জ্বলদর্চি

ল্যাটিন আমেরিকা (মেক্সিকো)-র লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—৭৫  

ল্যাটিন আমেরিকা (মেক্সিকো)-র লোকগল্প

চিন্ময় দাশ 

খরগোশের বাড়ি চাঁদের বুকে 


(পূর্ণিমার রাতে আকাশে যখন থালার মত গোল চাঁদ ওঠে, একটা ধূসর ছবি দেখা যায় চাঁদের বুকে। মা-ঠাকুমারা বলেন, এক বুড়ি থাকে ওখানে। তার নাম-- চরকাবুড়ি। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে কিন্তু ভিন্ন গল্প শোনা যায়। তাঁরা বলেন, ওটা আসলে একটা খরগোশ। হাসতে হাসতে ফেটে যেতে বসা নিজের পেট চেপে ধরে, বসে আছে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে। তারই একটা গল্প আজ শুনব আমরা।)

এক বুড়োবুড়ি বাস করে একটা কুঁড়েঘরে। অভাবী মানুষ। কোনও রকমে দিন গুজরান হয় তাদের। নিজেদের পেট চলে না ভালো করে। তার উপর দুটি পোষ্য আছে তাদের। একটা খরগোশ, আর একটা জাগুয়ার ( দক্ষিণ আমেরিকার বিড়াল জাতীয় বড় আকারের মাংসাশী জন্তু)। যতদিন গতর ছিল মানুষটির, পোষ্যদের খাবার যোগান দিতে অসুবিধা ছিল না কোনও। চারজনের পেট ভরানো এখন দুর্বল শরীরে আর পেরে ওঠা যাচ্ছে না। তারপর দেখতে দেখতে এমন দিন এলো, যখন নিজেদের পেট ভরানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়াল।

একদিন সত্যি সত্যিই সংকটে পড়ে গেল দুজনে। শরীরে জুত নাই বলে, কুড়ুল নিয়ে বেরোতে পারল না বুড়ো। এদিকে দানাটিও নাই ঘরে। কড়াই চড়বে না উনুনে। অনেক ভেবেও, কোন উপায়ই করা গেল না।

এক সময় বুড়ি বলল-- এক কাজ করা যাক বরং। খরগোশটাকে জবাই করা যাক। ভালো স্যুপ বানানো যাবে। আজ রাতটা কেটে যাবে।

বুড়ো কিন্তু কিন্তু করে বলল-- এতদিন ঘরে আছে জীবটা। আজ মেরে ফেলব?

বুড়ি বলল-- সেকথা ঠিক। কিন্তু ওকেও তো খেতে দিতে পারছি না আমরা। ও বেচারারও কষ্ট ঘুচে যাবে। তুমি আর না কোর না। আমি জল চাপাচ্ছি।

এদিকে হয়েছে কী, কথাগুলো শুনতে পেয়েছে জাগুয়ারটা। সে ফিসফিস করে খরগোশকে বলল-- শুনতে পাচ্ছ, বন্ধু? ভারী বিপদ তোমার সামনে। তোমাকে জবাই করবে বুড়ো।

খরগোশও শুনেছে সব। সবই কানে গেছে তার। ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছে। কিন্তু মুখে বলল-- না বন্ধু, তাই হয় নাকি? 

-- হয় কি, বন্ধু? হতে আর দেরি নাই। জল চাপিয়ে দিয়েছে উনুনে। 

খরগোশ বলল-- তুমি জানো না। জলখাবারের চকোলেট বানাবে ওরা। বিশ্বাস না হয় তো, আমার খাঁচাটায় এসো। নিজের চোখে দেখতে পাবে। শুধু তাই নয়, প্রথম চকলেটটা তোমাকেই দেবে ওরা। দেখে নিও।

ক'দিন ভালো করে খাবার জুটছে না। চকোলেটের নাম শুনে জিভে জল চলে এল জাগুয়ারের। সে চুপি চুপি খরগোশের খাঁচায় এসে ঢুকে পড়ল।

ছোট্টটি হলে কী হবে, খরগোশ ভারী বুদ্ধিমান জীব। সে মনে মনে ফন্দি এঁটে, এই কাজ করেছে। যেই জাগুয়ার খাঁচায় ঢুকেছে, অমনি সুড়ুৎ করে বাইরে বেরিয়ে এল। খাঁচার হুড়কো টেনে দিয়ে, কুঁড়ে ছেড়েই পালিয়ে গেল।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও, কেমন ভাবনা হোল জাগুয়ারের। না চকোলেট নিয়ে বুড়োবুড়ি এলো, না দেখা গেল খরগোশকে। তখন হুঁশ ফিরল বেচারার। পুঁচকে ব্যাটা তাকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে সরে পড়েছে। এখন বুড়োর চাকু তার গলাতেই না বসে।

এক গুঁতোয় খাঁচার আগল ভেঙে ছুট লাগালো জাগুয়ার। পালিয়ে বাঁচল বিপদ থেকে।

পালাতে পালাতে জাগুয়ার ভাবল, খরগোশ ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে আজ। বিপদের মুখে যে বন্ধুকে ধোঁকা দিয়ে সরে পড়ে, সে অধমকে ক্ষমা করতে নাই।

কতক্ষণ দৌড়ে দৌড়ে, এক সময় খরগোশকে দেখতে পেল জাগুয়ার। চুনা পাথরের খাদানে ছোট্ট গুহার মত একটা খোঁদল। তার মুখটাতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে পুঁচকেটা। ভয়ানক গলায় চেঁচিয়ে উঠল জাগুয়ার-- এবার কোথায় পালাবি, হতভাগা? বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পেতেই হবে। চিবিয়ে খাবো আজ তোকে।

একটুও ঘাবড়ালো না খরগোশ। যেন আকাশ থেকে পড়েছে, এমন বিস্ময় গলায় ঢেলে বলল-- কাকে কী বলছো, ভাই? 

-- কাকে আবার বলবো? এ তল্লাটে আর আছেটা কে, তুই ছাড়া? 

-- আমি? আমি আবার কী বিশ্বাসঘাতকতা করলাম তোমার সাথে? আজ এত বছর এখানে বাসা করে আছি। তোমাকেই তো এ তল্লাটে দেখিনি কোনদিন? তাহলে আমার উপর তোমার রাগের কারণটা কিসের? তাছাড়া, আমি বলে মরছি নিজের জ্বালায়, তুমি এসে উদয় হলে, ঝামেলা পাকাতে। দেখতে পাচ্ছ না, ঘরের দেওয়াল ভেঙে পড়ছে আমার? একা লোক, কী যে করি এখন!

জাগুয়ার তো ঘাবড়ে গেল। তাহলে এ কি অন্য কেউ? সত্যিই তো, বুড়োর খরগোশ হলে, এখানে ঘরবাড়ি থাকবে কেন তার? গলা নরম করে বলল-- ভুল হয়ে গেছে, ভাই। অন্য একজনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছি তোমাকে। মাপ করে দাও আমাকে। তা, তোমার সমস্যাটা কী হয়েছে?

খরগোশ বুঝে গেল, ফাঁড়া কাটানো গেছে। বুদ্ধু বনে গেছে ব্যাটা। সে বলল-- আর বোল নাগো। কতকাল এখানে ডেরা করে আছি। ক'দিন হোল, কতগুলো হতভাগা লোক এসে, এখানেই পাথর খুঁড়তে লেগেছে। কেন রে বাপু, দুনিয়ায় আর চুনা পাথর পাওয়া গেল না? এখানটাতেই আসতে হোল তোদের? একার হাতে এখন আমি কী করি বলো তো? বাসাটা তো বাঁচাতে হবে। 

জাগুয়ারের ভারী মায়া হোল। দু'পা এগিয়ে বলল-- আমি কি তোমার কোন কাজে লাগতে পারি? বলতে পারো আমাকে।

খরগোশ যেন ভারী খুশি। আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে, এমন গলা করে বলল-- তাহলে তো বেঁচে যাই। এই দিকের দেওয়ালটা ভেঙে পড়তে পারে। এই তো শরীর আমার! আমি কি আর ঠেকাতে পারি একে? তুমি যদি একটু ঠেস দিয়ে ধরে থাকো কিছুক্ষণ, ঘরটা বেঁচে যায় এ যাত্রা। যা মজবুত আর বাঁধানো শরীর তোমার! 

প্রশংসা শুনে জাগুয়ার ভারী খুশি। ফুরফুরে গলায় বলল-- এ আর এমন কী কথা? কারোও বিপদে সাহায্য করা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার, ভাই।

খরগোশ আহ্লাদের গলায় বলল-- বেশি সময় লাগবে না। বলতে কী, আমি যাবো, আর আসবো। একটা খুঁটি-মুটি যা পাই, এনে ঠেস লাগিয়ে দেব। তোমার ছুটি হয়ে যাবে।

জাগুয়ার হাসিমুখে গিয়ে একটা ঝুঁকে থাকা পাথরে গা ঠেকিয়ে দাঁড়াল। 

বড় জোর বাঁচা গেছে। খরগোশ লাফাতে লাফাতে সরে পড়ল সেখান থেকে।

কত সময় কেটে গেল এইভাবে। জাগুয়ার দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে। খরগোশের ফিরে আসবার নামটি নাই। বিরক্ত হয়ে, পরখ করে দেখল, পাথরটাও তো কই পড়ে যাচ্ছে না। অমনি মাথার ভিতর চিড়িক করে উঠল তার-- তাহলে, এটা তো সেই হতভাগা। আবার বোকা বানিয়ে দিয়েছে।

এবার আর রেহাই নাই। দৌড় শুরু করল জাগুয়ার। কতক্ষণ দৌড়ে দেখতে পেল খরগোশকে। এক চাষীর আঙ্গুর মাচার মাথায় উঠে বসেছে। টপাটপ আঙ্গুর তুলছে আর মুখে পুরছে।

মাচার একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে যখন, জাগুয়ারকে চোখে পড়ে গেল খরগোশের। ভয় লাগবে কি, বোকাটাকে দেখেই কেমন হাসি পেয়ে গেল তার। হাসি বলে হাসি। আঙ্গুর খেয়ে পেট ভরা। তার উপর হাসি। পেট যেন ফেটে যাওয়ার জোগাড়। অগত্যা দু'হাত (নিজের সামনের দুটো পা) দিয়ে পেট চেপে ধরল খরগোশ, সত্যি সত্যি ফেটে না যায়, এই ভয়ে। 

এমনিতেই রাগে মাথা গরম হয়ে ছিল জাগুয়ারের। তার উপর এখন ব্যাটাকে হাসতে দেখে, আগুন জ্বলে গেল মাথায়। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে, দিল এক লাফ। খরগোশ বসেছিল এক দিকে, জাগুয়ার লাফিয়ে গিয়ে পড়ল মাচার অন্য মাথাটায়। আর, তাতেই ঘটে গেল ঘটনাটা।

জাগুয়ারের ভারী দেহটা যেই একদিকে এসে পড়ল, অমনি অন্য দিকটা ঢেঁকির মত উঠে গেল উপর দিকে। আর খরগোশ? সে আর বলবার নয়। হালকা দেহ পুঁচকে জীবটার।  দু'হাতে নিজের পেট আঁকড়ে ধরা ছিল বেচারার। কিছু বুঝে উঠবার আগেই, ছিটকে উঠে গেল আকাশে। 

উঠে গেল, কিন্তু নামল না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তখন। থালার মত, পূর্ণিমার গোল চাঁদ দেখা দিয়েছে পুব আকাশে। খরগোশের পলকা শরীর। বাতাস কেটে কেটে, ভাসতে ভাসতে একেবারে গিয়ে পড়ল চাঁদের ওপর। 

সেই থেকে চাঁদের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে খরগোশটা। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকালেই বেশ দেখা যায়-- একটা খরগোশ বসে আছে চাঁদের বুকে। হাসি চাপতে, নিজের পেটটি চেপে ধরে আছে দুটি হাত দিয়ে। তবে, নিচে পৃথিবীর দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে খরগোশটা। কী দেখে সে? রসে টইটুম্বুর আঙুরের মাচা, না কি, বোকা-হাঁদা জাগুয়ারটাকে? 

জানা আছে কারও?


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments