গুচ্ছ কবিতা
বাসুদেব গুপ্ত
(১)
দুটি মলাট মাঝখানে এক পুকুর
গালগল্পের, শান্ত খালি দুপুর,
অনেকখানি কাচ্চি ঘানি রোদ
সূর্যমুখীর শরীরে শোধবোধ।
কাঁচ সাঁতরায় জংলা সাপের জিভ
বিষ জ্বলে দুধ নারায়ণের জীব ,
নয়নমুকুর অনেক দুখের হবি
ফেসবুকে নেই হাল্কা হাসির ছবি।
শালিখদেরও পাড়াতে নেই ভোজ
জল শুঁকে যায় অশ্বারোহ রোদ
গোলার শব্দে টুকরো ভাঙা দুপুর,
দুটি মলাট, মাঝখানে কৈ পুকুর?
(২)
যে ফুল রক্তাক্ত হয় নিজের কাঁটার ঘায়
সে ফুল লাল না সাদা? না বিপর্যয়?
ঠোঁট চেপে ধরে নীল নীল বিষ স্তব্ধ নীলাকাশ,
স্মৃ তি কি দিগন্তে পাবে পিয়ানোয় নীল নির্যাস?
শুধু ঘাস, ঘাস হাঁটে, চলে যায় ঘাসের শরীরে
অস্থির কিছু বলে মৃগ নাভি মাটির গভীরে?
ফুলের শরীর বোনা কাঁটা, কাঁটার শরীর ঘেরা ফুল,
শিশির কি হতে চায় বাধাহীন যৌন নির্ভুল?
রন্গমন্চ ফাঁকা, গ্রীনরুমে পুরনো ডায়লগ মনে মনে,
কবিতা জ্বালিয়ে গান ওড়ে, বাস্তুহীন কবি একা শোনে।
(৩)
আজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, চাঁদ এসে বসেছে ওপারে।
আমিও তৈরী আছি ডেবিট ক্রেডিট লিখে পদ্যখাতায়
আলোচনা গুরুতর হবে, সামনে গন্গার জল বিবাদী সফেন,
শহরে শ্যাম্পেন ভাসে মধ্যরাতে হবে লেনদেন।
কামিনী কাঞ্চন ঝোলে বহুতল পোস্টারে, পোস্টম্যান নাকি করোনা?
সবাই আকাশে চেয়ে, নামবে কি দিল্লী থেকে রন্গীন বেলুনে প্রাণভয়
শিশুরা বোঝেনা মরে যাওয়া, পৃথিবী নেহাতই এক নীল ফুটবল
পেটে তার আংরার জ্বলন্ত অপেক্ষা , পাবে ফেসবুকে লাইকের ঢল?
চাঁদ আজও লিপ্ত শিশু, কেমন অভ্রান্ত হাসে, যুদ্ধের ট্রেন যায় আসে,
কবিরা লুকায় ছুরি দখিন বাতাসে, মিসাইলে জ্বলে নাট্যশালা
চাঁদ কাশে, গংগা ভলগা জুড়ে দীপ্ত লাল মদ, রক্ত ফোঁটা ফোঁটা
সিদ্ধান্ত নেবার দিন দাঁড়িয়ে পিওন দরজায়, স্বাক্ষর করেছো?
(৪)
একটাই রাস্তা ছিল, ভোর বেলা-
কোঁচড়ে মুড়ি বেঁধে দরজা খুলি, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রোদ
তার হাত ধরলেই সব আলো , তার ফকির চুলে বসে
ধবধবে সাদা পায়রা যে শেষ পর্যন্ত দেখতে পায়
তাদের ডানার কোন ছায়া নেই, চোখে আঁকা শান্তির সাম।
মাকে বললাম আসি,
বোনকে বললাম মেলা কোথায় ঠিক খুঁজে পাবো
বাবা একটা পুরনো গানের কলি লিখে দিলেন পদ্মপাতায়
বললেন গাইতে গাইতে যা, গায়ে ঝড় লাগবে না,
একটা রাস্তা। একটাই দিক একটাই দিগন্ত
রাস্তার শেষে সেই একটাই মহিমাময় নদ। যে সন্ধেবেলা
সমুদ্রের সংগে কথা বলে, মাটির ভবিষ্যত নিয়ে।
যেতে যেতে যেতে একটা রাস্তা হঠাৎ ভাগ হয়ে
পেট থেকে বেরোলো আরেকটা রাস্তা
রোদ বলল একটু বসি, জিরিয়ে নি
পায়রাটা সেই যে মেঘ দেখে অন্ধ হয়ে গেল।
একটা থেকে দুটো থেকে চারটে থেকে আটটা….
সাপের ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসে রাস্তার বাচ্চারা কিলবিল
পদ্মপাতায় জল ধরলাম আঁজলা ভরে ঝিল থেকে,
গানের কলি চলে গেল মৎসকন্যার খোঁজে।
আমাকে এখন ঘিরে ধরছে রাস্তার পাকানো কুন্ডলী
আমার মেলায় যাওয়া হলো না
আমার দেখা হলো না সেই মহিমাময় নদ
আর অনেক উপরে গাছের ডালে দেখি বসে বসে রোদ পা দোলাচ্ছে
তার দাঁতে চেনা রক্ত ও পায়রার কুচি,
তার মাথায় কালো পাগড়ী, আর গায়ে একটা নামাবলী
তাতে লেখা ভোট দো। নহিতো গোলি খা।
(৫)
এটা একটা থ্রিলিং গল্প দাদা বৌদি ও ফেসবুকের আলতোদের জন্য,
যারা অভিজ্ঞ খুন ও হত্যা ও ধর্ষণ ও বোমার ধামাকার অণুগল্প ভালোবাসে।
যারা দেখেছে করোনার প্রযোজিত সিরিয়াল
পাশের বাড়ীর কাকুর মর্নিং ওয়াক শেষে চিরপ্রস্থান,
ধাপার মাঠে শুকনো ধোঁয়ায় হাত নেড়ে,
খড়খড়ি তুলে গোয়েন্দাগিরি করা কাকীমার
শেষ ঝোলানো শাড়ীটার ওপর একটি শান্ত কাক দোলে,
পাড়ার ধনন্জয়দা
রোজ সকালে যে পাঁউরুটির সংগে একমুঠো হাসি
ফাউ দিত, আর পয়সা চাইতে ভুলে যেত
তার দোকান ভেঙে এখন চপ ভাজছে সদ্যছাঁটাই বাস্তুকার।
লম্বা লম্বা কালো ছোপছোপ পুরনো ফ্ল্যাটবাড়ী
যারা দুবছর আতংকে দশবার কুড়িবার হাত ধুয়ে ধুয়ে
কোনমতে বেঁচে গিয়ে, খুনের গল্প হত্যা বন্দুকবাজী ও ধ্বংসের
ছবি দেখে গেল দুবছর,
ইউটিউব নামক স্যাংতসেঁতে ৪ ফুট বাই তিনফুট সিনেমাহলে
তারা এই খবরটা দেখে মজা পাবে,
প্রাইম টাইমে এগিয়ে চলা চ্যানেলে চ্যানেলে আজ চলছে
শেফালি তার বরের মুন্ডুটা কেটে একটা থলেয় ভরে জমা দিয়ে গিয়েছে থানায়।
পুলিসরা চিরকাল সবই জানে,
এটা কাঁচা খুনীর কাজ, কিন্তু লিন্চপিপাসু জনতা মজা পাবে,
পুলিসরা যে সব জানে তা আমরাও জানি,
রোজ ব্রিফ কেসে ভরে পাচার হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কলজে
রোজ উন্মত্ত বাইসনের মত নেতার গাড়ী
লক্ষ লক্ষ চাষীর মাথা চেপ্টে দিচ্ছে ধুলোয়
রোজ লক্ষ বেকারে মুন্ডু নিয়ে উড়ে যাচ্ছে মহামহিমের হেলিকপ্টার
রোজ লক্ষ অসহায় মেয়ের মুন্ডু মজা সেরে জ্বালিয়ে দিচ্ছে নতুন দেশের কারিগর
অথচ শেফালীর মুন্ডু নিয়ে ব্যাগে ভরে থানায় জমা দেবার কথা বলতেই,
টিআরপি টিআরপি বলে ডানা নেড়ে লাল কিল্লা থেকে উড়ে যায় একশো কবুতর,
উড়তেই থাকে….
যতদিন না পালে বাঘ পড়ে।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments