জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭৩

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭৩


সম্পাদকীয়,
আমরা যখন এক জায়গা থেকে অনু জায়গায় যাই, প্রথম প্রথম সেখানকার রাস্তা গুলিয়ে ফেলি। থতোমতো খাই। কাউকে জিজ্ঞেস করি। তোমরা আমার কথা শুনে হাসছো জানি। তোমরা বলবে অন্য কাউকে কেন মোবাইলে গুগুল বাবাকে জিজ্ঞেস করে নেব। সত্যি তোমরা কত কত জানো। তার চেয়েও বলা ভাল তোমাদের সময়ের কত সুবিধা। আমাদের সময়ে রাস্তার খোঁজ নিতে নতুন জায়গায় গিয়ে কত কত বিপদে পড়তো সবাই। গ্রামে তো আরো অসুবিধা। আর অন্য রাজ্যে যেখানে সকলে আলাদা ভাষায় কথা বলে সেখানে কিভাবে জিজ্ঞেস করতো ভাবতো একবার? অন্যদেশে গিয়ে কত কত মানুষ এভাবে হারিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। আমি ভাবি পাখিরা তাহলে কিভাবে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে রাস্তা চিনে উড়ে যায়! সে গল্প অবশ্য বাসবদত্তা আন্টি বলেছে। আর অন্য জায়গার ভাষা বা খাবার পছন্দ নাহলে থাকুতে পারেনা সবাই, সে গল্প তপশ্রী আন্টি তিন সপ্তাহ ধরে বলছে আমাদের। তবে ভাষা বুঝিনা বলে তো কুঁয়োর ব্যাঙ হলে চলবে না। স্কুলে যেতে হবে। পড়ালেখা শিখে নতুন কিছু শিখতে হবে। সেকথা গৌতম আঙ্কেল কবিতায় বলেছেন। হ্যাঁ, গৌতম আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন, স্কুল খুলে গেছে। সুহেনার ছড়ার মতো বাঁদর খেলা দেখবার দিন শেষ। ঋপণ কাকুর তোলা ছবিতে গ্রামের পথে যে ছেলেটা ছুটে আসছে, তাকেও এবার স্কুলে যেতে হবে। মন দিয়ে পড়া লেখা করে তোমাদের বড়ো বড়ো কাজ করতে হবে। যে কাজের মাধ্যমে সারা পৃথিবী তোমায় মনে রাখবে। ঠিক জয়াবতীর জয়যাত্রার সেন মহাশয়ের খ্যাতির মতো। তৃষ্ণা আন্টির জয়াবতীর গল্প কিন্তু এক গ্রাম ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। জয়াবতীরা এভাবেই গুগুল বাবার সাহায্য ছাড়াই এগিয়ে গেছিল সেসময়। কি সাহস তাই না? তোমরাও তোমাদের তুলির আর কলমের আঁচড়ে এই সমস্ত সাহসীদের গল্প লিখে আর এঁকে পাঠিও।  - মৌসুমী ঘোষ।




ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
পঞ্চম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
 
আরও বকেই যেত জয়াবতী যদি না সন্ধ্যারতির ঘণ্টা পড়ত ঢং ঢং করে। সেনবাড়ির রাধামাধবের মন্দিরে দুবেলা পুজো হয়, সন্ধ্যায় সেখানে আরতি আর গান হয়, সেখানে সবাইকে থাকতেই হয়। না গেলে সেনমশাই রাগ করেন। ওদের ভালই লাগে যেতে। তবে চিকের আড়ালে বসতে মোটেই ভালো লাগে না জয়াবতীর। কিন্তু আড়ালের একটা সুবিধে আছে, সবার ওপর নজরদারি করা যায়, কিন্তু তোমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
পুণ্যি আর জয়াবতী ছুটতে ছুটতে রাধামাধবের মন্দিরে পৌঁছে গেল। মূল বাড়ির অন্দরমহল থেকে এই মন্দিরে ঢোকার একটা ঢাকা বারান্দা আছে, এদিক দিয়ে উঠেই মেয়েদের বসার ব্যবস্থা।
পুণ্যি আর জয়াবতী পৌঁছে দেখল বাড়ির সব মেয়েরা এসে গেছে, গ্রামের দু চারজনও এসেছে, সঙ্গে এন্ডি গেন্ডি দু চারটে। এই বাচ্চাদের মোটেই হরে কৃষ্ণ শুনতে ভালো লাগে না, কিন্তু পুজোর পর লুচি আর মোহনভোগের যে চমৎকার প্রসাদ দেওয়া হয়, তার লোভে এরা আসে। একে বলে বৈকালী প্রসাদ। এটা জয়াবতীর খুব পছন্দ।
এ বাড়িতে এসে  খাবার কোন সমস্যা নেই, বরঞ্চ তাদের বাড়ির তুলনায় এলাহি আয়োজন বলা চলে।পিতাঠাকুরের চিন্তা ছিল যে বামুনের ঘরের দুটো মেয়ে, একজন আবার বেধবা, কীভাবে বদ্যির বাড়ি গিয়ে ভাত খাবে। তবে সেনমশাই বললেন যে তাঁদের বারোমাসের বামনী রাঁধনি আছে, তবুও আসার সময় মা বলেছিল, খাওয়ার থালার পাশে একটু গোবর রেখে খেতে।
শুনেই জয়াবতী বলে উঠেছিল ‘ম্যাগো, তার থেকে না খেয়ে থাকা ভালো। বলি শাস্ত্রের কতার ওপর তো আর কতা চলে না। সেকানে পষ্ট লেকা আচে, বিদেশে নিয়ম নাস্তি। বোলসিদ্ধি থেকে তিন তিনটে গাঁ পেরোলে তবে সোনাটিকরি, বিদেশ হল না নাকি? তাছাড়া আমরা যাচ্চি চিকিচ্ছে শিখতে, ভোর থেকে রাত অব্দি খল নুড়ি নিয়েই কেটে যাবে। সেসব ছেড়ে গরুর পেচন পেচন গোবর খুঁজে মরি আর কি।’
এরপর তার মা আর ভয়ে কতা বলেনি। জয়াবতী তর্কে জেতার জন্যে প্রায়ই শাস্ত্রের দোহাই দ্যায়। সে আদপে কোন শাস্ত্রই পড়েনি। এই নিয়ে পুণ্যি প্রশ্ন করলে সে অম্লানবদনে বলে ‘আমি নয় পড়িনি, আর কেই বা পড়েচে বল দিকি? সব শোনা কতাই চলছে। খুব জোর দিয়ে বললে সেটাই সবাই বিশ্বাস করে। কেউ কিচ্চু পড়েনি কো’
‘তুই যে এত মিছে কতা কস, তোর পাপের ভয় নেই ভাই গঙ্গাজল?’
‘দূর, যে মিছে কতায় সবার উবগার হয়, সেটা বললে পুণ্য হয়, বুঝলি পুণ্যি’
‘এখানে কার কী উবগার হচ্ছে শুনি?’
‘এই যে গোবরের গন্ধ শুঁকে ভাত খেতে হচ্ছে না, বদ্যির বাড়ি বলে নিজেদের হাত পুড়িয়ে খেতে হচ্ছে না, এটা কম উবগার? হেঁসেল ঠেলে ঠেলে আমাদের মেয়েগুলো আর মাতা কোতাও খাটাতেই পারে না তো’
কতাটা ঠিক। ভালো মন্দ খাওয়া হচ্ছে এখানে।   তার কারণ সেনমশাইয়ের পসার খুব। দূর দূরান্ত থেকে রুগী আসে গরুর গাড়ি চড়ে। তারা চিকিচ্ছের দর্শনী তো দেয়ই, সঙ্গে আনে খেতের শাক সব্জি, গাছের ফল আর কতরকম মেঠাই। কিন্তু বাড়িতে খাবার লোক বেশি নেই। সেনমশাইয়ের একটিই ছেলে, সে আবার পেটরোগা। কিছুই খেয়ে সহ্য করতে পারেনা। আর লোক বলতে সেনমশাইয়ের পরিবার মানে ইস্তিরি, বুড়ি মা আর বিধবা পিসি জগত্তারিণী। এই জগো পিসি ছাড়া সবাই জয়াবতীদের খুব ভালবাসে। কিন্তু জগোপিসি ওদের দুচক্ষে দেখতে পারে না। একজন বিধবা আর একজন বিয়ের যুগ্যি মেয়েমানুষ চিকিচ্ছে শিখতে কবরেজের বাড়ি এসে উঠেছে এমন অনাছিস্টি কাণ্ড নাকি আর হয় না।
জগোপিসি আবার পুণ্যির থেকে জয়াকে বেশি অপছন্দ করে, এমন মুখরা মেয়েমানুষ সে নাকি আর দেখেনি। জয়া তাকে একবার বলেছিল ‘পুণ্যিকে বেধবা বেধবা বলচ কেন, ও জগোপিসি? ওর তো বে-ই হয়নি’
জগোপিসি গালে হাত দিয়ে বলে ‘ওমা কোথায় যাব গো? বে হয়নি আবার কি?’
‘ ও তো তকন কচি মেয়ে, ঘুমুচ্ছিল। তুলে ছাদনাতলায় নে গেল। মন্ত্র কিচু শোনেও নি, পড়েও নি। আর পড়লেও মানে কি বুজেচে বল দিকি? সমোসকিতো তো সেইদিন মাত্তর পড়তে শুরু করল। কনে জানল না, বুজল না, এ আবার কেমন বে হল বল দিকি?’
জগোপিসি হাঁ হয়ে যায় শুনে। এমন কথা সে বাপের জন্মে শোনেনি। তাকেও তো ঘুম থেকে তুলে কোলে করে ছাদনাতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল , বিয়ের মন্ত্রের একবর্ণ তো সেও বোঝেনি, সেটা কি তাবলে বিয়েই নয়? তাহলে এই যে আলোচাল খাচ্ছে, সাদা থান পরে ঘুরছে, এর কোন মানে নেই নাকি?
জয়াবতী আর পুণ্যিকে আসতে দেখেই জগোপিসি মুখ ঘুরিয়ে নিল। ঠাকুমা কিন্তু আদর করে ওদের পাশে বসতে বলল, সেনখুড়িমা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মিস্টি হাসল। জয়াবতী বলল ‘ও খুড়িমা, একানে তো শুধু মেয়েরা মেয়েরা আচি, ঘুমটা খুলে ফেলেন না কেন?’
অমনি পুণ্যি তাকে এক চিমটি দিয়ে ফিসফিস করে বলল
‘ পণ্ডিতি সব সময়, চুপ করে বস দিকি’
বসতেই ঠাকুমা ওকে বলল ‘মা গো, আমি নয় চোকে কম দেকি, তুই ভালো করে দেক দিকি মানিক, ঠাকুর মশাই আজ চামর দোলালই না, তারপর ছোট গোপালের বেশও বদলাল না, আজ ভারি আনমনা দেখছি’
সত্যি বলতে কি ঠাকুর দেবতা তেমন টানে না জয়াবতীকে, এখানে আসে শুধু সেনমশাইয়ের বকুনি খাবার ভয়ে। আর এসে মন পড়ে থাকে লুচি মোহনভোগের দিকে। ঠাকুমার কথায় সে ভালো করে ঠাকুরমশাইয়ের দিকে তাকাল, আর অমনি সে চমকে গেল। এ তো সেই ঠাকুরমশাইই নয়, যদিও চট করে কেউ বুঝবে না। একই চেহারা, একই রঙ, কিন্তু ঠাকুরমশাইয়ের গলার কাছে একটা কাটা দাগ আছে, ওটা নাকি একটা বাঘের নখের দাগ, দূর গ্রামে পুজো সেরে সন্ধেবেলা ফেরার সময় বাঘের কবলে পড়েছিলেন একবার। কিন্তু সেই দাগটা কই? সে ফিসফিস করে পুণ্যিকে জিজেস করে ‘ঠাকুরমশাইয়ের কি কোন যমজ ভাই আছে নাকি?’
‘গঙ্গাজল তুই পারিস বটে? সবসময় একটা না একটা সমিস্যে খাড়া করিস । মন দিয়ে আরতি দেখ। গিয়ে পড়া তৈয়ারি করতে হবে’। (ক্রমশ)


বড়োগল্প
দীপাঞ্জন ইন এ স্যুপ
(শেষ পর্ব)
তপশ্রী পাল

(৪)
বেজিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বেশ বড়োসরো। নেমেই তো দীপাঞ্জনের প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কতো টার্মিনাল, কতো লেভেল, কতো ওয়াক-ওয়ে, কতো লিফট! আর সাইনেজে প্রায় সব চাইনীজ ভাষা। কোনরকমে দু একটি ইংরিজী এখানে ওখানে। প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে বেরিয়ে, একটা ট্যাক্সি নেবে ভাবলো। কিন্তু বোঝাবে কি করে সিনহুয়া ইউনিভার্সিটি যেতে চায়? শেষে ব্রোশিয়োরটা বার করে দেখালো দীপাঞ্জন। এখানে সবাই বিনয়ের অবতার। কথায় কথায় চোখ পিটপিট করে মাথায় ঝাঁকায় যেনো কত কি বুঝে গেছে। ড্রাইভার কি বুঝলো কে জানে, ভীষন বেগে জিজ্ঞাসা করলো “জিয়াং ইয়ো বা জিয়াং জুয়ো?” কী জিজ্ঞাসা করছে রে বাবা? দীপাঞ্জন তো কতো কিছু মুখস্ত করে এসেছে! কই চেনা কোন শব্দ মনে হচ্ছে না তো! দীপাঞ্জন মাথা চুলকোতে চুলকোতে ইংলিশ টু চাইনীজখানা খুলে পাতা উল্টোতে লাগলো মরিয়া হয়ে! গাড়ী এক জায়গায় নট নড়ন চড়ন অথচ মিটার বেড়ে চলেছে! যখন ওর প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা তখন মাথা তুলে ও অবাক! ড্রাইভার সামনের ড্যাশবোর্ডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা একটা! ওখানে কিছুদিন থাকার পর দীপাঞ্জন ক্রমে আবিষ্কার করেছিলো যে চীনে ছোট দিবানিদ্রা দেওয়া সবার জাতীয় অধিকার। অফিসে, বাসে, বাড়িতে, ক্লাসরুমে, যে যেখানে আছে সবাই প্রচন্ড ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে ঠিক দুপুর বারোটা বাজলেই আর একটা বেজেছে কি লাঞ্চের পর সবাই কোথাও একটা মাথা রেখে অন্ততঃ আধ ঘন্টা ঘুমিয়ে নেয়। অতএব ড্রাইভারের ঘুম আর অগত্যা আধটি ঘন্টা গাড়ীর মধ্যে বসে রইলো দীপাঞ্জন। হঠাত তাকিয়ে দেখে ড্রাইভার কখন জেগে উঠে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে দু হাত নাড়িয়ে বললো “জিয়াং ইয়ো বা জিয়াং জুয়ো?” এবার দীপাঞ্জনের মনে হলো “ডানদিকে না বাঁ দিকে” এরকম কিছু একটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। হে ভগবান! তার মানে ড্রাইভারটা চেনে না! এবার? ওমা! স্মার্ট ড্রাইভার ততক্ষণে ওর হাত থেকে ব্রোশিয়োরটা নিয়ে নিজেই নেমে পড়েছে গাড়ী থেকে আর একে তাকে ওটা দেখিয়ে উদ্ধার করে নিয়েছে জায়গাটা। অতঃপর গাড়ী চলতে শুরু করলো। অনেক বেশী গাড়ীভাড়া দিয়ে দীপাঞ্জন প্রথমেই বুঝলো কী বিপদে সে পড়তে চলেছে।   
অতএব ইউনিভার্সিটির পড়ার আগেই পড়ি কি মরি করে দীপাঞ্জন সেই ইংলিশ টু চাইনীজ বই প্রায় মুখস্ত করে ফেললো। তবে এই রক্ষে যে ইউনিভার্সিটিতে কয়েকজন প্রোফেসর ভাঙা ভাঙা ইংরিজী বোঝেন ও বলেন। কিছু বিদেশী ছাত্রও ইংরাজী বলে । এছাড়া যেদিকে তাকাও শুধু ম্যান্ডারিন! আর সেই চ্যাং ব্যাং অক্ষরমালা। অন্যরা বুঝলো কিনা তাতে এদের কিচ্ছু যায় আসে না। 
দীপাঞ্জন ভাবলো যাক গে, ফিজিক্সে তো বেশীরভাগ ইংরিজী বই, লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়বে। ভাষা না হয় একটু কষ্টসৃষ্ট করে চালিয়ে নেবে কিন্তু আহা! চাইনীজ খাবার তো পাওয়া যাবে! যাকে বলে আসল চাইনীজ! প্রথম কয়েকদিন মায়ের পাঠানো ড্রাই খাবার দিয়ে চালিয়েছে দীপাঞ্জন। অনেক আশা নিয়ে একদিন কলেজ ক্যান্টিনে দুপুরে খেতে গেলো।  বুফে লাগানো রয়েছে একটি বড়ো জায়গায়। অনেক ছাত্ররা ভীড় করে আছে। প্রথমেই স্যুপ! দীপাঞ্জন বাটি নিয়ে এগিয়ে গেলো। মস্ত বড়ো হাতা ডুবিয়ে তুলে আনলো টলটলে খানিকটা জলে ভাসমান গোল গোল চোখ সমেত দুটি চিংড়ি মাছ, কটি আস্ত খোলস যুক্ত শামুক, গেঁড়ি ও গুগলী! সঙ্গে দু একটি ছোট ছোট চামড়া যুক্ত পায়ের টুকরো! অনেকটা টিকটিকির পায়ের মতো! প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়তে পড়তে ঝপাস করে বাটিশুদ্ধ আবার স্যুপের কলসীতে পুরোটা ঢেলে দিলো দীপাঞ্জন, অথচ তার সামনে দিয়ে লাইন দিয়ে এই স্যুপ নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে চোখ পিটপিট করতে করতে খাচ্ছে চাইনীজ ছেলেমেয়েরা! ওর মুখের অবস্থা দেখে বোধহয় দয়া হলো একটি চাইনীজ ছেলের । সে এসে বললো “ইউ অ্যান”। দীপাঞ্জন বুঝলো, এর মানে “শুভ দিপ্রহর!” ও কলের পুতুলের মতো বললো “ইউ অ্যান”। ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো “ইন ডুও রেন?” অর্থাৎ “ইন্ডিয়ান?” ঘাড় ঝাকালো দীপাঞ্জন। ছেলেটি হলুদ দাঁত বার করে হেসে মাথা ঝাকাতে ঝাঁকাতে ওকে একটা বুফে পাত্রের সামনে নিয়ে গেলো, বললো “চি চি” অর্থাৎ “খাও খাও!” ঢাকা খুলে দীপাঞ্জন দেখে ভাত। যাক একটা কিছু পাওয়া গেছে খাওয়ার! এক হাতা তুলে নিলো দীপাঞ্জন। পাতে নিয়ে দেখে গলা গলা চটচটে এক বস্তু! তবু তাই সই! কিন্তু সঙ্গে কী খাওয়া যায়? সবগুলো ঢাকনা তুলে নানা অচেনা জিনিস পেলো দীপাঞ্জন। তার মধ্যে জেলি ফিশের স্যালাড আছে, টুকরো টুকরো অক্টোপাস মিট আছে, আছে স্নেক মিট! এগুলো খাবার! প্রায় বমি এসে যাচ্ছিলো দীপাঞ্জনের! এমন সময় একটা পাত্রের সামনে দেখলো লেখা আছে “ঝা জি” অর্থাৎ ভাজা চিকেন! উতসাহের সঙ্গে ঢাকা তুলে কোনদিকে না তাকিয়ে বেশ কয়েক টুকরো তুলে নিলো দীপাঞ্জন। ঐ চাইনীজ ছেলেটির পাশে চেয়ার টেনে বসলো। ছেলেটি দুটি কাঠি দিয়ে তুলে তুলে একমনে খাবার খেয়ে চলেছে। দীপাঞ্জনের থালাতেও দুটি কাঠি। দীপাঞ্জন শত চেষ্টাতেও এর ফাঁকে দু কুচি ভাতও তুলতে না পেরে হাত লাগালো। চিকেন ভাজাটি উল্টোতেই দীপাঞ্জনের চোখ বিস্ফারিত! আস্ত পাঁচটি বড়ো বড়ো নখশুদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে আছে একটি ঝলসানো চিকেনের পা! থালার পাশে সরিয়ে দিলো সেই ভয়ঙ্কর ভাজা চিকেন! অবশেষে নুন দিয়ে গলা ভাত খেতে লাগলো দীপাঞ্জন!  কোনরকমে গিলে ঢকঢক করে জল খেতে গিয়ে দেখে ঈষদুষ্ণ জলে কটি পাতা আর জেসমিন ফুল ভাসছে! অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। পাশের চাইনীজ ছেলেটি অত্যন্ত অবিশ্বাসের চোখে বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললো “ঝংগুও কাই হেন ব্যাং! চি!” দীপাঞ্জনের চাইনীজ বিদ্যায় কুলোলো না। সে শুধু ছলছল চোখে চিঁ চিঁ করে বললো “চি না! চি না!” অর্থাৎ “খাব না খাব না”। ওর বাংলা আর চাইনীজ গুলিয়ে গেছিলো কিনা। 
সেদিন দীপাঞ্জন হোস্টেলে ফিরেই বই খুলে দেখলো “ঝংগুও কাই হেন ব্যাং!” মানে “চাইনীজ ফুড ইজ গ্রেট!”। তারপর মুনিয়াকে হোয়াটস অ্যাপ করলো “ঝংগুও কাই হেন ব্যাং! চাইনীজ ফুড ইজ গ্রেট। ইউ কাম ফাস্ট!”। শেষে মাকে ফোন করে বললো “আই অ্যাম ইন এ স্যুপ মা! এ বিগ বাউল অফ স্যুপ! আমার চাইনীজ খাওয়ার শখ মিটে গেছে! কালই বাবাকে বলে একটা ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করো!”     
(শেষ)


আনন্দ আর আলোর স্কুলে
গৌতম বাড়ই


ইশকুল পিসফুল নারকোলী বনকুল 
গেঁদাফুল পলাশের সরস্বতী বন্দনা।
শুরু হল সব্বার লেখাপড়া আরাধনা 
আর নয় ফের ফিরে করোনা বা হানা।
ঘরে বসে একঘেয়ে ঝপ্পাস ক্লাসপাশ
ধুসধুস ঐ ভাবে পড়াশোনা ছাইপাঁশ।
ইশকুলে ঘাসমাঠে হাঁটু যদি না ছড়ে
ঘরে বসে অনলাইন শুধুই যাব পড়ে?
একঘেয়ে সেইসব ফেলে দিয়ে মুক্তি
করোনার ইতি হোক আর হোক সমাপ্তি।
বোরড্ ছিল বাবা-মার  প্রতিদিন একমুখ
বন্ধুদের পেয়ে গিয়ে কেটেছে মন অসুখ। 
ক্লাসরুমে ডেস্কবোর্ড বন্ধু যে সব তারা'ও
সেইক্লাসে এসে বলি এসেছি আমরা'ও।
ছেড়েছিলাম যে ক্লাস সে ক্লাসে বসিনি
ঠিকঠাক দু-বছর স্কুলেই তো আসিনি।
তাই বলি কী মজা প্রাণ পেল ভেতরে
বন্ধুদের পেয়ে গিয়ে মজা কত হাজারে।
মুখেতে মাস্ক পড়ে কিছু নিয়ম থাক না
ভাইরাস সেজেগুজে ধরতেও পারবে না।


বাঁদর খেলা
সুহেনা মন্ডল
চতুর্থ শ্রেণী, জি ডি গোয়েঙ্কা পাবলিক স্কুল
দক্ষিণেশ্বর, নর্থ কোলকাতা

তা তা থৈ থৈ নাচে
তিন বাঁদরে মিলে
সবাই এসে হাজির
মাছেরাও নিজের ঝিলে।

লোকজনেরা ঘিরে 
দেখছে বাঁদর খেলা
সকাল থেকে দুপুর
দুপুর থেকে সন্ধেবেলা।

রিন্টু পিন্টু মিন্টু
তিন বাঁদরে জমবে খেলা
কেউ মারছে ডিগবাজি
তো কেউ বাজাচ্ছে থালা।

মাঘুড়পাড়া জুড়ে
বাঁদরের তালে তালে
ছোট থেকে বড়রাও
 কথা তাদের মেনে চলে।

বাঁদরগুলোর মধ্যে
কেউ সাজে টগর
কেউ আবার টিকি লাগিয়ে
হয়ে যায় বিদ্যাসাগর।

সন্ধেবেলা হলেই তারা
মুছে ফেলে সাজ
তারপর শুরু করে দেয়
নিজের নিজের কাজ।


স্মরণীয়
(ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

৬মার্চ ১৮১২ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার কাঁচড়াপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত। তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দাস ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক এবং মাতা ছিলেন শ্রীমতী দেবী। তিনি তাঁর পৈতৃক পদবী পরিবর্তন করে গুপ্ত রাখেন। মাত্র দশ বছর বয়সে মা পরলোকগমন করলে তিনি জোড়াসাঁকোর মামাবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। মাতৃবিয়োগ ও অমনোযোগিতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি কিন্তু দুরন্ত মেধা ও স্মৃতিশক্তির জোরে নিজ চেষ্টায় বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ও বেদান্তদর্শনে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন।
    ১৮৩১সালের বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ও ঐবছর ২৮ জানুয়ারী প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। ১৮৩২এ তিনি সংবাদ রত্নাবলী পত্রিকার সম্পাদক হন। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সংবাদ প্রভাকর পুনরায় ১৮৩৬ এ চালু হয় এবং তিনিই আবার দায়িত্ব নেন। তিনি এটিকে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক করে দেন ১৮৩৯সালের ১৪জুন। ১৮৪৬ এ তিনি সাপ্তাহিক পাষন্ড পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরের বছর তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা ও অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
     প্রথমদিকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রক্ষনশীল সমাজের সমর্থক হিসেবে নব্যবঙ্গ আন্দোলন ও হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতির বিরোধী ছিলেন। পরবর্তী কালে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তিনি নিজেকে প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি প্রথমদিকে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরবর্তীতে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে, ধর্মসভার বিরোধীতায়, দেশের বানিজ্য ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগমনে এবং দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উদার ও মুক্তমনের পরিচয় দিয়েছিলেন। বিধবা বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।
     ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি তাঁর সমকালীন বিষয়ে সাহিত্য রচনা করলেও তাঁর ভাষা,ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগ ছিল মধ্যযুগীয়। তিনি আশ্চর্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ছোট ছোট ব্যঙ্গকবিতা রচনায়। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক জটিল বিষয়কেও সহজভাবে প্রকাশ করা ছিল তাঁর কৌশল। এই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভঙ্গিটি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়াল দের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন সাহিত্যের জগতে স্বদেশী। তিনি তাঁর রচনায় ইংরেজি বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ব্যবহারে তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর 'বোধেন্দুবিকাশ'(১৮৬০) নাটকে। তিনি ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধু গুপ্ত, হারু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করেছিলেন। এমন বহু গঠনমূলক কাজ তিনি করেছিলেন যা তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিকদের জন্য একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল। তাঁর কাব্যরীতি পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে অনুসৃত না হলেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কাব্যরচনায় 'যমক'(একই বর্ণসমষ্টিকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিকবার প্রয়োগ) অলঙ্কার খুবই বেশি লক্ষিত হয়, যেমন- 'আনা দরে আনা যায় কত আনারস', এখানে 'আনা' প্রথমে মূল্য অর্থে ও দ্বিতীয়বারে আনয়ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দেবমাহাত্ম্য বিষয়ক কবিতা থেকে সরে এসে তিনি তাঁর রচনায় নিয়ে এসেছিলেন একদম সাধারণ থেকে অতিসাধারণ চাক্ষুষ বিষয়বস্তু, যেমন-পাঁঠা, আনারস, তোপসে মাছ প্রভৃতি। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছিল সামাজিক, রাজনৈতিক সমসাময়িক ঘটনাবলী এবং তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেই বিষয়ের বর্ণনা। তিনি কবিয়াল দের আখড়া থেকে বাংলা কবিতাকে নিয়ে এসেছিলেন মার্জিত ও রুচিশীল অবস্থায়। মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের শুরুর সন্ধিক্ষণে কাব্য সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এই কবিকে বঙ্কিমচন্দ্র ''খাঁটি বাঙালি কবি" বলে চিহ্নিত করেছেন। রামপ্রসাদ সেন কৃত কালীকীর্তন(১৮৩৩), কবিবর ভারতচন্দ্র রায় ও তার জীবনবৃত্তান্ত (১৮৫৫), প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮)। তাঁর মৃত্যুর পর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কীর্তি হল রামচন্দ্র গুপ্ত সংগৃহীত কবিতার সংকলন (১৮৬২), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসংগ্রহ(১৮৮৫), কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত সংগ্রহ (১৮৯৯), মণিকৃষ্ণ গুপ্ত সম্পাদিত সংগ্রহ (১৯০১)  ইত্যাদি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
     এই ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর কবি ও সাংবাদিক ২৩শে জানুয়ারী ১৮৫৯ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই
(পাখিদের কাছে)
পর্ব ২
কলমে - বাসবদত্তা কদম

পরিযারী পাখি বা মাইগ্রেটরি বার্ড সে তোমরা যে নামেই তাদের ডাকো না কেন; আমার এদের দেখলেই মনে হয়ে ট্রান্সফারেবল জব করছে পুরো দলটা। পার্থক্য কী আর আছে বল? আমাদের চাকরি বদল হলে, আমাদের বোঁচকা বাঁধতে হয়। ট্রেনে বা প্লেনে চড়তে হয়, ওদের এই দুটো কাজ করতে হয় না। ঠিক কথা; কিন্তু হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এসে গাছ খুঁজে বাসা বানাতে হয়। তারপর খাবার জোগাড়। ডিম ফুটে ছোট্ট পাখি বের হলে তাদের বড় করে আবার ডানায় ভর করে শীতের সেই দেশে ফেরৎ যাওয়া।
এরা যখন পাড়ি জমায় ঠান্ডা থেকে বাঁচতে, তা মূলতঃ দুটো জিনিস নির্ভর হয়। 
এক খাদ্য, আর দুই বাসস্থান। 
অর্থাৎ কিনা যে অঞ্চলে এরা বসবাস করবে সেখানকার জলে প্রচুর মাছ, শামুক, গুগলি এবং অন্যান্য পোকা আছে কি না। 
দুই জায়গার উষ্ণতা। যা খুব গরম নয় এবং খুব ঠান্ডা নয়। যেখানে ডিম ফুটে ছোট্ট ছানা পাখিরা খাবার খেয়ে সহজেই ছানা পাখি থেকে সাবালক পাখি হয়ে উঠতে পারে।
আমি ছোট থেকে এদের জানতাম শীতের পাখি নামে। আমাদের শীত, তার রোদ এদের কাছে উষ্ণ, আরামদায়ক। এ শীতে বরফ পড়েনা। অল্পদিন আগে বর্ষা ঋতু শেষ হবার ফলে, প্রচুর সহজলভ্য খাদ্য থাকে। শীতে ঝড় বৃষ্টি কম হয় তা’ও পাখিদের কাছে খুব জরুরী; এদের বাসায় রাখা ডিম এবং ছোট্ট ছানাদের রক্ষা করবার জন্য।
আমার ছোটবেলায় দেখেছি কলকাতা চিড়িয়াখানার বিশাল পুকুরে আর হাওড়া স্টেশনের কাছে সাঁতরাগাছির বিলে বা ঝিলে প্রচুর পাখি আসে প্রতিবছর শীত পড়তে না পড়তে। আবার শীত ফুরিয়ে গরম পড়ার আগেই সেই বিল ফাঁকা। উষ্ণতা, খাদ্য এবং নিরাপদ জলাভূমির খোঁজে আমাদের দেশের তামিলনাড়ু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, পশ্চিমবাংলা এই সমস্ত রাজ্যে আমাদের শীতকালে এই সমস্ত পরিযায়ী পাখিদের সমাগম হয়।
শীত ফুরোবার আগেই প্রায় সব পাখি উড়ে যেত। বাবা বলতেন -দেখ ওরা ফিরে গেছে সবাই ওদের নিজেদের দেশে। 
ছোট্ট আমি বাবার মুখে শুনে দেখতে পেতাম পাহাড়, সমুদ্র,  কত নাম না জানা গ্রাম, শহর পেরিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ওরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের দেশে। আবার সামনের বছর আসবে ফিরে। শুধু মনে ভাবতাম, এত যে অচেনা রাস্তা ওরা পেরোয় সেটা মনে রাখে কিভাবে?
প্রথম কথা যা, তা হল ওদের সহজাত প্রবৃত্তি। পক্ষী বিশারদরা বলেন পাখিরা প্রতিবছর, প্রায় এক নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে চলে। তার একটু এদিক ওদিক হতে পারে, কিন্তু খুব বেশি না। তাদের শরীরে জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়েও এটাই জানা গেছে। এর বেশি আজ এখন যেটুকু জানা যায়, তা হল- পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝে নিজেদের গতিপথ ঠিক করে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অতি বিশাল। পাখিদের মস্তিস্কে এমন কিছু রাসায়নিক বস্তু বা কেমিক্যাল আছে যার দ্বারা তারা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝে তাদের গতিপথ ঠিক করতে পারে। হয়ত ভবিষ্যতের গবেষণা আরো অনেক কিছু জানাবে। 
পাখি নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁদের আমরা জানি পক্ষীবিদ বলে। জুলজি বা প্রাণীবিদ্যার যে অংশ নিয়ে এনারা কাজ করেন  তাকে বলা হয় অর্নিথোলজি বা পক্ষীবিজ্ঞান। এঁদের বলা হয় পক্ষীবিজ্ঞানী বা পক্ষীবিদ। সালেম আলি এবং অজয় হোমের নাম নিশ্চয়ই তোমরা সবাই জানো। প্রাচীন এই পক্ষীবিদরা আমাদের দেশের গর্ব। দিনের পর দিন পাখিদের চিনতে জানতে এঁরা জঙ্গলে দিন কাটিয়েছেন। শুধু তাই নয়; 
সালেম আলি পাখিদের নিয়ে অজস্র বই লিখে গেছেন। তিনি আমাদের পাখিদের জীবন, খাদ্য, অভ্যাস সম্পর্কে জানিয়েছেন। এরকম আরো অনেকেই আছেন, এখন পক্ষীবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কাজ করা মানুষের সংখ্যা প্রচুর। সালেম আলি জন্মেছিলেন ১৮৯৬ – মৃত্যু ১৯৮৭।
সালেম আলির নামের সঙ্গে আরেকটি নাম না বললে অপরাধ করা হবে, তিনি অজয় হোম জন্ম ১৯১৩ – মৃত্যু ১৯৯২। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলের পাখিদের ওপর গবেষণা করেছেন তিনি। অজয় হোম পরিচিত ছিলেন ‘বার্ডম্যান অফ বেঙ্গল’ নামে। তাঁর বিখ্যাত বই ‘বাংলার পাখি’ র জন্য তিনি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলার পাখি ছাড়াও ‘চেনা অচেনা পাখি’ বইটিও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। 
অজয় হোমের বইয়ের প্রচ্ছদ কে এঁকেছিলেন জানো? সত্যজিৎ রায়! আমি জানি তোমরা সবাই তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত। সত্যজিৎ এক সময় বেশ কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। সে গল্প পরে কখনো হবে। 
আমি সালেম আলি এবং অজয় হোমের নাম কেন করলাম তা নিশ্চয়ই তোমরা সবাই বুঝতে পেরেছ; আজ থেকে অত অত দিন আগে পাখি নিয়ে কাজ করার মানুষ খুব কম ছিলেন। পাখিদের চেনা, জানা, আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতিতে তাদের কি প্রভাব এইসব জানতে যে আগ্রহটা আজ আমাদের কেন তোমাদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে; সেই আগ্রহের বীজ বুনে দেওয়াটা একটা বিরাট কাজ। সেটা ওনারা করেছিলেন। কি ঠিক বললাম তো? 
ভারতবর্ষের যে শহরে এখন থাকি তার নাম চেন্নাই। রাজ্যের নাম তামিলনাড়ু। চেন্নাই বেশ গরম জায়গা। কোস্ট লাইন সব থেকে লম্বা। চেন্নাই শহরের এক দিকে বঙ্গোপসাগর। আর সেই সমুদ্রের জল স্থলভাগে ঢুকে সৃষ্টি করেছে অজস্র ব্যাক ওয়াটারের লেক বা খাঁড়ি। এই খাঁড়িগুলোতে জন্মায় প্রচুর মাছ আর জলের পোকা। তার লোভে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি উড়ে আসে এই খাঁড়িগুলোতে। ভেদানথাঙ্গল বার্ড স্যাঙচুয়ারি, মুত্থুকুড়ু লেক, পাল্লিকারণি মার্স ল্যান্ড, পন্ডিচেরী যাবার রাস্তায় মুথুকাড়ু অঞ্চল, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রের মধ্যে অবস্থিত সুবিশাল পুলিকট লেক। এই সমস্ত অঞ্চলে কি প্রচুর পাখি আমি দেখেছি সে বলে বোঝানো সত্যিই খুব মুসকিল। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের সারস, বিশাল বিশাল ইয়া মোটা ঠোঁটওয়ালা সাদা রঙের পেলিকন। কালো ডানার স্টিল্ট, রুডিসেল ডাক বা হাঁস, পানকৌড়ি, অনেক রকম মাছরাঙা। আরো অজস্র ছোট সব পাখি যাদের অনেকের নামই হয়ত আমি জানিনা।
এদের কারুর কারুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। যাদের ছবি তুলতে পেরেছি তাদের ছবি তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। এক এক করে বিভিন্ন পখিরালয় বা পাখিদের বাসভূমির কথা শুনব, জানব। প্রথম শুরু করছি ভেদানথাঙ্গল কে দিয়ে...
যে সমস্ত অঞ্চলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি উড়ে আসে মধ্যে তামিলনাড়ুর ভেদানথাঙ্গল অন্যতম।  এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে আছে এই ভেদানথাঙ্গল। ভেদানথাঙ্গল পখিরালয় বা বার্ড স্যাঙচুয়ারী।
চেন্নাইয়ের পাশের জেলা চেঙ্গালপটুতে অবস্থিত এই পখিরালয় ভেদান্থাঙ্গল। চেন্নাই শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় আশি কিলোমিটার। এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই বার্ড সাংচুয়ারী বা পখিরালয়। ৭৪ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে এই এলাকা বিস্তৃত। গত প্রায় একশো বছর ধরে পাখিরা এই অঞ্চলে আসছে ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর। কিন্তু কেন পাখিগুলো নিশ্চিন্তে আসে ঘুরে ঘুরে, বার বার? (ক্রমশঃ)

পাঠপ্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৭২ পড়ে বেথুয়াডহরীর নন্দিতা_রায় যা লিখলেন) 
            
পত্রিকার নিয়মিত পাঠক না হলেও পত্রিজলদর্চিকাটি আমার কাছে প্রিয় ।শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন বিচ্ছিন্ন ছিলাম এই পত্রিকাটি থেকে। পত্রিকার সম্পাদিকা মৌসুমীদি বরাবরই অসাধারণ লিখেন । তাঁর লেখার স্নিগ্ধতায় খুঁজে পাই আমি অদ্ভুত একটা আনন্দ। 
    তৃষ্ণাদির ধারাবাহিক উপন্যাস "জয়াবতীর জয়যাত্রা" দুটি পর্ব পড়ে আমার ভালো লেগেছে ।পরিবেশ স চেতনা নিয়ে যে বার্তা তিনি দিয়েছেন তা অতুলনীয়। সবথেকে ভালো লেগেছে জমিদারকে চিঠি লেখাটা, কারণ উপর মহলে লোকেরা না বললে তো সাধারন প্রজারা পরিষ্কার করতে পারবে না।
তপশ্রী পাল এর লেখা "দীপাঞ্জন ইন এ স্যুপ "গল্পে বাস্তব সমাজের একটি দিক পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। সত্যিই এখনকার দিনে ছেলেরা শুধু বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য পাগল।!  আরে বাপু দেশে কি কিছুই নেই? এত কলেজ ,এত ইনস্টিটিউট তবে কিসের জন্য? সেখানে কি মানুষ  মানুষ হচ্ছে না?চাকরি পাচ্ছে না?
বিনোদ মন্ডলের লেখা "দেয়ালা"কবিতাটি বারকয়েক পড়লাম ,কিন্তু বুঝে উঠতে পারলাম না,কার উদ্দেশ্যে লেখা,বন্ধু না মা ।যাই হোক যার উদ্দেশ্যে হোক মন্দ লাগেনি।
 দশম শ্রেণীর ছাত্রী সমাদৃতা রায় এর মাতৃভাষা নিয়ে লেখা কবিতাটি ভালো লিখেছে ।সত্যিই নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা আমাকে মনমুগ্ধ করেছে। তোমার মত সবাই যেন নিজের মাতৃভাষা কে ভালবাসতে পারে।
স্মরণীয় "কালীপ্রসন্ন সিংহ "মহাশয় এর ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য জানলাম এবং তিনি যে সমাজের জন্য এত কিছু করেছেন তা আমার অজানা ছিল! তিনি সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভাগবত গীতা আমাদের উপহার দিয়েছেন। সব বাঙালি সংস্কৃত জানে না, বাংলাটা কিছুটা হলেও জানে। তাই এই বইগুলো বাংলাতে হওয়ায় সবাই পড়তে পারছে এবং ধর্মের বিষয়ে জানতে পারছে।
"চলো যাই "গল্পে বাসবদত্তা কদম পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে খুব সুন্দর লিখেছেন এছাড়াও কচিকাঁচারা অসাধারণ ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে। তবুও কোথাও যেন কিছুর কমতি অনুভব করলাম ।"ছোটবেলা" পত্রিকা আমি পড়ে থাকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কবিতা গল্পগুলি পড়বার জন্য। আশাকরি ,সম্পাদিকা মহাশয় আমাদের মত পাঠিকাদের জন্য কচিকাচাদের লেখাগুলি বেশি করে রাখবেন পত্রিকায়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম নতুন কোন অধ্যায় নিয়ে আসার ।ভালো থাকুক পত্রিকার সাথে থাকা সকল কারিগর ,ভালো থাকুক সকল পাঠক- পাঠিকা।


আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments