জ্বলদর্চি

ব্যাধ - খুন তো খুন-ই, বধ্যভূমিতে চড়াই রূপক মাত্র /রাকেশ সিংহ দেব


ব্যাধ - খুন তো খুন-ই, বধ্যভূমিতে চড়াই রূপক মাত্র

রাকেশ সিংহ দেব

পরিচালক -অভিরূপ ঘোষ
অভিনয় – রজতাভ দত্ত, অনির্বাণ চক্রবর্তী, সৌমন বসু, বিবৃতি চ্যাটার্জী, খরাজ মুখোপাধ্যায় ও অনুসূয়া মজুমদার।
মুক্তি – ১১ ফেব্রুয়ারী,২০২২। হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম 

রেটিং -   4/5
 
‘ব্যাধ’ ওয়েব সিরিজটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই-তে। তবে এই থ্রিলার সিরিজটি দেখার আগে দর্শকদের 'দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন' সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে রাখলে সুবিধা হবে। ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবিষয়ে যা তথ্য পেয়েছি তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরলাম। এই ঘটনাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলে থ্রিলারপ্রেমী দর্শক হিসেবে এই সিরিজের মজা আরও ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন। 

১৯৫৮ সালে গনপ্রজাতন্ত্রী চীনের জনক মাও সে তুং চারটি প্রাণীকে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই তালিকায় ছিল ইঁদুর, মশা, মাছি এবং চড়ুই। বিশেষ করে ফসল রক্ষার নামে ইউরেশিয়ান গেছো চড়ুইকে টার্গেট করে গণহারে শুরু হলো চড়ুই মারা। সেসময় চীনারা তাদের প্রিয় নেতার ভাবনাকে অন্ধ সমর্থন জানিয়ে দেশপ্রেমের টানে দলে দলে চড়ুই নিধন করতে 'দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন' -এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। চড়ুই নিধনের জন্য শব্দকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো। লোকে ড্রাম আর থালা হাতে রাস্তায় নেমে পড়ত, চড়ুই পাখি দেখলেই বাজানো শুরু করতো। প্রবল বাদ্যযন্ত্রের শব্দে ছোট পাখিগুলো ভীত হয়ে পালাতো, কিন্তু চারপাশের ক্রমাগত আওয়াজে একসময় দুর্বল হয়ে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতো ছোট্ট পাখিগুলোর। 'দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন' এ কম বয়সী মানুষদের ঘাড়ে পড়েছিল চড়ুই পাখি ধরা, তাড়া করা, বিষ দিয়ে মারার মতো কাজগুলো। চড়ুই পাখির বাসা নষ্ট করা, ডিম ভেঙে ফেলা, গুলি করা, বন্দী করে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছিল সেই বীভৎস কর্মসূচীর মুখ্য অংশ। চীনাদের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগলো না। ধেয়ে এলো প্রকৃতির নির্মম আঘাত। প্রথমত, শস্য দানার পাশাপাশি চড়ুই পাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়। চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় গানিতিক হারে বেড়ে গেল সেসব পোকামাকড়ের সংখ্যা।  পঙ্গপাল সহ ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে লাগলো ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলস্বরূপ যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হল, সেই শস্য গেল পোকামাকড়ের পেটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, চরম খাদ্য সংকটের মুখে পড়লো দেশের কোটি কোটি মানুষ। ‘দি গ্রেট চাইনিজ ফ্যামিন’ নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে সরকারী হিসাবে প্রাণ হারান প্রায় দেড় কোটি মানুষ। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক হিসাবে অনুমান করা হয় এ সংখ্যা ২ কোটি থেকে ৪ কোটি ৩০ লক্ষের মধ্যে। শেষমেশ চিন সরকার তৎকালীন  সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লাখ চড়ুই আমদানি করতে বাধ্য হয়। এই চড়ুই সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে চীন আস্তে আস্তে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দিতে সক্ষম হয়। 

এই ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র ধরে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ‘চড়াই হত্যা রহস্য’ লেখেন রাজর্ষি দাস ভৌমিক। ওঁনার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র পুলিশ অফিসার কানাইচরণের ‘চড়াই হত্যা রহস্য’  গল্প অবলম্বনে পরিচালক অভিরূপ ঘোষ বানিয়েছেন তাঁর সিরিজ ‘ব্যাধ’। লালবাজারে নতুন ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে – নাম ডিপার্টমেন্ট অফ আনইউসুয়াল কেসেস (অস্বাভাবিক কিছু মামলার নিষ্পত্তি করতে নতুন বিভাগ)। গালভরা নাম হলেও  নতুন ডিপার্টমেন্টটি আসলে একরকম পানিশমেন্ট পোস্টিং। দুর্নিতীতে বাধা দিয়ে সৎ ভাবে ডিউটি করার মূল্য চোকাতে এই ডিপার্টমেন্টে ‘পেইড লিভ’ কাটাতে পাঠানো হয় অফিসারদের। নবাগত অফিসার সৌভিকের আগমনও সেই কারণেই। সিনিয়র অফিসার কানাইচরণের কাছে ডিউটি বুঝে নেওয়ার কথা তার। হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি গ্রাম থেকে শয়ে শয়ে চড়াই পাখি হত্যার খবর আসে। কেউ একজন ফাঁদ পেতে চড়াই ধরে ধারালো অস্ত্রে তাদের নৃশংস ভাবে গলা কেটে  ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই অদ্ভুত কিলিং এর পেছনে খুনীর আসল উদ্দেশ্য কি? সে কি কোনও বার্তা দিতে চায় ? ঘটনাচক্রে কানাইচরণ ও সৌভিক জড়িয়ে পড়ে এই অদ্ভুত সিরিয়াল কিলিংয়ের চক্রব্যূহে।

‘হু ডান ইট’ ফরম্যাটে না বানিয়ে পরিচালক অভিরূপ ঘোষ সিরিজটি ‘হোয়াই ডান ইট’ ফর্মুলায় বানিয়েছেন। সিরিজের ওপেনিং সিনেই দর্শকরা জেনে যায় সিরিয়াল কিলার কে। কিন্তু কেন সে নিরীহ পাখিগুলোকে খুন করছে তারই উত্তর খোঁজা হয়েছে সিরিজ জুড়ে। সিরিজের দৃশ্যায়ন ধূসর রঙে আলো আঁধারি করা হয়েছে। চিত্রগ্রহণের নৈপুণ্য গল্পের মানকে অনেকটা উঠিয়ে দিয়েছে। যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে আবহ সঙ্গীত। দর্শকের ভেতরে গা ছমছমে রহস্য যাতে আরও দানা বাঁধে, তা নিশ্চিত করেছে দুর্দান্ত আবহ। প্রতিটি চরিত্রে অভিনেতা বাছাই অনবদ্য। রজতাভ দত্তকে দেখে মনে হয় কানাইচরণের চরিত্র যেন ওনাকে মাথায় রেখেই লেখা হয়েছিল। এই ছবিতে নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন রজতাভ দত্ত, অনির্বাণ চক্রবর্তী ও  সৌমন বসু। সৌমন পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে বেশ সাবলীল। দুটি ছোট চরিত্রে দাগ কেটে যাবে খরাজ মুখোপাধ্যায় ও অনুসূয়া মজুমদারের অভিনয়। আর ভিলেনের চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী এক কথায় সিন্-স্টিলার। একেনবাবু আর জটায়ুর কমিক ছায়া কাটিয়ে নিজের অভিনয়-ক্ষমতা উজাড় করে দিয়েছেন দর্শকদের জন্য।

কিন্তু, যে কারণে ব্যাধ সিরিজটি দেখা প্রয়োজন তা হল এর অন্তর্নিহিত বার্তা। মানুষের ভাবনাকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্র হিসেবে। একটা চিন্তাধারা বদলে দিতে পারে সমাজ। প্রভাবিত করতে পারে গোটা প্রজন্মকে। শাসকের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তাদের অঙ্গুলিহেলনে যখন সমর্থকরা ঠিক-ভুলের পার্থক্যটা ভুলে উন্মত্ততায় মেতে ওঠে, তখন ঘটে সমূহ বিপর্যয়। ‘খুন তো খুন-ই, তা মানুষ হোক বা চড়াই…, সিরিজের এই সংলাপের উপরই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা গল্পটা। ঠিক যেমন মানুষের সিরিয়াল কিলিং, এই সিরিজে তেমনই চড়াই পাখি খুন। গল্পের নতুনত্বই এই সিরিজকে আলাদা করে রাখে অন্য সব সিরিজ থেকে। আসলে এই সিরিজে গল্পই আসল নায়ক। একটা থ্রিলার গল্পের সঙ্গে যেভাবে পরিচালক প্রকৃতি, পশু-পাখির প্রতি প্রেমকে টেনে নিয়ে এসেছেন, তা সত্যিই বাহবা দেওয়ার মতো। যাঁরা থ্রিলার ভালবাসেন, তাঁরা ‘ব্যাধ’ সিরিজটি একদম মিস করবেন না। 

রেটিং
5 - অসাধারণ 
4 - বেশ ভালো 
3 - ভালো 
2 - দেখতে পারেন
1 - না দেখলেও চলবে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments