী'র বাড়ি যায়। দূর থেকে ভূতের ফলো করা লক্ষ্য করে। 
ইদানীং ঈশিতা বেশ সাহসী হোয়ে উঠেছে। মা তাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলে।রাগে ফুঁসে উঠে ঈশিতা,
---দয়া করে সুজন আঙ্কেল কে বাড়িতে আর ডেকো না মা।
নিখিল -অপর্ণার মুখ আগুনে ঝলসানোর মতো হোয়ে যায়।

হঠাৎ বাজার এলাকায় সেদিন আর্তনাদের শব্দে সবাই ছুটে আসে। কে বা কারা যেন স্কুল ফেরত একটি মেয়ের মুখে অ্যাসিড ছুঁড়েছে।

আই সি ইউতে ঈশিতা। বাইরে সবাই ডুকরে কাঁদছে। প্রাচী ভূতগুলোকে চিনতে পারবে কিনা কেউ জানে না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments