শিরদাঁড়ার গল্প
শ্রীজিৎ জানা
আভার চোখে জল। আর কত কি করে বোঝাবে মানুষটাকে! বড়ছেলে অতনু পর্যন্ত বিরক্ত বাবার উপর। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। তবে যেটুকু বলেছে তাও কম কিসে!
---এমনটা যদি চলতে থাকে তবে ঘর থেকে টেনে বের করে দেব এবার
আভার প্রাণে বড় বেজেছে কথাগুলো। কিন্তু সেই আঘাতের কষ্ট সবটুকু গোপন এক প্রকোষ্ঠ চেপে রাখে। কিছু বলতে চেয়েও সে বলতে পারে না। বয়সের একটা সীমারেখায় এসে মা-বাবাদের আর কিছু বলতে নেই। আভাও সেই স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। কেবলমাত্র এড়াতে পারেনি ওই মানুষটা, যাকে নিয়ে আভার গোপন অহংকার, চাপা কষ্ট!
মনোতোষ এক নম্বরের ছিটাল। বাজারপাড়ায় আড়ালে আবডালে তাকে তারকাটা বলে ডাকে। কেউ তার কাছে সহসা ঘেঁষে না। একথা সবাই বুঝে গেছে, কথা বলতে যাওয়া মানেই খাল কেটে কুমির আনা। হয়তো আপনি জিজ্ঞেস করবেন
-- কেমন আছেন মনোতোষ দা?
অমনি মনোতোষ আপনার দিকে ফিরে ঋজু গলায় বলে উঠবে,
---মেরুদন্ডী যেমন থাকে।
তার পরেই শুরু হবে কথার পিঠে কথার স্রোত। ---পৃথিবীতে দুই ধরনের জীব আছে মেরুদন্ডী এবং সরীসৃপ। আর অন্য কোন প্রাণী নেই । সবচেয়ে নিচু স্তরে থাকে সরীসৃপ। সরীসৃপ কখনো মেরুদন্ডী হতে পারে না। একটি মেরুদন্ডী মানুষ হতে পারে, যেমন বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষ। পৃথিবীতে মহাপুরুষ, মহামানব বলে কিছু নেই, দেবতা বলে কিছু নেই, মেরুদন্ডীই সর্বোত্তম।
পুনরায় যদি প্রশ্ন করেন,
--- তাহলে আমরা কোন স্তরে আছি মনোতোষ দা? মনোতোষ এর সপাটে উত্তর
---সরীসৃপ!
উত্তর শুনে হয়তো আপনার সামান্য কৌতুক করতে ইচ্ছে করবে। হয়তো তখন আপনি বলবেন,
---আপনি তো রোজ বাজার আসেন। বাজারে কি একটাও মেরুদন্ডী চোখে পড়ে না?
মনোতোষ আবার প্রগলভ হবে,
--- ছিল। নগেন।
-- চা দোকানি নগেন!
-- হ্যাঁ, চা-দোকানি নগেন। যাকে খুন করা হয়েছে। নগেন মেরুদন্ডী। অন্যায়কে সে প্রশ্রয় দ্যায়নি। ঘর থেকে তুলে এনে তাকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। তার অপরাধ, সে পার্টির লোক হয়েও রাসুর পক্ষে কথা বলেছে। রাসু বিরোধী পার্টি করে।
যেই শুনবেন রাজনৈতিক কেচ্ছা,অম্নি ভয়ে আপনার আপাদমস্তক কেঁপে উঠবে। পালাতে চাইবেন।
-- আচ্ছা, আসি এখন মনোতোষদা।
বলেই যেই এদিকওদিক তাকিয়ে পা রাড়াবেন সামনের দিকে,পেছন থেকে হাহা হেসে উঠবে মনোতোষ।আর বলবে,
---আস্ত একটা সরীসৃপ! ভীতু! স্বার্থপর একটা! সরীসৃপ! আপনার মাথায় তখন কে যেন ধাঁই করে সজোরে একটা বাঁশের বাড়ি মারবে! আপনি হাঁটতে গিয়েও আশ্চর্যভাবে থমকে গ্যাছেন। কিন্তু মনোতোষ থামবে না।
----আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার হাত-পা শরীরের মধ্যে সেঁদিয়ে গেছে! তুমি এবার বুকে হাঁটতে শুরু করবে! কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তুমি মেরুদন্ডী ছিলে। আসলে সরীসৃপ - মেরুদন্ডী আবর্তনে আমাদের প্রতিমুহূর্তের জীবন।
নিশ্চিত আপনার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। আপনি ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু মানুষটার চোখে চোখ রাখতে সাহস কুলোবে না। মনোতোষ সেই মুহূর্তে অন্য মানুষ!
স্কুল জীবন থেকেই মনোতোষ অন্য ধাতে গড়া। কলেজে প্রথম প্রথম রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করেছিল। পরে ছিটকে বেরিয়ে আসে। বলে,
--ভেতরে ঢুকে দেখলাম এ ধরনের রাজনীতি মেরুদন্ডীরা করে না।
বিয়ের মাস কয়েক পরের ঘটনা। মনোতোষ তখন কলকাতায় এক নামি কোম্পানিতে চাকরি করে। হঠাৎ একদিন তল্পিতল্পা নিয়ে ঘরে হাজির। নতুন বউয়ের চোখেমুখে কৌতুহল।
---এসব নিয়ে চলে এলে যে?
---চাকরি ছেড়ে দিলাম।
---- চাকরি ছেড়ে দিলে?
---ছেড়ে দিলাম বাট তুমি এভাবে আমাকে কৈফিয়ৎ চাইছ কেন?
---কেন! জিজ্ঞেস করতে পারি না?
--- পারো, তবে জানো তো তোমার চোখের থোকা থোকা মেঘফুলগুলো হঠাৎ এখন ঝরে যাচ্ছে। সেখানে মিশকালো দুটো বিড়াল যেন ওত পেতে বসে আছে।শুধু শিকার করবে বলে।
ভয়ে চমকে উঠে আভা। মনোতোষের ভ্রুক্ষেপ নেই। অনর্গল বলে চলে,
---আসলে কোম্পানির দরজা গুলো সব ছোট। আমি সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে ঢুকতে পারবো না। চরে বেড়াতে পারবো না বসের পায়ে পায়ে। তাই ছেড়ে দিলাম।
এরকমই মানুষ মনোতোষ। কারণ জানতে চাও তো মনোতোষ তখন দার্শনিক,
---একটাইতো পথ আমাদের, ঘর থেকে শ্মশান। ব্যাস, ফুরিয়ে গেল সব। তাও কেওড়াতলা নিমতলা মহাশ্মশান আমাদের ভাগ্যে জুটবে না। তাই একটু অন্যপথ ধরা। ছোটবেলায় পড়েছি মানুষ মেরুদন্ডী প্রাণী। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দেখি আছে কিনা! যখন জানতে পারি আছে তখন সটান হয়ে দাঁড়াই
আর এই সাহসিকতায় মনোতোষকে একা করে দিয়েছে। সে আজকাল একলা পথের পথিক। বড়খোকা ছেলে -বউ নিয়ে চাকরির অজুহাত দেখিয়ে কলকাতায় ফ্লাট নিয়েছে। তারপর ছোট চলে গেছে মেদিনীপুর শহরে। ছোটোর চলে যাওয়ার কারন এই মনোতোষ। অপরেশ বাবুকে একটু বললেই সন্দীপ বেসিক ট্রেনিংটা হয়ে যায় কিন্তু না মনোতোষ কক্ষনো বলতে চায়না। অপারেশ তার ক্লাসমেট। উচ্চমাধ্যমিকে দুবার ব্যাক। কলেজের মুখ দেখেনি অথচ পার্টির বড় সাইজের নেতা! মনোতোষ বলে,
---একটা ভয়ানক সরীসৃপ! মেরুদন্ডী কখনো সরীসৃপের কাছে নত হবে না!
সন্দীপ সেই রাগেই ঘর ছাড়ে। পরে কোন এক শিক্ষকের মেয়েকে বিয়ে করে নিজেও শিক্ষকতা করছে এখন!
একে একে সবাই ছেড়ে গেছে মনোতোষকে। আভা যেতে পারেনি। ছেলেরা তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও না। আসলে মানুষটার সঙ্গে এতগুলো বছর একসাথে কাটিয়েছি। কখনো কারো ক্ষতি করেনি। লোভের পায়ে মাথা রাখেনি। ছেলেরাও তার বাবাকে বোঝাতে চেয়েছে বারবার, আজকের দিনে এভাবে বাঁচা যায় না। কিন্তু আজকের সমাজে বাঁচার যে আশ্চর্য কায়দা তা তাকে বোঝানো যাবেনা।
আভা মাঝেমধ্যে ছেলেদের কাছে যায়। নাতি-নাতনিদের দেখতে তার বড় ইচ্ছে করে। দু'একদিন কাটিয়ে আসে। মনোতোষও যায়। বৌমারা মনে মনে বিরক্ত হয়। কারণ ওই একটাই। মনোতোষ সেখানেও নাতি নাতনীদের বোঝায় মেরুদন্ডী আর সরীসৃপের ফারাক।
আভা এক একবার খুব বিরক্তি হয়। এইতো সেদিন অতনুর বয়সী একটি ছেলে ঘরে এসে একপ্রকার শাসিয়ে যায়,
---মাসিমা ওনাকে বলবেন একটু ঠিকঠাক থাকতে। পাগলামির একটা সীমা আছে, তালে পড়লে বিট খেয়ে যাবে!
মানুষটাকে সবাই একপ্রকার পাগল ভেবে নিয়েছে। আভা ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু সে অসহায়। মনোতোষকে বললেই চিৎকার করে ওঠে সে,
--ওগুলো অপরেশের পোশা সরীসৃপ। মনোতোষের মত মেরুদন্ডী কখনো ভয় পায় না।
আভার ভয় হয়, বড় ভয়। ছেলেরা বাড়িতে নেই। কোন একটা বিপদ ঘটলে কে সামলাবে! মনোতোষ কোন নিষেধ মানে না! সকাল সন্ধ্যা দু'বেলা তার বাজার যাওয়া চাই বাজারে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে না, খবরের কাগজ পরবেনা। পড়ার কথা বললেই বলবে,
--- ওতে কয়েকটা গণ্যমান্য আর রক্তচোষা সরীসৃপদের লোকদেখানো লড়াই। গুচ্ছের সমস্যা যে রোজ রোজ চোখ দিয়ে গিলিস, কোন প্রতিবাদ করিস? আছে শিরদাঁড়া?
বাজার পাড়ার মধ্যে নটুর হৃদয় একটু নরম। দোকানের দুয়ারে ভিখিরি পাগল লেগেই থাকে রোজ। নটু কাউকে পয়সা দেয়,কাউকে খাবার কিনে দেয়। মনোতোষ নটুর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
----জানিস তোর চোখে আমি অনেক চাঁপা ফুল দেখি! সোনা রঙের চাঁপা!
কথাপ্রসঙ্গে কেউ হয়তো সত্যবাবুর কথা তুলেছেন,ব্যাস্, মামনোতোষের মুখের আগলগেলো খুলে-
---- সত্যদাসের চোখ ক্ষুধার্ত হায়না সারাক্ষণ বসে থাকে। সুযোগ খোঁজে।
স্থানীয় লিডারকে নিয়ে এরকম কথায় যখন সকলে আতঙ্কিত। আশেপাশে কেউ শুনে ফেলল কিনা সেই নিয়ে চিন্তত! কিন্তু মনোতোষের কথায় তখনো পূর্ণচ্ছেদ পড়বে না।
বাজারপাড়া অনেকেই মনোতোষকে ভেতরে ভেতরে সাপোর্ট করে। আসলে মানুষটা যা বলে তাতে মিথ্যের বালাই নেই পাগলামী নেই। কিন্তু ছেলেপুলে নিয়ে সংসার যেখান,সেখানে নেতাদেরকে খ্যাপানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! মনোতোষের সাহস আছে একথা এক বাক্যে স্বীকার করে নেয় বাজারের সকলে।
এই মনোতোষকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল পরশু রাতে! মনোতোষ বাজার থেকে প্রায় আটটা নাগাদ করে বাড়ি ফেরে। সেদিন দেরি দেখে পাশের বাড়ির পিকুকে একটু এগিয়ে যেতে বলে আভা। টর্চ হাতে পিকু বাজারের দিকে এগোতে থাকে। বাজারকে যেতে মাঝে অনেকটা যেখানে ফাঁকা জায়গা সেখানে হঠাৎ মনোতোষকে পড়ে থাকতে দেখে নাকে মুখে তার চাপচাপ রক্ত! কোন জ্ঞান নেই! তড়িঘড়ি লোকজন ডেকে মনোতোষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে মনোতোষ। মাথায় ঘাড়ে ভীষণভাবে জখম হয়েছে। পেছন থেকে কেউ একজন মোটা রডের আঘাত করেছে বলে অনুমান। এক হাতে স্যালাইন, অন্যহাতে ব্লাড। নাকে অক্সিজেনের নল। চোখের পাতা বন্ধ। মাঝেমধ্যে মুখ দিয়ে দু একটা অস্ফুট শব্দ ছিটকে বেরিয়ে আসছে। অতনু, সন্দীপ, আভা ছাড়াও বাজারপাড়ার দু-একজন এসেছে। বেডের চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ডাক্তার জানিয়েছেন বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। আভার চোখের জল বাধা মানছে না।
নিস্তরঙ্গ কেবিনে শুধু শুনতে পাওয়া যাচ্ছে মনোতোষের ধারালো কিছু শব্দ। চোয়াল শক্ত করছে তার দুই ছেলে। ঘামছে বাজার থেকে আগত লোকজন। ইচ্ছে হলে চলুন আমরাও শুনি। তবে ভেবে নিন এরপর থেকে আয়নার সামনে দাঁড়াবেন কিনা!
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments