জ্বলদর্চি

চাঁচরী (হোলিকা দহন)/ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব পর্ব - ১২
চাঁচরী (হোলিকা দহন)

ভাস্করব্রত পতি

‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল /  পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।’ 
দোলের আগের দিন খড়, বাঁশ, শুকনো পাতা, কাঠ, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে ঘর বানিয়ে জ্বালানো হয়। এ ধরনের উৎসব পরিচিত 'চাঁচরী' বা 'হোলিকাদহন' বা 'ন্যাড়াপোড়া' বা 'বুড়ির ঘর পোড়ানো' নামে। ইতিহাস বলে, হোলিকা দহন উৎসবের শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবের মুলতানের প্রহ্লাদপুরী মন্দিরে। তবে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে এই 'চাঁচরী' একসময় আদিম শবর জাতির জীবন সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল।

হোলিকা দহনের পৌরাণিক উৎস রয়েছে স্কন্ধ পুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য গ্রন্থের এক কাহিনীতে। কাশ্যপ ঋষি এবং দিতির দুই পুত্র হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু হিংস্রতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। এই ভাইদের একমাত্র বোন হোলিকাও ছিল ভাইদের মতো বদ। হিরণ্যকশিপু তাঁর প্রজাদের যে কোনো রকম পুজো অর্চনা করা বন্ধ করে দেন। আর সেইসাথে চির অমরত্ব লাভের জন্য শুরু করেন ব্রহ্মার তপস্যা। সেই তপস্যায় খুশি হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে পাঁচটি ক্ষমতা দেন। কোনো ভাবেই কোনও মানুষ বা কোনও প্রাণী তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে না, দিনে বা রাতে কোনো ভাবেই তাঁর মৃত্যু হবে না, অস্ত্র শস্ত্র দ্বারাও হবে না, মৃত্যু জমিতেও হবে না, জলেও হবে না, এমনকি শূন্যেও হবে না এবং ঘরের ভেতরে বা ঘরের বাইরেও তাঁর মরণ হবে না। এতগুলো বর পেয়ে হিরণ্যকশিপু 'ধরা কে সরা' জ্ঞান করে অত্যাচার বাড়াতে থাকে। এদিকে তাঁর সন্তান প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। তখন প্রহ্লাদকে হত্যা করে পথের কাঁটা সরাতে চাইলেন তিনি। এজন্য নিজের বোন হোলিকাকে কাজে লাগালেন হিরণ্যকশিপু। 

এই হোলিকাকে একবার ব্রহ্মা একটি শাল উপহার দিয়েছিলেন। সবসময় তাঁকে রক্ষা করবার বিরল ক্ষমতা ছিল সেটির। হোলিকা পরিকল্পনা করেন যে তিনি প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনের মধ্যে যাবেন। কিন্তু তাঁর কাছে যেহেতু ব্রম্ভার দেওয়া শাল আছে তার ফলে সে নিজে পুড়বে না। অথচ ভক্ত প্রহ্লাদ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সকলে এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করল। সেই মতো হোলিকা যখনই প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করল তখনই তাঁর গায়ের শালটি নিজের শরীর থেকে প্রহ্লাদের গায়ের উপর পড়ে। ফলে আগুনে কোনো ক্ষতি হলোনা প্রহ্লাদের। কিন্তু পুড়ে ছাই হয়ে যায় হোলিকা। আর এভাবে দুষ্ট হোলিকার মৃত্যু থেকেই মর্তে প্রচলিত হয় হোলিকা দহন। যা আসলে 'দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন'কেই আখ্যায়িত করে।

আবার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে, ফাল্গুনী শুক্লা চতুর্দশীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শঙ্খচূড় দৈত্যকে বধ করেন। এ কারণে চাঁচর হয় বলে অনেকের ব্যাখ্যা। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, চাঁচর অনুষ্ঠানের বুড়ির ঘর পোড়ানো আসলে মেষরূপী ভাদ্রপদা নক্ষত্রের প্রতিরূপ। ঋগ্বেদে ঐ নক্ষত্রের নাম রয়েছে 'অজ একপাদ' তথা একপদবিশিষ্ট ছাগ। কল্পিত অসুররূপী ঐ মেষ বা ছাগকে পোড়ানো হয়। অসুরের নিধনে সূর্যের উত্তরায়ণের বাধা চলে যায় এবং সূর্যের তাপ ও দিন বাড়তে থাকে। অগ্নুৎসবের পর লাল এবং সাদা আবির কৃষ্ণের মূর্তিতে ছোঁয়ানো হয়। এটি আসলে লাল বর্ণের সূর্যের দ্যোতক। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, একে 'ম্যাড়াঘর'ও বলে। অর্থাৎ ভেড়ার গোয়াল। ভেড়ার গোয়ালে আগুন দেওয়া আসলে গোপ শ্রেণীর প্রভাব সুষ্পষ্ট। বাঁকুড়াতে 'মেড়ালি গোপ' এবং 'পূবালী গোপ' - এই দুই শ্রেণীর আদিবাসী গোপ সম্প্রদায়ের অবস্থান রয়েছে। 

আবার পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ধর্মীয় ভাবাবেগ প্রয়োগ করে চাঁচর বা চাঁচরী নামক উৎসবের শুরু বলে অনেকের ধারণা। দোল উৎসব হয় শীতের শেষে। তখন পাতা খসার সময়। এরপরেই শুরু হয় কালবৈশাখীর ঝড় এবং বৃষ্টি। সেই জলে যাবতীয় ঝরা পাতা পচে দুর্গন্ধ বেরোনোর সম্ভাবনা থাকে। এইসব পচা পাতা থেকে রোগ সংক্রমণকারী ব্যাক্টিরিয়া ও ছত্রাক জন্মায়। কিন্তু শুকনো পাতা পুড়িয়ে দিলে সেই সম্ভাবনা থাকেনা। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ভাবনা থেকেই এহেন উৎসবের সূচনা করেছিলেন সেকালের বিজ্ঞান মনস্ক সমাজসংস্কারকরা।

মূল সংস্কৃত শব্দ 'চর্চ্চরী' থেকে এসেছে 'চাঁচর' কথাটি।
সংস্কৃত চর্চ্চরী > চংচরী > বাংলা চাঁচরী > চাঁচর
যার অর্থ কুঞ্চিত বা কোঁকড়া। 'চর্চ্চর' অর্থে কুঞ্চিত কেশ বা চাঁচর চুল বোঝায়। নবীন চন্দ্রের গ্রন্থাবলীতে আছে "তখন পশিল কর রমণী চাঁচরে"। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও পাই "চাঁচর চিকুর"।
তবে উৎসবক্রীড়া বা উৎসব বোঝায় 'চাঁচর' অর্থে। 'অমরকোষ টীকা' অনুসারে এটি হল কাপটিকের হর্ষক্রীড়া তথা বসন্তসময়কালীন ক্রীড়া। 'চাঁচরী' হল সেরকমই এক ধরনের ক্রীড়া। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এ পাই "চাঁচরী খেলাওঁ মোএঁ"। হিন্দী 'চাচর' বা 'চাচরি' শব্দটি "দোলে বা হোলী পর্ব্বে করণীয় অগ্ন্যুৎসবাদি হর্ষক্রীড়া ( খেলাতামাশা )" বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

লোক গবেষক তথা প্রবন্ধকার অপূর্ব কুমার জানা এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, "বামুন ঠাকুর পুজো করেন। খোল করতাল সহযোগে হরিনাম সংকীর্তন হয়। তারপর স্তূপীকৃত শুকনো ডালপালায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বাতাসা ছড়িয়ে হরির লুঠ হয়। এভাবেই সকল অশুভ শক্তির দহন ঘটে।" এটি পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার মানুষের এক অতি পরিচিত লৌকিক উৎসব। তবে জঙ্গলমহলে মকর পরবের সময়েও এরকম বহ্নুৎসবের আয়োজন করা হয়। মকরস্নানের পর জলাশয়ের ধারে 'মকর কুঁড়িয়া' বা 'কুমা জ্বালানো' হয়। আসলে শীতের হাত থেকে বাঁচতে একটু উত্তাপের খোঁজে এই প্রথা। 

চাঁচরের রাত্রিতে বর্ধমানের কুলটির মিঠানি গ্রামে এক ভিন্ন স্বাদের এবং বিশেষ লোকাচার অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মহিলারা তথা বালিকারা এদিন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে অন্য মহিলার সাথে। যা বজায় থাকে সারাজীবন। গ্রামীন এই লোকাচারটি 'চাঁচর পাতানো' নামেই প্রচলিত। আসলে হোলিকা দহনের পর গ্রামের বালিকারা তাঁদের প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে হাজির হয় গ্রামের কূলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দিরে। আবির মাখিয়ে একে অপরকে রঙিন করে শপথ নিত, যাতে বন্ধুত্বের সুমধুর সম্পর্ক আমৃত্যু অটুট থাকে। এরপর থেকে তাঁরা একে অপরের নামোচ্চারণের সময় 'চাঁচর' শব্দটি ব্যবহার করে। চাঁচরের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যেও গড়ে ওঠে হৃদয়ের সম্পর্ক। বর্ধমান শহরেও এরকম করা হয়। যদিও এই চাঁচর পাতানো লোকাচারটি কেবল মহিলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তবুও বলা যায়, এহেন উদ্যোগ ভূভারতে বিরলতম‌। এটাই পশ্চিমবাংলার লৌকিক উৎসবের সার্থকতা।

হোলিকা দহনের নিয়ম কানুন অবশ্য নানা যায়গায় নানা রকম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফাঁকা যায়গায় গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা শুকনো পাতা খড় দিয়ে তৈরি করে চাঁচর। সন্ধ্যের মুখে জ্বালানো হয় তা। কেউ কেউ আলু দিয়ে দেয় এই আগুনে। পরে ঐ পোড়া আলু দিয়ে ভোজ সারে সবাই মিলে। পাঁশকুড়ার মার্কণ্ডপুর গ্রামে ভুঁইয়া দের পরিবারের রীতি অবশ্য আলাদা। পারিবারিক নিয়ম মেনে পালকিতে করে পরিবারের গৃহদেবতাকে নিয়ে আসা হয় কীর্তন সহযোগে। চাঁচরীর ঘরে মাটির বেদীতে দেবতাদের বসিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করার পর দেবতাকে স্বস্থানে পৌঁছে দিয়ে ঐ চাঁচরীতে আগুন দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে পাশাপাশি লোকজনকে নিরামিষ খাওয়ানোর রেওয়াজ রয়েছে পরপর দুইদিন। পরের দিন চলে আবীর খেলা। গবেষক অপূর্ব কুমার জানা ন্যাড়াপোড়ার উপচার এবং নিয়ম সম্পর্কে জানিয়েছেন, "ন্যাড়া পোড়ার আগে পুজোর উপকরণ ছাড়াও চারটি মালা লাগে। একটি পূর্বপুরুষের, একটি হনুমানজীর, একটি শীতলা মায়ের এবং চতুর্থটি গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে। ন্যাড়া পোড়ার আগে সুতো দিয়ে স্তূপাকৃতি উপকরণের চারপাশ বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর তিন বা সাতবার হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে প্রদক্ষিণ করা হয়। এবার ন্যাড়া পোড়ায় পুজোর বাকি সমস্ত উপকরন ও জল দিয়ে অর্ঘ্য দেওয়া হয়। সবাই তিলক কাটেন। এর পরে হোলিকায় আগুন দেওয়া হয়।"

'ন্যাড়া পোড়া' হল মন্দকে সরিয়ে ভালোকে আনয়নের উৎসব। পুরোনোকে সরিয়ে নতুনকে আবাহন করা। বছরের পর বছর ধরে এই লোকাচার আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে উদযাপিত হয়ে আসছে। তাই ন্যাড়া পোড়ার পর সবাই সেই ছাই শরীর ও কপালে লাগায়। বিশ্বাস যে, এর ফলে কোনো অশুভ শক্তি আমাদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলবে না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments