গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় পর্ব - ১ দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা তখন সংগীত ও নৃত্যের এক নূতন বিকশিত কেন্দ্র। দেশের প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত শিল্পী কলকাতায় এসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান গুলিতে যোগদান করে নিজ নিজ গায়কি স্বীকৃতি আদায় করতেন। একবার এক সান্ধ্য আসরে দ্বারভাঙা রাজের পৃষ্ঠপোষকতা লব্ধ অসাধারণ সুন্দরী বেনজির বাঈ এলেন সারাদেশের নয়নের মনি এক বাঈজীর সঙ্গে অনুষ্ঠান করার জন্য। নিজের শারীরিক সৌন্দর্য দিয়ে বেনজির সেদিন দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য সর্বাঙ্গ সোনা ও হীরার গহনাতে সাজিয়ে গান গাইতে বসলেন।
কিন্তু সাজসজ্জা ও গহনাতে তিনি যতখানি মনোহারী হয়েছিলেন তার গান ততখানি আকৃষ্ট করতে পারেনি আসরের রইস আদমীদের। ধ্রুপদ ও ধামার গান গাওয়ার পরে তিনি উপস্থিত সেই বিখ্যাত শিল্পীর কাছে গিয়ে তার গান কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন এবং তাঁর আশীর্বাদ চাইলেন। প্রত্যুত্তরে সেই বিখ্যাত শিল্পী তাঁর স্বভাবসুলভ অহংকারে বললেন "বহেন তুম পালঙ্ পর বড়ি আচ্ছি সাজোগি, মগর এ্যায়সে মেহফিল মে বৈঠনেকা হায়সিয়ৎ তুমহারি নেহি হ্যায়"। অর্থাৎ শয্যায় তোমায় খুবই মানাবে কিন্তু এমন আসরে গান গাওয়ার যোগ্যতা তোমার হয়নি। এই কথা শুনে বেনজিরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল কারণ এই রকম তির্যক মন্তব্য তিনি আশা করেন নি। সেই আসরে সেই বিখ্যাত শিল্পী তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনায় শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দিয়েছিলেন। আসর শেষ হওয়ার পরে বেনজির বাঈ তার সমস্ত গহনা নিয়ে সোজা বম্বে চলে গেলেন।
সেখানে কিরানা ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা উস্তাদ আব্দুল করিম খানের পিতা উস্তাদ কালে খানের পায়ের তলায় সমস্ত গহনা অর্পণ করে মিনতি করে বললেন উস্তাদজি যেন তাকে একজন নিখুঁত সংগীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেন। কলকাতার অনুষ্ঠানের সমস্ত ঘটনা বলে উস্তাদজিকে আরো বললেন তিনি যেন সেই বিখ্যাত বাইজীর অপমানের উপযুক্ত জবাব দিতে পারেন। উস্তাদ কালে খান তার গহনা প্রত্যর্পন করে বললেন 'একমাত্র তোমার নিজের ঐকান্তিক ইচ্ছাতে কমপক্ষে দশ বৎসর কঠোর পরিশ্রম করলে তুমি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে'। বেনজির বাঈ দশ বৎসর কালে খানের কথা মত তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অসাধারণ গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেই বিখ্যাত বাঈজীর পূর্বের তির্যক মন্তব্যের জবাব দিতে দ্বারভাঙ্গা রাজার সভাতে উপস্থিত হলেন যেখানে সেই বাঈজীও সভা গায়িকা রুপে উপস্থিত ছিলেন। সেই আসরে বেনজির বাঈ প্রথমে জোড়া তানপুরা নিয়ে শুদ্ধ কল্যাণ রাগে আলাপ ও ধ্রুপদ যেভাবে গাইলেন তেমন সুশ্রাব্য আলাপও ধ্রুপদ কেউ কখনো শোনেননি। চমৎকার সুরের খেলা, শ্রুতির প্রয়োগ ও মীড় সূতোর 'লাগডাঁটে' গুণীজনেরা চমকে উঠলেন। তারপরে তাল ও রাগের পরিবর্তন করে বেহাগে ধামার ধরলেন। বোল, ঠাট, ছন্দের উপরে গলার যে কাজ সুধী দর্শক জনকে শোনালেন তাতে আসরশুদ্ধ লোক তারিফ করে হাতে তালি দিতে লাগলেন। উপস্থিত সভা গায়িকা সেই বিখ্যাত বাঈজীও দুলে দুলে মাথা নাড়তে লাগলেন। ঘনঘন তারিফের মাঝখানে বেনজির বাঈ সেই বিখ্যাত বাঈজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন 'বহেন, আ যাওনা ময়দান মে, হিম্মত হো তো বয়েঠকে মেরে সাত গাও'। সেই বিখ্যাত বাঈজীর সংগীত জীবনে তাকে এমন সরাসরি চ্যালেঞ্জ খুব বেশি বাঈজী করার সাহস দেখাননি। কিন্তু বেনজিরের এমন চ্যালেঞ্জের উত্তর দেবার মতো রসদ সেই বাঈজীর ছিল না, কিন্তু তাঁর বুদ্ধির বাহবা করতে হয়। বাকচাতুর্যে তাঁর সমান তবায়েফ তখন ভূ-ভারতে আর ছিলনা। সেই বিখ্যাত বাঈজী বললেন 'বহেন হিন্দুস্তানে এমন কোন বাঈজী নেই যে তোমার সঙ্গে বসে ধ্রুপদ, ধামার গাইতে পারবে।
তবে আমরা তো সামান্য গায়িকা যারা ঠুমরী, দাদরা, গজল গান গাই। সেসব গান তুমিতো গাও না। দিলে চোট পেলে সেসব গানের সুর অন্তর থেকে বের হয়, সে এসব তালিমের মুখস্থ করা গান নয়' । পরাজয় স্বীকার করে নিয়েও প্রতিপক্ষকে খানিক অপমান করে যাওয়া, সেই বিখ্যাত বাঈজীর আমলে সারাদেশের গুণীজনেরা যত দেখেছেন তার আগে বা পরে আর কখনো দেখেননি। আসলে সেই বিখ্যাত বাঈজী তাঁর শিল্পের অহংকার গুনে অত্যন্ত অহংকারী ছিলেন।
এতক্ষণ যে বিখ্যাত বাঈজীর কথা উল্লেখ করলাম তিনি হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বাঈজী গওহরজান। তাঁর আমলে তিনি তাঁর রূপের জৌলুসে, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায়, কন্ঠে সুরের মায়াজাল বিস্তার করে এবং সর্বোপরি বিভিন্ন ভাষার গানে পারঙ্গম হওয়ার জন্য যেমন শ্রোতা ও দর্শকদের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিতে পেরেছিলেন অনুরূপভাবে ভীষন দেমাকীও ছিলেন।
ক্রমশঃ…….
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments