জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-১২/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা  খান

পর্ব ১২

বড়দা গড়বেতা কলেজ থেকে আই এ পাশ করে পড়া ছেড়ে দেয়, নাকি দিতে বাধ্য হয়, তা জানিনা। মেজদা তখন মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে থেকে কে ডি কলেজে পড়ে। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন দাদার চিঠি এল, মা যেন আমাকে নিয়ে চিঠি পাওয়া মাত্র মামাবাড়ি চলে আসে। আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা না জানিয়ে মা বললেন, চল মামাবাড়ি ঘুরে আসি। আমি আর আমার পরের দুই ভাইবোনসহ মামাবাড়ি গেলাম। ওখানে পৌঁছে আবহাওয়া ভাল মনে হলনা। তার পরেই শুনলাম পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে। পাত্র সরকারি চাকরি করে, বনেদি বড়লোক। মেদিনীপুর শহরে অনেকগুলো বাড়ি আছে। আমি যথারীতি বেঁকে বসলাম। যেদিন পাত্রের বাড়ির মহিলারা দেখতে আসবেন, আমি ইচ্ছে করে চুল ভিজিয়ে ফেললাম। ছোটমামি আমাকে জোর করে একটা সায়া আর ঢলঢলে একটা ব্লাউজ পরিয়ে দিয়েছে। এর বেশি কিছু করতে পারছেন না। আমি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। মামি মাসি সবাই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। যারা আমাকে দেখতে এসেছেন, তাঁরা অনেকক্ষণ ধরে তাড়া দিচ্ছেন, মেয়েকে নিয়ে আসুন। এত দেরি করছেন কেন? শেষে তাঁরাও এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। আমাকে ওই অবস্থায় দেখএও পছন্দ করলেন। আমি কান্নাকাটি করছিলাম বলে কিনা জানিনা, মা একরকম ঝগড়াঝাটি করেই আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

      তখন দুর্গাপুজো আসন্ন। রাজবাড়ীর এই পুজোকে ঘিরে শুধু আমাদের  গ্রামের নয়, আশপাশের গ্রামের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষের মনে আনন্দ উদ্দীপনার সীমা ছিলনা। খুব ছোটবেলায় যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম, তখন স্কুল থেকে ফিরে বইস্লেট রেখেই ছুটতাম মঙ্গলামাড়ায় ঠাকুর গড়া দেখতে। ওই মাটি দিয়ে আটচালায় বসে পুতুল বানাতাম। আমার বন্ধু প্রীতির দিদি দীপ্তিদি খুব সুন্দর পুতুল বানাতেন, আমাদের বানিয়ে দিতেন। জন্মাষ্টমীর দিনে কাঠামোয় মাটি চড়ানো হত। তাই ঠাকুর গড়া অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু আমদের যাওয়া বন্ধ হতনা। ঠাকুর শুকলে খড়িমাটি লাগানো হত, তারপর রঙ হত। রাতে হ্যাজাক জ্বেলে প্রতিমাকে সাজানোর কাজ চলত চতুর্থী পর্যন্ত।

    পুজোর ধর্মীয় আচারগুলি বাদ দিলে এই দুর্গাপুজো ছিল একটি সামাজিক উৎসব। যা ছিল আমাদের কাছে অফুরান আনন্দের উৎস। আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী পূর্বে গ্রামের চিত্রটা ছিল অন্যরকম। এত ব্যপক হারে বিজ্ঞাপন দেখা যেত না। আমরা প্রকৃতির বিজ্ঞাপন দেখতাম, উপভোগ করতাম। শিলাবতীর দুই পাড় ঢাকা কাশফুল যেন সাদা কেতন উড়িয়ে বলত, পুজো আসছে, পুজো আসছে। বাতাসে ভেসে বেড়াত শিউলি ফুলের গন্ধ। সপ্তমী থেকে দশমী এই চারদিন আটচালায় যে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হত তার মধ্যে একদিনের পালা গ্রামের মানুষ অভিনয় করতেন। রাজাদের কাছারিঘরে রোজ সন্ধ্যায় যাত্রার মহড়া চলত। ডোমপাড়ায় ঢাকিরা ঢাকে বোল তুলত। মাঝিপাড়া থেকে ভেসে আসত কাঠি নাচের আওয়াজ আর গানের সুর। এই সময় কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারতাম না।

    শুধু ছোটদের নয়, বড়দেরও এই পুজো ঘিরে নানান প্রস্তুতি চলত। সবার বাড়িতেই আত্মীয়স্বজন আসত। মেয়ে-জামেইকে ডাকতে হত। দিদিরাও ছেলেমেয়ে নিয়ে আসত। কাকারা কখনও পরিবার নিয়ে, কখনো বা একারা আসতেন। এমনিতেই রাজবাড়ি থেকে প্রতিটি পরিবারকে কার্ড দিয়ে বিজয়ার নিমন্ত্রণ জানানো হত। কাকা-কাকিমারা এলে রাজবাড়ী থেকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হত। মা ও যেতেন কাকিমাদের সঙ্গে। তখন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল ছিলনা। কৃষির এতটা উন্নতি হয়নি। দিনমজুরদের মাইনে ছিল খুবই কম। ভাদ্রমাসটা তাদের কাছে বিভীষিকাময় ছিল। অনেকেরই তালেরমাড়ি দিয়ে ক্ষুদের জাউ আর পাটপাতা ও সনফুল সেদ্ধ খেয়ে কোনও রকমে দি কাটত। জহুরচাচা বিপিনকাকা সবার অবস্থায় এরকম ছিল। আমাদের প্রাচীর ঘেরা মস্ত উঠোনের মাঝখানে একটা গোলাপজামের গাছ আর একটা পেয়ারাগাছ ছিল। জামগাছটা পেয়ারা গাছের থেকে অনেক বড়। অথচ বাবা বলতেন পেয়ারা গাছটার নাকি বয়স বেশি। এই বাড়িটা যখন কিনেছিলেন, তখন ঝুড়িচাপা দেওয়া পেয়ারা চারাটির ৩/৪ টি লাল পাতা গজিয়েছিল। পেয়ারার ভেতরটাও লাল ছিল। ডাঁসা পেয়ারা রাতে বাদুড়ে খেয়ে নিত বলে গাছে চড়ে যতগুলো পেয়ারা নাগালে পেতাম ন্যাকড়া জড়িয়ে রাখতাম। জামও প্রচুর হত। পাড়ার লোক তো খেতই, আত্মীয় স্বজনদেরও বাড়ি পাঠানো হত।
    একদিন কথায় কথা ইনুসকাকার বৌ নবকাকি বলছিল, জানো মা এমনও দিন গেছে তোমাদের গাছের জাম কুড়িয়ে এনে খেয়ে রাত কাটিয়েছি। আর আনুরাপিসি তো ছেলেদের দিয়ে জঙ্গল থেকে বেল পেড়ে আনিয়ে সেদ্ধ করে খেত। কখনো চিড়ে কুটুনিদের থেকে চিঁড়ের কোনভাঙ্গা(ধানের ভিতর চালের একটা ছোট্ট অংশ থাকে। চিড়ে কোটার সময় সেটা আলাদা হয়ে যায়)কম পয়সায় কিনে এনে জল আর নুন দিয়ে মেখে ছেলেমেয়েদের খেতে দিত। জল ঢাললে এগুলো ফুলে  উঠত। বাটিভরে সবাইকে খেতে দেওয়া যেত। তখন দারিদ্রতা ছিল এই পর্যায়ের। এই অবস্থার মধ্যেই পুজো ক’দিনের খাবার দাবারের, ছোট ছেলেমেয়েদের জামা-  কাপড় কেনার জন্য ধার-হাওলাত করে হলেও টাকাপয়সার জোগাড় করতে হত। জহুরকাকা বা আনারদার মত পরিবারের ছেলেমেয়েদের বছরে একবারই নতুন জামা হত, সেটা ইদে নয়, দুর্গাপুজোয়। পঞ্চমীর দিন বিকেল থেকেই খড়কুশমা বাজার থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দোকানের মালপত্র মেলায় যেতে শুরু করত। আমাদের বাড়ির একেবারে পাশ দিয়ে রাস্তা,তাই বৈঠকখানার বারান্দায় দাঁড়ালেই  লোকজনের যাতায়াত ইত্যাদি দেখা যায়। ষষ্টির দিন সকাল থেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা পরে মেলা যেতে শুরু করত। আমরা যেতাম বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে। আমাদের নতুন জামা হতনা তা নিয়ে আমাদের মনে কোনও দুঃখও ছিলনা। রাগ করে বসে থাকলে কিছুই পাব না, ‘আমও যাবে, ছালাও যাবে’। দাদা পুরনো জামা ইস্তিরি করে দিত তাই পরেই মেলায় বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম। যাত্রা দেখতে যেতাম। সকাল থেকেই মেলায় বেচাকিনি শুরু  হত। আলুরচপ মেখে পান্তা খেতে দারুণ লাগত। তাই পান্তা বা মুড়ি খাওয়ার জন্য মেলা খেকে গরম গরম আলুরচপ, পেঁয়াজি আর যারা রুটি বা পরটা খাবেন তাঁদের জন্য মিহিদানা, বোঁদে কিনে আনা হত। বিকেলে আসত গরম মুচমুচে জিলিপি, লবঙ্গলতিকা, শিঙ্গাড়া।
  ছোটবেলায় এই কয়েকটাদিন মায়ের শাসন আর বকুনি থেকে রেহাই পেতাম। বেলবরণ থেকে কলাবৌ স্নান, পুরো সময়টাই বামুনঠাকুর আর ঢাকিদের পিছন পিছন ঘুরতাম আমরা। আসল মজা হত রাতে, যখন আটচালায় যাত্রা শুরু  হত। তখন গ্রামগঞ্জের যাত্রা পালায় ছেলেরাই দাড়ি-গোঁফ ছেঁটে মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করত। ঘাটালের কাছে তাতালপুরের দলে বেশ কয়েকজন মেয়ে থাকত। এদের পালাও খুব ভাল হত। এটি শেষ দিনে, মানে বিজয়ারদিন অভিনীত হত।  বিজয়ার দিন প্রতিমার বিসর্জন হতনা, পা ধরে নাড়িয়ে রেখে দিয়ে শুধু ঘট বিসর্জন দেওয়া হত। একাদশীর দিন ভোরে সপরিবারে দুর্গাকে বিসর্জন দেওয়া হত।
  আটচালার মাঝখানটা হল মঞ্চ, মঞ্চের বাঁদিকে দু’খানা কাঠের চেয়ার পাতা থাকত। চারধারে বসতেন মিউজিসিয়ানরা তাঁদের পিছনেই আমরা দলবেঁধে বসতাম। মঞ্চের সামনে কয়েকজন গন্যমান্য ব্যক্তিরা বসতেন। মাঝে মধ্যে বাবা গেলে বসতেন। কাকারা এলেও বসতেন। খড়কুশমা গ্রামে ইব্রাহিম মণ্ডল নামে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও আসরে বসে যাত্রা শুনতেন। দশাসই চেহারা, ফর্সা টকটকে  গায়ের রং। সাদা  পাঞ্জাবি ও ধূতি পরতেন। দেখতে ঠিক জমিদারের মত লাগত। হলে কি হবে? পালায় কোনও করুণ দৃশ্যের অবতারণা হলেই ওনার চোখ দিয়ে জল পড়ত, আর বারবার রুমালে চোখ মুছতেন। এতবড় চেহারার একজন বড় মানুষকে কাঁদতে দেখে আশ্চর্য লাগত।
      এবার পুজোয় বাড়ি থেকে ফতোয়া জারি হল, আমি বড় হয়ে গেছি। আমার আর যাত্রা দেখতে যাওয়া চলবে না। কিছুতেই ভেবে পেলাম না আমি হঠাৎ করে এই পুজোর সময়ই কী করে ‘বড়’ হয়ে গেলাম? তাছাড়া বড় হওয়ার সঙ্গে যাত্রা দেখার কী সম্পর্ক? আমি তো খুব কাঁদলাম। তারপর রাতে না খেয়ে দাওয়াতে পাতা খাটিয়ায় শুয়ে সারারাত কাটিয়ে দিলাম। পরদিন যাত্রা দেখতে যাওয়ার অনুমতি মিলল, তবে আসরে বসা চলবে ন। আমরা কয়েকজন বন্ধু আটচালার পশ্চিম দিকে একটা দেউল ছিল, তার উঁচু বেদীতে বসেই সেবার যাত্রা দেখেছিলাম।
                                                                              ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments