জ্বলদর্চি

গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি - এক অন্য নারীর অন্য মর্মকথা/রাকেশ সিংহ দেব



গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি - এক অন্য নারীর অন্য মর্মকথা

রাকেশ সিংহ দেব

পরিচালক - সঞ্জয় লীলা বনশালী। 
অভিনয় - আলিয়া ভাট,বিজয় রাজ,জিম শোরাব, সীমা পাওয়া,অজয় দেবগন।
মুক্তি - ২৫ ফেব্রুয়ারি,  ২০২২। মুভি থিয়েটার।

রেটিং - 4/5

১৯৫০ থেকে ৬০ এর দশকে মুম্বইয়ের (তখনকার বম্বে) ঝাঁ চক চকে দুনিয়ার থেকে আলাদা একটা জায়াগা দক্ষিণ মুম্বইের যৌনপল্লী কামাঠিপুরা। সেই যৌনপল্লীর সর্দারনী গঙ্গুবাঈ। যদিও মুম্বাই পুলিশের কাছে তার অন্য পরিচয়, এক মাফিয়া ক্যুইন। কীভাবে গুজরাতের এক গ্রামের মেয়ে হয়ে উঠল কামাঠিপুরার ম্যাডামজি? কেন ও কীভাবে মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব খবর ছিল তার নখদর্পনে? মুম্বই আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ে লেখক এস হুসেন জাইদির বই 'মাফিয়া কুইনস অফ মুম্বই' -এ গঙ্গুবাঈ এর জন্য বরাদ্দ করেছিলেন একটি চ্যাপটার। সেই কাহিনি এবার পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনশালী নিয়ে এসেছেন রূপালি পর্দায়।  
ছবির গল্প শুরু হচ্ছে স্বাধীনতার কিছু বছর পর। মুম্বই তখন বম্বে। সিনেমার চুম্বকে এখনকার মতই তখনও কত স্বপ্ন রোজ বম্বেগামী। কাথিয়াওয়াড়ের ব্যারিস্টারের মেয়ে গঙ্গা হরজীবনদাসও স্বপ্ন দেখে সে নায়িকা হবে। অভিনয় করবে দেবানন্দের সঙ্গে। গঙ্গার এই স্বপ্নকে ইন্ধন দেয় তার প্রেমিক রমনিক লাল। সে গঙ্গাকে বোঝায়, স্বপ্ন সত্যি করতে হলে বম্বে যেতে হবে। স্বপ্নপূরণের টানে রমনিকের হাত ধরে গয়না, টাকা-পয়সা নিয়ে বাড়ি ছাড়ে গঙ্গা। ট্রেনে চেপে এসে পৌঁছোয় মায়ানগরীতে। তারপর গন্তব্য রমনিকের মাসির বাড়ি। কিন্তু মাসির বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই মনটা কেমন করে ওঠে গঙ্গার। এক ছুটে যেতে চায় রমনিকের কাছে। কিন্তু কোথায় রমনিক? রমনিকের সেই মাসি যেন গঙ্গার নিয়তি সাজে নিষ্ঠুর হাসি হাসে। গঙ্গা জানতে পারে রমনিক তাকে বিক্রি করে দিয়েছে নিষিদ্ধপল্লি কামাঠিপুরায়। এরপর নিয়তির নিয়মেই কাহিনী এগোয়। নিষিদ্ধপল্লির আলো আঁধারি চোরাগলিতে  গঙ্গার মৃত্যু হয়, জন্ম নেয় গঙ্গুবাঈ।

মুভিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে গঙ্গুর জীবনের পট পরিবর্তন পর্দায় তুলে ধরেছেন সঞ্জয় লীলা বনশালী তা দেখার মতো। যদি গল্প বলার ধরণ  বেশ স্লথ। তবে দর্শকদের মনযোগ আকর্ষণ করে এই ছবির চাচাছোঁলা সংলাপ। সঞ্জয় লীলা বনশালীর অন্য সব ছবির মতো এই ছবিরও প্রোডাকশন ডিজাইন অতুলনীয়! বনশালীর ভিসুয়াল গ্রামার সবসময়ই প্রশংসার দাবী রাখে। সিনেম্যাটোগ্রাফার সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের ক্যামেরা নিষিদ্ধ পল্লির কর্কশ চেহারাতেও একটা শৈল্পিক ছোঁওয়া দিয়েছে। খুব ভালো লাগে যেভাবে পরিচালক ৫০ দশকের বলিউড ছবির পোস্টার ব্যবহার করেছেন সেই সময় বোঝাতে। 
আলিয়া গঙ্গুর চরিত্রের জন্য নিজেকে ভেঙেছেন।  নিখুঁত শব্দচয়ন, উপভাষার সাবলীল উচ্চারণ , অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন। তার পর্দায় উপস্থিতি অবাক করার মতো। একার কাঁধে পুরো ছবি টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। আলিয়ার চোখ থেকে বলিষ্ঠ শরীরি ভাষা গঙ্গুবাঈয়ের চরিত্রে প্রাণসঞ্চার করেছে। তবে সময়ের সাথে সাথে গঙ্গুবাঈ এর মতো বয়সের ছাপ চোখে পড়েনি আলিয়ার চরিত্রের অবয়বে। মনে হয় তার শিশুসুলভ গ্ল্যামারাস অবয়ব এর জন্য দায়ী। সারা মুভিতে এটুকুই বেশ বিসদৃশ লাগে। আরেক মাফিয়া ডন করিম লালার ভূমিকায় অজয় দেবগনের চরিত্রটি ছোট হলেও দমদার। অনবদ্য অভিনয় করেছেন বিজয় রাজও। রাজিয়া বাঈয়ের চরিত্রে তার অভিনয়ের কোনও তুলনা নেই। তবে মুভি দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে, রাজিয়া আর গঙ্গুর লড়াইটা যেন দানা বেঁধেও বাধল না। ধোঁয়াই উঠল শুধু, আগুন জ্বলল না। সাংবাদিকের ভূমিকায় জিম শোরাবের অভিনয়ও নজরকাড়া। তিনি যেন এখানে গঙ্গুর জীবনের কুরুক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক কৃষ্ণের ভূমিকা নিয়েছেন। একটি গানের দৃশ্যে দেখা যায় হুমা কুরেশিকে। তবে সঞ্জয়লীলা বনশালীর এই মুভিতে গানের ব্যবহারে নতুনত্ব নেই কোথাও। 

অনেক অপরাধ, বিতর্ক, অনিয়মের মোড়কে মোড়া গঙ্গুবাই আদতে এক বৈপ্লবিক চরিত্র। নিষিদ্ধপল্লির কলঙ্কের কালোতে গঙ্গু হারিয়ে যায়নি। সে নারীর অধিকার নিয়ে সরব হয়েছে। সে তার পেশার অধিকার নিয়ে সরব হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে প্রশ্ন করেছে। গঙ্গুর বুদ্ধিমত্তার সামনে নতজানু হয়েছে প্রবল পৌরুষও। নিষিদ্ধপল্লির ছোট ছোট মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে সরব হয়েছে। এইভাবে সোচ্চার গঙ্গুর কন্ঠ কামাঠিপুরার নিষিদ্ধপল্লি থেকে পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কানেও। দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে নিজের কথা, নিজের মতো হাজারো মহিলাদের কথা অকুতোভয়ে, নির্দ্বিধায় জানায় গঙ্গু। গঙ্গু দিন বদলের স্বপ্ন দেখে। গঙ্গুর সঙ্গে জেতে তার মতোই অসংখ্য নারী। এক অসহায় মেয়ে গঙ্গা হিসেবে
গঙ্গুবাঈয়ের কামাঠিপুরায় আসা। সেখান থেকে সেখানকার একছত্র রানি থেকে সমাজকর্মী গঙ্গুর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছুঁয়ে গিয়েছেন পরিচালক তবে তার পর মনে হয় যেন অনেক কিছু বলা বাকি রয়ে গেল গঙ্গুরজীবন নিয়ে। এ যেন শেষ হয়েও হইলো না শেষ।

রেটিং

5 - অসাধারণ 
4 - বেশ ভালো 
3 - ভালো 
2 - দেখতে পারেন 
1 - না দেখলেও চলবে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments