জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ-৯/শুভঙ্কর দাস


মাটিমাখা মহাপ্রাণ। নয়

শুভঙ্কর দাস 

"যে আনন্দে মাটির ধরা হাসে
অধীর হয়ে তরুলতায় ঘাসে
যে আনন্দে দুই পাগলের মতো
জীবন-মরণ বেড়ায় ভুবন ঘুরে"

পড়াশোনার মধ্যে এমন একটি আলোর পথ খুঁজে পেয়েছে কুমার,তার পড়াশোনার বাইরে কোনো কাজ ভালো লাগে না। সে মনেপ্রাণে জানে,এই পড়াশোনার ভেতর একদিন সে জীবনের সত্যিকারের পথরেখা সন্ধান পাবে। তাই গাঁয়ের পাঠশালার পড়া সব শেষ হয়ে যেতে সে খুব অসহায় পড়ল,মনে মনে এই ভাব এলো,গাঁ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে,যেখানে পড়াশোনার জন্য অসংখ্য দ্বার উন্মুক্ত পাবে। নিজের পড়াশোনা বন্ধ হলেও, সে গৃহস্বামীর গৃহের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে চলল,আবার গরু চরানোও বন্ধ করল না।
তার একটি সহজ কারণ আছে।
গৃহস্বামীর গৃহে শুধু ছেলেমেয়েদের পড়ানো নয়, সেই সঙ্গে গৃহের অন্যান্য নানা কাজ করতে হতো,সংসারের ফাই-ফরমাস তামিল করতে হতো। তাই সেভাবে অবসর বলে কিছুই ছিল না! কিন্তু গরু চরানোর সময় গরুগুলিকে মাঠে মুক্তভাবে চরতে রেখে কুমার একটি ছায়াময় গাছের নিচে পড়াশোনা করত।
দূর থেকে দেখলে মনে হত,এ যেন সেই তপোবনের একটি খণ্ড দৃশ্য। সেখানে ছিল অপরূপ সবুজ গাছগাছালির সৌন্দর্য, এখানে মাঠের পর মাঠে রোদ-মেঘের লুকোচুরি খেলা।
তার মধ্যে একজন একলব্যের মতো সেই রোদ-মেঘকে গুরু কল্পনা করে পড়াশোনা করে চলছে।
কিন্তু একই বই পড়ে আর কতদিন চলে? কুমারের হাতে তো কয়েকটি বই,গীতা,কৃত্তিবাসী রামায়ণ, মহাভারত এবং একটি উপন্যাসের কয়েকটি পাতা, তাও কারো পুরো পৃষ্ঠা নেই, কারো শরীর উইপোকায় কাটা।তবুও তার ভেতর থেকে আলোময় জগত দেখতে পেত কুমার।
আবার একদিন মাঠে দেখা হল ফকির আব্দুলের সঙ্গে। লোকটি বড় অদ্ভুত। এই আছে,গাঁয়ের সকলের সঙ্গে ঘুরছে-ফিরছে, চণ্ডীমণ্ডপে রাত কাটাচ্ছে, সকাল হলে এমনভাবে গাঁয়ের লোকজনের সঙ্গে মিশে যেত,যেন মনে এই লোকটি কোনোদিন এই গাঁ ছেড়ে কোথাও যায়নি!
অথচ ঠিক এক-দুদিন পরেই সকলে আবিষ্কার করত,সেই ফকির আব্দুল নিখোঁজ, গাঁয়ের চতুর্সীমানায় তাকে দেখা যেত না!
এই ভবঘুরে লোককে কুমারের খুব ভালো লাগে। কেমন বাঁধনহীন এক মুক্ত আকাশের পাখি। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে,কতকিছু দেখতে পারে,কত নদ-নদী-গাছপালা দেখতে পায়!

কী বইকুমার?  কেমন আছো গো?

ধু ধু মাঠের মধ্যে সহসা এমন কণ্ঠ শুনে কুমার একটু চমকে ওঠে।
সে একাগ্র চিত্তে বই পড়ছিল। মুখ তুলে দেখল,রোদকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে ফকির আব্দুল। 

এই তো, তুমি কেমন আছো? 

আমি তো খারাপ থাকি না,আমি ভালোও থাকি না,আমি ভালো-খারাপের উর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করি গো জানার পো

এই হল আর এক ফকিরি পাগলামি।এমন কথা বলবে,কেউ বুঝতে পারবে না!
এই ধরণের কথা কুমার ঠিক বুঝতে পারে না।তবে শুনতে খুব ভালো লাগে।

তা একটা গান শোনাও

হা,হা,আরে গোঁসাই, গান তো তোমাকে শোনাবো বলেই সেই ভিন গাঁ ছেড়ে এখানে আসি

আমাকে! বিস্মিত হয়ে যায় কুমার।

হা গো হা,আমি তো মানুষরতন খুঁজি গো,সোনার হৃদয়গড়া মানুষরতন, তারপর ফকির স্বগোতক্তির মতো বলে ওঠে,এই বাসুদেবপুর গাঁয়ে একজনা আছে...

কে গো? ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল কুমার।

মৃদু হেসে ফকির বললে, সে রহস্যি ভাঙার সময় এখনও আসেনি,সময় এলেই বলব

দোর বাবা, কিছুই বুঝতে পাারি না,আচ্ছা ছাড়, একটা লালন সাঁইয়ের গান হোক না ফকির 

না গো,এই সময় চলছে আগুনের সময়,এখনো নিজেকে খাপখোলা তলোয়ার করার সময়, শোনো তার বদলে এই গান---

"মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের 
তার বেশী আর সাধ্য নাই..."

এমন গান প্রথমবার শুনল কুমার।আহ্ এ কি গান,এ কি দরদভরা ভাষা, একেবারে বুকের মধ্যে ঢুকে যায়। তার চোখে জল এসে গেল।

আব্দুল ফকির গান শেষ করে কুমারের চোখে জল দেখে মৃদু হেসে উঠল,মনে মনে বলল,এই মানুষরতন জাগছে... আর এখানে থাকার দরকার নেই! 

একটু ধাতস্থ হয়ে, কুমার চোখের জল মুছে ফেলল,সে কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করতে গেল,আচ্ছা, এমন গান কে...? 

কিন্তু প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ফকির তার একতারাটি দিগন্তের গায়ে ঠেকিয়ে চলে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ, আর ভেসে আসছে,মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় /মাথায় তুলে...
সহসা যেন কুমার চোখ খুলে গেল! এতদিন সে জানত, এই বাসুদেবপুর গ্রামের মধ্যে গোটা পৃথিবী। এর বাইরে আর কিছুই নেই বা যা আছে,তা এই গ্রামেই আছে। কিন্তু আজ মনে হল,ঐ যে ফকির চলে যাচ্ছে, হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে, আর সেই দিকে তাকিয়ে থেকে কুমারের ভুবন বড় হয়ে যাচ্ছে...  সে অনুভব করল,তার গাঁয়ের বাইরেও বৃহৎ জগত আছে,যেখান থেকে সে ডাক পাচ্ছে, কেউ যেন তাকে ডেকেই চলে যাচ্ছে, সে যেতে পারছে না,সে যেতে পারছে না!
কিন্তু এই গান কার লেখা?
এ কী শুনিয়ে গেল ফকির।
কুমারের মন টানাপোড়েনে মধ্যে পড়ে এক অবাক বিস্ময়ে হারিয়ে গেল! 

সেইসময় একদিন গরু চরিয়ে সন্ধ্যাবেলায় ফিরে জানল,গৃহস্বামী গিরিশচন্দ্র ডেকে পাঠিয়েছে।
কুমারের মন অস্থির। 
সেই আশ্চর্য গান কুমারের কানে বেজেই চলেছে,তাহলে এই সময় আগুনের! কিন্তু কীসের আগুন?
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়? মা কে? তাঁর সাধ্য নেই কেন?
একথা ভাবতে কুমারের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল।খুব ইচ্ছে হল,মায়ের কাছে ফিরে যায়!কতদিন মাকে দেখেনি! পাশেই তো নিজের গ্রাম..

আরে এতে কি তুমি রাজি আছো?
কুমার, কুমার শুনতে পাচ্ছো আমার কথা! গৃহস্বামী জিজ্ঞেস করলেন। 
এবার বেশ উঁচু স্বরে। 
কুমার এতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল।সে গৃহস্বামীর নিকট কখন এসেছে!  কী শুনছে! কিছুই জানে না।
সহসা যেন ঘোর ভাঙল।কুমার বলে উঠল,মার কাছে যাবো...

গৃহস্বামী গিরিশচন্দ্র একটু বিরক্ত হয়েছিলেন,কিন্তু কুমারের মায়ের কাছে যাওয়ার কাতরতা দেখে মনটা নরম হল। 
হা,হা,অবশ্যই যাবে,তা যাওয়ার আগে একটা ভালো খবর শুনে নিলে,মাকে গিয়ে জানাতে পারবে।

কুমার অবাক হল।
কী খরব?

তুমি কাল থেকে আমার ঘরে শুধু পড়াবে না,বিদ্যালয়েও পড়াবে।অর্থাৎ কাল থেকে বিদ্যালয়ের মাস্টার হয়ে গেলে।কি খুশি তো?

আনন্দে হেসে ফেলল কুমার।
বিদ্যালয়ে পড়াবে,তাহলে আর তাকে গরু চরানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়তে হবে না,সে বিদ্যালয়ে ক্লাসের মাঝে পড়াশোনা করতে পারবে এবং বিদ্যালয়ে নানারকম বইপত্রও পাবে।কী ভালো,এমন খবর মা পেলে খুব খুশি হবেন।

তাহলে আসি,বলেই কুমার চলে যাচ্ছিল..

আরে আরে শোনো,তোমার বেতন হবে পাঁচ টাকা

আচ্ছা বলেই কুমার দৌড় দিল নিজের গ্রামের দিকে, তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।

গিরিশচন্দ্র অবাক হয়ে দেখলেন।টাকা-পয়সার কোনো আগ্রহ নেই, বই পড়তে পাবে, পড়াতে পারবে,তাতেই মন খুশি ভরপুর।এমন ছেলে কেউ দেখেছে! 

একজন গোচারক শুধু পড়াশোনার জোরে গুরুমশাই হয়ে গেলেন।
যেসময় কুমার হাতে বই নিয়ে ক্লাসে পড়াচ্ছে,সেই ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্যপথে চালিত হচ্ছে। সময়দেবীর সুতোয় টান দিলে দেখা যাবে, কুমার যখন প্রদীপ জ্বেলে গীতার মর্মার্থ বুঝতে স্থির,ঠিক সময় মজফফরপুরে অন্ধকারে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে কুমারের সমবয়সী দুর্গাপ্রসাদ সেন ও দীনেশচন্দ্র রায়।
তাদের উদ্দেশ্য অত্যাচারী জেলা ম্যাজিস্টেট কিংসফোর্ডকে হত্যা।তাদের হাতে রয়েছে বই,আসলে বইয়ের পাতার ভেতর লুকানো তাজা বোমা।
আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই  ছদ্মনামধারী দুর্গাপ্রসাদের আসল নাম ক্ষুদিরাম।যার জন্ম মেদিনীপুরে হাবিবপুর গ্রামে।অপরজন দীনেশচন্দ্র রায়, তার আসল নাম প্রফুল্ল চাকী। এরা সব বিখ্যাত স্বদেশী হেমচন্দ্র কানুনগোর অনুগামী। এই প্রফুল্লচন্দ্র শুধু বোম ছোঁড়ার খেলা খেলতে নামেনি,এই বয়সে সে সচেতন হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে চলেছে। একবার ইংরেজ ছোটলাট স্যার ফ্রেজারকে হত্যা করতে চেষ্টা করে প্রফুল্ল।কিন্তু যথাসময়ে গুলি না বেরানোয় ফ্রেজার বেঁচে যান।তখন ফ্রেজার সাহস ভরে প্রফুল্লকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,কেন তাকে হত্যা করতে চায়?
তখন প্রফুল্ল দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলো,আমি বাঙালি জাতিকে দেখাতে চাইছিলাম যে ছোটলাট অজেয় নয়"
এই দুজন আবার সম্মুখ সমরে।এবার লক্ষ্য কিংসফোর্ড। তাঁকে শেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত তাদের শান্তি নেই। 
সত্যি শান্তি নেই। 
কারণ এই ফ্রেজার বা কিংসফোর্ড ভারতীয় মানুষকে মানুষ তো জ্ঞানই করে না,বরং তাদের কোনো বন্য পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট প্রাণী বলে মনে করে। এঁদের অত্যাচারে ও শাসনে বাঙালি জাতির জীবন ভয়ংকর অন্ধকার খাদের কিনারে ঠেকেছে, তার থেকে মুক্তির জন্য বার বার অনুরোধ, প্রতিবাদ এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু তাতে অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে বই কমেনি!তখন এই সব অল্প বয়সী বালক হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। 
শুধু কি এদেশে?
না, সেই সুদূর ইংল্যান্ডের কেন্দ্রে লণ্ডনে এই বিপ্লবের আগুনে বাতাস পৌঁছে গেছে। সেখানে এক ডাক্তারের ছেলে,যে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, লণ্ডনে পড়াশোনা করে রীতিমতো চমকে দিয়েছে,সেই ছেলে একদিন হাতে পেল একটি বই,নাম,'পভার্টি অফ ইণ্ডিয়া'। লিখেছেন দাদাভাই নওরোজি।এই বই ছেলেটিকে বদলে দিল।সে মনেপ্রাণে হয়ে উঠল,দেশপ্রেমিক।এবং এতখানিই দেশপ্রেমের তীব্রতা, যে,তার জন্য সে নিজেকে বলিদান পর্যন্ত করতে পারে।এমনই মনোভাব নিয়ে একদিন লণ্ডনে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হল,নাম ছিল,মদনলাল ধিংড়া। সেখানে সে ইংরেজদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বকে জাগ্রত করতে অস্ত্র তুলে নেয়। জাঁকজমক অনুষ্ঠানে মদনলাল কার্জন উইলিকে গুলি করে নিহত করে। এবং তা কোনো মিথ্যে আবেগ বা মগজধোলাইের ফলশ্রুতি নয়, তা অতি সচেতনভাবে দেশকে ভালোবেসে করা।তাই ফাঁসির পূর্বে মদনলাল বলে গেছিল,"The only lesson reguired in India, at present, it’s to learn how to die and only way to teach it is by dying ourselves.Therefore, l did and glory in my own matyrdom"( এই মুহূর্তে ভারতের যে অত্যাবশ্যকীয় পাঠ দরকার,সেটি হল মরে যাওয়ার শিক্ষা এবং এটি শিক্ষা দেওয়ার একমাত্র উপায়,নিজেদের মৃত্যুর মাধ্যমে তুলে ধরা।তাই আমি মৃত্যুবরণ করছি আমাদের গরিমা আর শহীদতত্ত্বের জন্য। ")
এইভাবে একটা দেশের স্নায়ুসন্ধি উত্তপ্ত ও উর্বর হচ্ছে, আস্তে আস্তে সাহসের সীমারেখা অলৌকিক হয়ে যাচ্ছে, সেই সময় বাসুদেবপুর গ্রামের একজন নতুন এক ভুবনের সন্ধান করছে,বইয়ের মধ্যে, ধুলোর মধ্যে, মানুষের মধ্যে... 

ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments