জ্বলদর্চি

মহাশিবরাত্রির ব্রত কথা, ইতিহাস ও পূজার মন্ত্র /প্রসূন কাঞ্জিলাল

মহাশিবরাত্রির ব্রত কথা, ইতিহাস ও পূজার মন্ত্র 

প্রসূন কাঞ্জিলাল 

সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল এই মহাশিবরাত্রি। ব্রতের আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ আহার করে। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোয়া হয়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা প্রভৃতি ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। আর  ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ এই মহামন্ত্র জপ করা হয় । সেদিন রাত্রি জাগরণ করা হয় ও শিবের ব্রতকথা, মন্ত্র আরাধণা করা হয়। ভারতবর্ষের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ তথা সমস্ত শিবমন্দিরে এই পূজা চলে, তান্ত্রিকেরাও এইদিন সিদ্ধিলাভের জন্য বিশেষ সাধনা করে। মহাশিবরাত্রি সাধারণত ইংরাজী মাসের ফেব্রুয়ারী বা মার্চ এ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

হিন্দু মহাপুরাণ তথা শিবমহাপুরাণ অনুসারে এইরাত্রেই শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা তান্ডব নৃত্য করেছিলেন । আবার এইরাত্রেই শিব ও পার্বতীর বিবাহ হয়েছিল । এর নিগুঢ় অর্থ হল শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তি বা পরাপ্রকৃতির মিলন। এই মহাশিবরাত্রিতে শিব তার প্রতীক লিঙ্গ তথা শিবলিঙ্গ রূপে প্রকাশিত হয়ে জীবের পাপনাশ ও মুক্তির পথ দিয়েছিলেন।

মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রমন্ত্র :------

"ওঁ ত্র্যম্বকম যজামহে সুগন্ধিমপুষ্টিবর্ধনম।
উর্ভারুকবিভ বন্ধনান্মৃত্যৌমুশীয়মামৃতাত।।"

এই মহা মন্ত্র জপ করলে মহাদেবের কল্যানে সমস্ত রোগ বা ব্যাধিকেই জয় করা যায়। প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যার সময়ে ধ্যান ও যোগব্যায়াম সহকারে এই মন্ত্র ১০৮ - বার পাঠ করলে জীবন থেকে অশান্তি-অসুস্থতা দূরে চলে যায়।

শিবমহাপুরাণ অনুসারে, অতি প্রাচীনকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করত। সে প্রচুর জীবহত্যা করত। একদিন শিকারে বেরিয়ে তার খুব দেরী হওয়ার ফলে সে জঙ্গলে পথ হারিয়ে রাতে হীংস্র জন্তুর ভয়ে এক গাছের উপর আশ্রয় নেয় । কোনো শিকার না পেয়ে সে হতাশ হয়ে গাছ থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে নীচে ফেলতে থাকে । সেই গাছটি ছিল বেলগাছ । আর সেই বেলগাছের নীচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সেদিন ছিল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি। আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। তার ফেলা বেলপাতাগুলো শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে এর ফলে তার শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হয় তার অজান্তেই। পরদিন ব্যাধ বাড়ী ফিরে এলে তার খাবার সে এক অতিথিকে দিয়ে দেয়। এতে তার ব্রতের পারণ ফল লাভ হয়।

এর কিছুদিন পরে সেই ব্যাধ মারা গেলে যমদূতরা তাকে নিতে আসে। কিন্তু শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হেতু শিবদূতরা এসে যুদ্ধ করে যমদূতদের হারিয়ে ব্যাধকে নিয়ে যায়। যমরাজ তখন শিকার করেন যে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে তার উপর যমের কোনো অধিকার থাকেনা। সে মুক্তিলাভ করে। এইভাবে মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রতের প্রচার ঘটে।

মহাশিবরাত্রি অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ তথা সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওঁকারেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমশঙ্কর, বিশ্বেশ্বর, ত্র্যয়ম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর ও ঘুশ্মেশ্বর এ বহু মানুষের সমাগম হয় ও সবার হাতে এই জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা ও পবিত্র স্পর্শলাভ ঘটে। ভারতের পবিত্র ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ এর নাম ও অবস্থান ------

১. সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ-

সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত।  গুজরাট রাজ্যের সৌরাষ্ট এর নিকট প্রভাস ক্ষেত্রে অবস্থিত এই মন্দির অন্যতম উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্লিঙ্গ নামে সারা ভারতে পরিচিত । সারা বিশ্ব ও ভারত জুড়ে অসংখ্য পুণ্যার্থী ও ভক্ত আসেন এই জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন ও পূজা নিবেদন করতে। অতীতে এই শিব মন্দির বারবার বিদেশী শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রায় পাঁচবার বা তার বেশিবার এই মন্দির পুনর্নির্মিত  করা হয়।

২. মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ-

দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের শ্রীশৈলমে অবস্থিত মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ এক প্রসিদ্ধ শিব মন্দির।মন্দিরটি পূর্বমুখী। কেন্দ্রীয় মণ্ডপে অনেকগুলি স্তম্ভ এবং নন্দীকেশ্বরের একটি বিরাট মূর্তি আছে।দক্ষিণ ভারতের সকল হিন্দুদের কাছে এই মন্দির অনেক পবিত্র।সারা বছর ধরে এখানে অনেক অনেক ভক্ত আসেন নিজের মনস্কামনা পূর্ন করতে ও বাবা শিবের লিঙ্গে জল অর্পণ করতে।শিবরাত্রি এই মন্দিরের প্রধান উৎসব।

৩. মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ-

মধ্য প্রদেশের মধ্যে অবস্থিত  মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ অন্যতম শিব মন্দির।এখানে সারা বছর অসংখ্য পুণ্যার্থী আসেন এই মন্দিরে পূজা দিতে।এটিই একমাত্র দক্ষিণমুখী মন্দির। মহাকালেশ্বরের মূর্তিটি  ‘দক্ষিণামূর্তি’।এই শব্দের অর্থ ‘যাঁর মুখ দক্ষিণ দিকে’। এই মূর্তির বিশেষত্ব এই যে” তান্ত্রিক শিবনেত্র “প্রথাটি বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একমাত্র মহাকালেশ্বর মন্দিরে দেখা যায়। ‘ওঙ্কারেশ্বর মহাদেবে’র মূর্তিটি মহাকাল মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরে স্থাপিত। গর্ভগৃহের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিকে যথাক্রমে গনেশ, পার্বতী ও কার্তিকের মূর্তি স্থাপিত আছে।  দক্ষিণ দিকে শিবের বাহন  নন্দীর মূর্তি স্থাপিত আছে।। মন্দিরের তৃতীয় তলে  নাগচন্দ্রেশ্বর মূর্তি আছে। এটি একমাত্র  নাগ পঞ্চমীর দিন দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মন্দিরের পাঁচটি তল আছে। তার মধ্যে একটি ভূগর্ভে অবস্থিত। এছাড়া মন্দিরে একটি বিশাল প্রাঙ্গন রয়েছে। হ্রদের দিকে অবস্থিত এই প্রাঙ্গনটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মন্দিরের শিখর বা চূড়াটি শাস্ত্রে উল্লিখিত পবিত্র বস্ত্র দ্বারা ঢাকা থাকে। ভূগর্ভস্থ কক্ষটির পথটি পিতলের প্রদীপ দ্বারা আলোকিত হয়। মনে করা হয়, দেবতাকে এই কক্ষেই প্রসাদ দেওয়া হয়। এটি মন্দিরের একটি স্বতন্ত্র প্রথা। কারণ, এই রকম প্রথা অন্য কোনো মন্দিরে দেখা যায় নামন্দিরের গর্ভগৃহে যেখানে শিবলিঙ্গটি রয়েছে সেখানে সিলিং-এ একটি  শ্রীযন্ত্র উলটো করে ঝোলানো থাকে।

৪. ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ-

মধ্যপ্রদেশের নর্মদা নদীর একটি দ্বীপে ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ ও মামল্লেশ্বর মন্দির অবস্থিত।মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর স্টেশন থেকে ৭৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ পাঁচতলা মন্দিরের গর্ভগৃহে ছোট্ট শিবলিঙ্গ৷ সামান্য উচ্চতা৷ জাতিধর্ম নির্বিশেষে স্পর্শ করে পূজো দেওয়া যায়৷ সারা বছর ধরেই অনেক পুণ্যার্থী আসেন পূজা দিতে।

৫. কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ-

চারধামের অন্যতম কেদারনাথ।এটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয় পর্বতশ্রেণীতে অবস্থিত।এটি একটি মন্দির শহর ও বটে। এটি  মন্দাকিনী নদীর তীরে স্থাপিত ।এখানকার তীব্র শীতের জন্য মন্দিরটি কেবল এপ্রিল মাসের শেষ থেকে কার্তিক পূর্ণিমা অবধি খোলা থাকে। শীতকালে কেদারনাথ মন্দিরের মূর্তিগুলিকে ছয় মাসের জন্য  উখি মঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল কেদারখণ্ড ; তাই এখানে শিবকে কেদারনাথ (অর্থাৎ, কেদারখণ্ডের অধিপতি) নামে পূজা করা হয়।

৬. ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ-

মহারাষ্ট্রে অবস্থিত অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিবলিঙ্গ মন্দির এটি।ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ ঠিক কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মহারাষ্ট্রের পুনের কাছে একটি ভীমাশঙ্কর মন্দির রয়েছে । এই অঞ্চলটি প্রাচীনকালে ডাকিনী দেশ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের কাশীপুরও প্রাচীনকালে ডাকিনী দেশ নামে পরিচিত ছিল। এখানে মোটেশ্বর মহাদেব নামে একটি ভীমশঙ্কর মন্দির আছে। ভীমশঙ্কর মন্দিরের অন্যান্য দাবিদার মন্দিরগুলি  হল মহারাষ্ট্রের সহ্যাদ্রি, অসমের গুয়াহাটির কাছে ও ওড়িশার গুনুপুরে অবস্থিত।গ্রহের বাঁধা কাটানো ও অকাল মৃত্যু রোধ করার অসংখ্য ভক্ত আসেন এখানে।জঙ্গলের মধ্যে ঘন গ্রানাইট পাথরের তৈরি এই মন্দির।এই মন্দিরের লিঙ্গ মাঝারি  আকারের।

৭. কাশী বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ-

উত্তরপ্রদেশের কাশীতে অবস্থিত  অন্যতম জনপ্রিয় জ্যোতির্লিঙ্গ হল বিশ্বনাথ শিবলিঙ্গ।মন্দিরটি শৈবধর্মের প্রধান কেন্দ্রগুলির অন্যতম। অতীতে বহুবার এই মন্দিরটি বিভিন্ন আক্রমণে  ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের পাশে জ্ঞানবাপী মসজিদ নামে একটি মসজিদ রয়েছে। আদি মন্দিরটি এই মসজিদের জায়গাটিতেই অবস্থিত ছিল।বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে  ইন্ডোরের মহারানি  অহল্যা বাই হোলকর তৈরি করে দেন।মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব।এখানে “বিশ্বনাথ” বা “বিশ্বেশ্বর” নামে পূজিত হয়। বারাণসী শহরের অপর নাম “কাশী” এই কারণে মন্দিরটি “কাশী বিশ্বনাথ মন্দির” নামে পরিচিত। মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে। ১৯৮৩ সাল থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার এই মন্দিরটি পরিচালনা করে আসছেন।হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, গঙ্গায় একটি ডুব দিয়ে এই মন্দির দর্শন করলে মোক্ষ লাভ করা সম্ভব।

৮. ত্র্যম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ-

মহারাষ্ট্রের নাসিকের কাছে গোদাবরী  নদীর উৎসের কাছে অবস্থিত এই জ্যোতির্লিঙ্গ অন্যতম জনপ্রিয় ।এই লিঙ্গমূর্তি তিন ভাগে বিভক্ত এবং অন্য শিবলিঙ্গের চেয়ে আলাদা৷এই মন্দিরের পুননির্মাণ নানাসাহেব ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে করেন।তখন এই মন্দির নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল সেইসময়কার ১৬ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছিল।যা তখনকার হিসেবে অনেক অনেক টাকা।

৯. বৈদনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ-

এই মন্দিরটি  ঝাড়খন্ড রাজ্যের দেওঘর জেলায় দেওঘর শহরে অবস্থিত। অবস্থিত এই মন্দির  খুবই প্রসিদ্ধ।অসংখ্য পুণ্যার্থী সারা বছর ধরেই এখানে আসেন, শিবলিঙ্গে জল ঢালেন ও পূজা দেন।শ্রাবন মাসে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়।বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থানও বিতর্কিত। ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দিরটি জ্যোতির্লিঙ্গ আখ্যাপ্রাপ্ত। এটিই একমাত্র তীর্থ যা একাধারে জ্যোতির্লিঙ্গ ও শক্তিপীঠ। বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যান্য দাবিদার মন্দিরগুলি হল হিমাচল প্রদেশের কাংড়া জেলার বৈজনাথ শিবধাম ।মহারাষ্ট্রের বিড জেলার পারলি বৈজনাথ।

১০. নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ-

এই জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থানও বিতর্কিত। জ্যোতির্লিঙ্গ দাবিদার মন্দিরগুলি হল উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ার কাছে জাগেশ্বর মন্দির।গুজরাতের দ্বারকায় অবস্থিত মন্দির। ও অনেকের মতে এই মন্দির মহারাষ্ট্রের হিঙ্গোলি জেলার অন্ধ নাগনাথে অবস্থিত।তবে সবচেয়ে বেশি লোক মনে করে নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ ভারতের গুজরাট রাজ্যে অবস্থিত।   আর এই মন্দির হিন্দুদের এক অন্যতম ধর্মীয় পীঠস্থান। গুজরাটের জামনগরে অবস্থিত এই মন্দিরের শিবলিঙ্গকে বিশেষ মান্যতা দেওয়া হয়েছে।সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দ্বাদশ জ্যোতির্লিংগের অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যানে এই মন্দির ঐতিহাসিক কাল থেকে ভক্তদের জন্য আকর্ষণের স্থল হয়ে আসছে। শিব উপাসকরা নাগেশ্বর মন্দিরের জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন পরম পবিত্র বলে গণ্য করে।

১১. রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ-

তামিলনাড়ুর রামেশ্বরে অবস্থিত এই  রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ চারধামের মধ্যে অন্যতম ধাম।একে দক্ষিণ ভারতের কাশীও বলা হয়।দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের শেষ প্রান্তভূমি পক প্রণালীতে একটি দ্বীপের আকারে গড়ে উঠেছে রামেশ্বরম। রামেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গটি বিশাল। এই মন্দিরে রামেশ্বর স্তম্ভ অবস্থিত।সারা বছর ধরেই অসংখ্য পুণ্যার্থী এখানে পূজা দিতে আসে।

১২. ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ-

এটি ১২টি  জ্যোতির্লিঙ্গ এর মধ্যে শেষ জ্যোতির্লিঙ্গ।এই মন্দির এটি মহারাষ্ট্র  রাজ্যের আওরাঙ্গাবাদ থেকে ৩০ কিলোমিটার  দূরে এবং দৌলতাবাদ বা দেবগিরি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে  ইলোরা গুহার কাছে অবস্থিত।মন্দিরটি লাল পাথর দিয়ে তৈরি। এতে পাঁচটি চূড়া দেখা যায়। এখনকার মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি। এর গায়ে অনেক হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদিত আছে।

শিবপূজায় শিবলিঙ্গ স্নানার্থে প্রধাণত গঙ্গাজল বা গঙ্গাজল মিশ্রিত জল ব্যবহার করা হয় । আর বেলপাতা দেওয়া হয় তিনটি পাতাযুক্ত একটি যৌগিক পত্রকে । তবে বিশেষ লক্ষ্যণীয়, শিবের পূজার বেলপাতার প্রতিটি যৌগিক পত্রের বৃন্ত বা বোঁটার নীচের একটু মোটা অংশ অবশ্যই ভেঙ্গে বাদ দিয়ে তবে সেই বেলপাতা অর্পণ করা উচিত।

শিব প্রণাম মন্ত্র--

"নমঃ শিবায় শান্তায় কারুণাত্রায় হেতবে
নিবেদিতামি চাত্মানং ত্বং গত্বিং পরমেশ্বরম॥"

সরলার্থ: ----

তিন কারণের (সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের) হেতু শান্ত শিবকে প্রণাম।হে পরমেশ্বর তুমিই পরমগতি। তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করি।

"তস্মৈ নমঃ পরমকারণ কারণায়
দীপ্তোজ্জ্বলজ্জ্বলিত পিঙ্গললোচনায়, 
নাগেন্দ্রহাররকৃত কুন্ডলভূষণায় 
ব্রহ্মেন্দ্রবিষ্ণু বরদায় নমঃ শিবায় ।।"

সরলার্থ: ------

যিনি কারণের পরম কারণ, যাঁর অতি উজ্জ্বল দেদীপ্যমান পিঙ্গল নয়ন, কুন্ডলীকৃত সর্পরাজের হার যাঁর কন্ঠভূষণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং ইন্দ্রাদি দেবতাকে যিনি বর প্রদান করেন, সেই পরম শিবকে আমার প্রণাম ।

👉 সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’এই তিনটি শব্দের মধ্যেই শিব শব্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। শিব ও সত্য পরস্পর এক ও অভিন্ন। তাই শিবরাত্রিতে সত্য জীবন যাপনের জন্য নতুন করে সংকল্প করতে হয়। ঐ সত্যনিষ্ঠা মন বাক্য ও আচরণে সর্বদা যত্নসহকারে পালন করা হলেই পরম সুন্দর শিব-চেতনায় মনটা ভরে ওঠে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন ‘সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়। কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’ কারণ সত্যকে আশ্রয় করে থাকলেই মানবিক গুণগুলি মনকে অবলম্বন করে থাকে। অন্যথায় দয়া‚ মায়া‚ মমতা‚ ধৈর্য‚ সহিষ্ণুতা‚ ভালবাসা‚ ক্ষমা করার ইচ্ছা ইত্যাদি গুণগুলি ক্রমে ক্রমে সরে যায়। শ্রীমা সারদামণি স্বয়ং বলেছেন ‘যে সত্যে আছে সে ভগবানের কোলে শুয়ে আছে।’ 👈

👉 শিবরাত্রি ব্রত শুরুর কথা : :--------

পুরাকালের কথা। তখন কৈলাশ পর্বতের শিখর ছিল সর্বরতে অলংকৃত। ছিল ছায়াসুনিবীড় ফুলে-ফলে শোভিত বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম ঢাকা। পারিজাতসহ অন্যান্য পুষ্পের সুগন্ধে চারদিক থাকত আমোদিত। এখানে সেখানে দল বেঁধে নৃত্য করে বেড়াত অস্পরারা। ধ্বনিত হতো আকাশ গঙ্গার তরঙ্গ-নিনাদ। ব্রহ্মার্ষিদের কন্ঠ থেকে শোনা যেত বেদধ্বনি।

এই কৈলাশশিখরে শিব-পার্বতী বাস করতেন। গন্ধর্ব, সিন্ধ, চারণ প্রভৃতি তাদের সেবা করত। পরম সুখে ছিলেন শিব-পার্বতী। একদা পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করলেন, ভগবান, আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন ?

দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন, দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথীর রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়। এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।

তিনি আরও বলেন, ব্রতপালনকারী ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। স্বপক্ষ নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে (ভূমি বা বালু বিছানো যজ্ঞবেদী) অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার (অর্থাৎ শিবের) নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃ ক্রিয়াদি করবে অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর (যজ্ঞবেদীতে), সরোবরে, প্রতীকে বা প্রতিমায় বিল্বপত্র দিয়ে আমার পূজা করবে। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে আমার যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে কিংবা মণি, মুক্তা, প্রবাল বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করলেও, আমার তার সমান প্রীতি জন্মে না। প্রহরে প্রহরে বিশেষভাবে স্নান করিয়ে আমার পূজা করবে। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বার যথোচিত অর্চনা করবে। প্রথম প্রহরে দুগ্ধ, দ্বিতীয় প্রহরে দধি, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে আমাকে স্নান করাবে এবং পূজা করবে। এছাড়া যথাশক্তি নৃত্যগীতাদি দ্বারা আমার প্রীতি সম্পাদন করবে। 

হে দেবী, এই হলো আমার প্রীতিকর ব্রত। এ ব্রত করলে অপস্যা ও যজ্ঞের পূণ্য লাভ হয় এবং ষোল কলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয়। অভিলাষী ব্যক্তি সপ্তদীপা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়। শিব পার্বতীকে আরও বলেন, এবার শিবচতুদর্শী তিথির মাহাত্ম বলছি, শোন।
একদা সর্বগুণযুক্ত বারাণসী পুরীতে ভয়ঙ্কর এক ব্যাধ বাস করত। বেঁটে-খাটো ছিল তার চেহারা, আর তার গায়ের রং ছিল কালো। চোখ আর চুলের রং ছিল কটা। নিষ্ঠুর ছিল তার আচরণ। ফাঁদ জাল, দড়ির ফাঁস এবং প্রাণী হত্যার নানা রকম হাতিয়ারে পরিপূর্ণ ছিল তার বাড়ি।

একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করল। তারপর নিহত পশুদের মাংসভার নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথে শ্রান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলে শয়ন করলে এবং একটু পরেই নিদ্রিত হলো।

সূর্য অস্ত গেল। এলো ভয়ঙ্কর রাত্রি। ব্যাধ জেগে উঠল। ঘোর অন্ধকারে কোনো কিছুই কারও দৃষ্টিগোচর হলো না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে সে লতা দিয়ে তার মাংসভার বেঁধে রাখল। বৃক্ষতলে হিংশ্র জন্তুর ভয় আছে। এই ভেবে সে নিজেও ঐ বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়ল। শীতে ও ক্ষুধায় তার শরীর কাঁপতে লাগল। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটাল সারা রাত।

দৈববশত সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিল আমার (অর্থাৎ শিবের) একটি প্রতীক। তিথিটি ছিল শিবচতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত্রি কাটিয়েছিল উপবাসে। তার শরীর থেকে আমার প্রতীকের ওপর হিম বা শিশির ঝরে পড়েছিল। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে বিল্বপত্র পড়েছিল আমার প্রতীকের ওপর। এভাবে উপবাসে বিল্বপত্র প্রদানে এবং শিশিরস্নানে নিজের অজান্তেই ব্যাধ শিবরাত্রিব্রত করে ফেলল। দেবী, তিথিমাহাত্মে কেবল বিল্বপত্রে আমার যে প্রীতি হয়েছিল, স্নান, পূজা বা নৈবেদ্যদি দিয়েও সে প্রীতি সম্পাদন সম্ভব নয়। তিথি মাহাত্মে ব্যাধ মহাপূণ্য লাভ করেছিল। পরদিন উজ্জল প্রভাতে ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেল।

কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হলো। যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হলো। অন্যদিকে আমার প্রেরিত দূত ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এল। আর আমার দূতের দ্বারা আহত হয়ে যমদূত যমরাজকে নিয়ে আমার পুরদ্বারে উপস্থিত হলো। দ্বারে শিবের অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন। এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে। জানালেন যম।

তার কথা শুনে নন্দী বললেন, ধর্মরাজ, এতে কোনো সন্দেহই নেই যে ঐ ব্যাধ দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্মে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করে শিবলোকে এসেছে।
নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ। তিনি শিবের মাহাত্মর কথা ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে চলে গেল। শিব পার্বতীকে আরও বলেলেন, এই হলো শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম। শিবের কথা শুনে শিবজায়া হিমালয় কন্যা পার্বতী বিস্মিত হলেন। তিথি শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম্য নিকটজনের কাছে বর্ণনা করলেন। তারা আবার তা ভক্তি ভরে জানালেন পৃথিবীর বিভিন্ন রাজাকে। এভাবে শিবরাত্রিব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হলো। 👈

👉 পুরাণমতে শিবরাত্রির আগের দিন অর্থাৎ ত্রয়োদশী তিথিতে সংযমী থেকে চতুর্দশীতে উপবাস করে পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’ উচ্চারণে ভক্তরা ভক্তি নিবেদন করে। পরে রাতে শিবলিঙ্গকে প্রথম প্রহরে ‘হ্রীং ঈষণায় নমঃ’ মন্ত্রে দুধ দিয়ে‚ দ্বিতীয় প্রহরে ‘হ্রীং অঘোরায় নমঃ’ মন্ত্রে দই দিয়ে‚ তৃতীয় প্রহরে ‘হ্রীং বামদেবায় নমঃ’ মন্ত্রে ঘি দিয়ে এবং চতুর্থ প্রহরে ‘হ্রীং সদ্যোজাতায় নমঃ’ মন্ত্রে মধু দিয়ে স্নান করিয়ে পুজো করতে হয়। 👈

👉 শিবরাত্রি ব্রতের অধিকারী রূপে নারী-পুরুষের কোনও ভেদ না থাকায় যে কোনও নারী বা পুরুষ বাল্যে মধ্যবয়সে অথবা বার্ধক্যে এই ব্রত পালন করতে পারে। আমাদের সমাজে যদিও মেয়েরাই বেশিরভাগ এই ব্রত পালন করে থাকে। কারণ‚শিবের মতো বর পাওয়ার আকাঙ্খা ছোটবেলা থেকেই তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। 👈

👉 প্রসঙ্গত‚ বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। জীবনের মূল্যবোধও লুপ্তপ্রায়। সারা বছর নানারকম উৎসব চলে। কিন্তু উৎসবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কর্মকর্তারা অজ্ঞান। ফলে ভোগসর্বস্বশৃঙ্খলাহীন‚ নিয়মানুবর্তিতাহীন‚ সত্যহীন আচরণেই তারা মেতে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের হাতে সত্য লাঞ্ছিত‚ অবহেলিত। তাই আজকের দিনে ভক্তি ভরে শিবরাত্রি পালন করা প্রয়োজন। শিবের কৃপা লাভ করলেই সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। 👈

👉 শিবপূজার সাধারণ পদ্ধতি ও মন্ত্র : 
ভারতবর্ষে কোন কাল থেকে শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হচ্ছে তা সঠিক বলা যায় না। আধুনিক পাশ্চাত্য প্রভাবও তা খুব একটা কমাতে পারেনি। ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ এই তিনটি শব্দের মধ্যেই শিব শব্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। শিব ও সত্য পরস্পর এক ও অভিন্ন। তাই শিবপূজায় সত্য জীবন যাপনের জন্য সংকল্প করতে হয়। ঐ সত্যনিষ্ঠা মন‚ বাক্য ও আচরণে সর্বদা যতœ সহকারে পালন করা হলেই পরম সুন্দর শিব-চেতনায় মনটা ভরে ওঠে। 👈

👉 শিবপূজার সাধারণ পদ্ধতি এখানে বর্ণিত হল। এই পদ্ধতি অনুসারে প্রতিদিন বা প্রতি সোমবার প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গে শিবের পূজা করতে পারেন। যাঁরা ‘সোমবার ব্রত’ করেন, তাঁরাও এই পদ্ধতি অনুসারে শিবপূজা করে ব্রতকথা পাঠ করতে পারেন। মনে রাখবেন, সাধারণ শিবলিঙ্গ ও বাণেশ্বর শিবলিঙ্গে পূজার মন্ত্র আলাদা। যাঁদের বাড়ীতে বাণেশ্বর আছেন, তাঁরাই বাণেশ্বর মন্ত্রে শিবের পূজা করবেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণ শিবপূজার মন্ত্রেই পূজা করবেন। শিবরাত্রির দিন বিশেষভাবে পূজা করার নিয়ম আছে। সেই পদ্ধতি পরে দেওয়া হবে।

সকালে সূর্যোদয়ের তিন ঘণ্টার মধ্যে পূজা সেরে নেওয়াই উচিত। একান্ত অসমর্থ হলে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেলা বারোটার মধ্যেই পূজা সেরে ফেলা যায়। তার পর সকালের পূজা করা উচিত নয়। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া অন্যেরা কিছু না খেয়েই পূজা করবেন। সকালে স্নান ও আহ্নিক উপাসনা সেরে শিবপূজায় বসবেন। প্রথমে পূজার সামগ্রীগুলি একত্রিত করে গুছিয়ে নিন। প্রতিদিন শিবপূজা করলে অনেক সময় ফুল-বেলপাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে ওই সব উপাচারের নাম ও মন্ত্র উচ্চারণ করে সামান্যার্ঘ্য (জলশুদ্ধি) জল দিয়ে পূজা করলেই চলে। ধূপ ও প্রদীপ জ্বেলে নিন। শিব, শ্রীগুরু ও ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করে তিন জনকে অভিন্ন চিন্তা করতে করতে যথাশক্তি দীক্ষামন্ত্র জপ করবেন। তারপর করজোড়ে এই মন্ত্রটি পাঠ করবে :
ওঁ সর্বমঙ্গলমাঙ্গল্যং বরেণ্যং বরদং শুভম্।
নারায়ণং নমস্কৃত্য সর্বকর্মাণি কারয়েৎ।। 👈

👉 আচমন : ডান হাতের তালু গোকর্ণাকৃতি করে মাষকলাই ডুবতে পারে এই পরিমাণ জল নিয়ে ‘ওঁ বিষ্ণু’ মন্ত্রটি পাঠ করে পান করুন। এইভাবে মোট তিন বার জলপান করে আচমন করার পর হাত জোড় করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন :
ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ
দিবীব চক্ষুরাততম্।

ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোহপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।। 👈

👉 জলশুদ্ধি: তাম্রপাত্রে বা কোশায় গঙ্গাজল বা পরিষ্কার জল নিয়ে মধ্যমা দ্বারা সেই জল স্পর্শ করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন :
ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি।
নর্মদে সিন্ধু-কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু।। 👈

👉 সূর্যমণ্ডল থেকে সকল তীর্থ সেই পার্শ্বস্থ জলে এসে উপস্থিত হয়েছেন এই চিন্তা করতে করতে সেই জলে একটি ফুল দিয়ে তীর্থপূজা করুন। তীর্থপূজার মন্ত্রটি হল :

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে তীর্থেভ্যো নমঃ।

এরপর এই জল সামান্য কুশীতে নিয়ে পূজাদ্রব্যের উপর ও নিজের মাথায় ছিটিয়ে দিন।
আসনশুদ্ধি : যে আসনে বসেছেন, সেই আসনটিতে একটি ফুল দিয়ে হাত জোড় করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন :

ওঁ পৃথ্বি ত্বয়া ধৃতা লোকা দেবি ত্বং বিষ্ণুনা ধৃতা।
ত্বঞ্চ ধারায় মাং নিত্যং পবিত্রং কুরু চাসনম্।। 👈

👉 পুষ্পশুদ্ধি : পুষ্প স্পর্শ করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন :

ওঁ পুষ্পে পুষ্পে মহাপুষ্পে সুপুষ্পে পুষ্পসম্ভবে।
পুষ্পাচয়াবকীর্ণে চ হুঁ ফট্ স্বাহা। 👈

👉 ভূতশুদ্ধি : হাত জোড় করে মনে মনে এই চারটি মন্ত্র পাঠ করুন :

ওঁ ভূতশৃঙ্গাটাচ্ছিরঃ সুষুম্নাপথেন জীবশিবং
পরমশিবপদে যোজয়ামি স্বাহা ।। ১ ।।
ওঁ যং লিঙ্গশরীরং শোষয় শোষয় স্বাহা ।। ২ ।।
ওঁ রং সংকোচশরীরং দহ দহ স্বাহা ।। ৩ ।।
ওঁ পরমশিব সুষুম্নাপথেন মূলশৃঙ্গাটমুল­সোল­স
জ্বল জ্বল প্রজ্জ্বল প্রজ্জ্বল সোঽহং হংসঃ স্বাহা ।। ৪ ।। 👈

👉 প্রাণায়াম : ‘ওঁ’ বা গুরুপ্রদত্ত বীজমন্ত্রে (বাণেশ্বর শিবের ক্ষেত্রে ‘ঐঁ’ মন্ত্রে) চার বার ৪/১৬/৮ ক্রমে পূরক, কুম্ভক ও রেচক করে প্রাণায়াম করুন। 👈

👉 শ্রীগুর্বাদিপূজা : এরপর একটি একটি করে গন্ধপুষ্পদ্বারা শ্রীগুরু ও অন্যান্য দেবতাদের পূজা করুন।
মন্ত্রগুলি হল : 
ঐঁ এতে গন্ধপুষ্পে শ্রীগুরবে নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে গণেশাদিপঞ্চদেবতাভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে আদিত্যাদিনবগ্রহেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ইন্দ্রাদিদশদিকপালেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে কাল্যাদিদশমহাবিদ্যাভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে মৎস্যাদিদশাবতারেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে মৎস্যাদিদশাবতারেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্বেভ্যো দেবেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্বাভ্যো দেবীভ্যো নমঃ। 👈

👉 ধ্যান : এরপর একটি ফুল নিয়ে (সম্ভব হলে কূর্মমুদ্রায় ফুলটি নেবেন) শিবের ধ্যান করবেন। শিবের সাধারণ ধ্যানমন্ত্র ও বাণেশ্বর ধ্যানমন্ত্র দুটি নিচে দেওয়া হল :
(সাধারণ ধ্যানমন্ত্র)

ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং রতœাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।

পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।

(বাণেশ্বর শিবের ধ্যান)

ঐঁ প্রমত্তং শক্তিসংযুক্তং বাণাখ্যঞ্চ মহাপ্রভাং।
কামবাণান্বিতং দেবং সংসারদহনক্ষমম্।।
শৃঙ্গারাদি-রসোল­াসং বাণাখ্যং পরমেশ্বরম্।
এবং ধ্যাত্বা বাণলিঙ্গং যজেত্তং পরমং শিবম্।। 👈

👉 স্নান : এরপর শিবকে স্নান করাবেন। গঙ্গাজলে শুদ্ধজলে চন্দন মিশ্রিত করে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে শিবকে স্নান করাবেন এই মন্ত্রে শিবকে স্নান করাবেন :

ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।
ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি
তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ। 👈

👉 প্রধান পূজা : স্নানের পর আরেকবার আগের ধ্যানমন্ত্রটি পাঠ করে শিবের ধ্যান করবেন। তারপর মনে মনে উপচারগুলি শিবকে উৎসর্গ করে মানসপূজা করবেন। মানসপূজার পর একে একে উপচারগুলি বাহ্যিকভাবে শিবকে সমর্পণ করবেন। 👈

👉 (সাধারণ শিবলিঙ্গে দশোপচার পূজার মন্ত্র)

ওঁ নমো শিবায় এতৎ পাদ্যং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমো শিবায় এষঃ অর্ঘ্যঃ শিবায় নমঃ। (আতপচাল ও দূর্বা একটি সচন্দন বেলপাতায় করে ফুল সহ দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদমাচমনীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদং স্নানীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমো শিবায় এষ গন্ধঃ শিবায় নমঃ। (চন্দনের ফোঁটা দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদং সচন্দনপুষ্পং শিবায় নমঃ। (একটি চন্দনমাখানো ফুল দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদং সচন্দনবিল্বপত্রং শিবায় নমঃ। (একটি চন্দনমাখানো বেলপাতা দিন)
ওঁ নমো শিবায় এষ ধূপঃ শিবায় নমঃ। (ধূপটি শিবের সামনে তিনবার ঘুরিয়ে দেবতার বাঁদিকে, অর্থাৎ নিজের ডানদিকে রাখুন)
ওঁ নমো শিবায় এষ দীপঃ শিবায় নমঃ। (প্রদীপটি শিবের সামনে তিনবার ঘুরিয়ে দেবতার ডানদিকে, অর্থাৎ নিজের বাঁদিকে রাখুন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং সোপকরণনৈবেদ্যং শিবায় নিবেদয়ামি।
(নৈবেদ্যের উপর অল্প সামান্যার্ঘ্য জল ছিটিয়ে দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদং পানার্থোদকং শিবায় নমঃ।
(পানীয় জলের উপর অল্প সামান্যার্ঘ্য জল ছিটিয়ে দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদং পুনরাচমনীয়ং শিবায় নমঃ।
(সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমো শিবায় ইদং তাম্বুলং শিবায় নমঃ। (একটি পান দিন, অভাবে সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন।)
ওঁ নমো শিবায় ইদং মাল্যং শিবায় নমঃ। (মালা থাকলে মালাটি পরিয়ে দিন) 👈

👉 পুষ্পাঞ্জলি : সচন্দন পুষ্প ও বেলপাতা নিয়ে এই মন্ত্রে এক, তিন অথবা পাঁচ বার অঞ্জলি দেবেন। 

(সাধারণ পুষ্পাঞ্জলি)

ওঁ নমো শিবায় এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি নমো শিবায় নমঃ। 👈

👉 (বাণেশ্বর শিবের পুষ্পাঞ্জলি)

ঐঁ এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি বাণেশ্বরশিবায় নমঃ। 👈

👉 গৌরীপূজা : এইভাবে শিবপূজা শেষ করে শিবলিঙ্গের গৌরীপীঠ বা পিনেটে একটি ফুল দিয়ে এই মন্ত্রে গৌরীর পূজা করুন।

ওঁ হ্রীঁ এতে গন্ধপুষ্পে গৌর্যৈ নমঃ। 👈

👉 অষ্টমূর্তি পূজা : বাণেশ্বর শিবে অষ্টমূর্তির পূজা করতে হয় না। কিন্তু অন্যান্য শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে করতে হয়। একটি ফুল দিয়ে এই মন্ত্রে অষ্টমূর্তির পূজা করুন।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে অষ্টমূর্তিভ্যো নমঃ। 👈

👉 জপ ও জপসমর্পণ : এরপর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ বা দীক্ষামন্ত্র ১০৮ বার জপ করে এই মন্ত্রে এক গণ্ডুষ জল শিবের নিচের দিকের ডান হাতের উদ্দেশ্যে প্রদান করুন।

ওঁ গুহ্যাতিগুহ্যগোপ্তা ত্বং গৃহাণাস্মৎকৃতং জপম্।
সিদ্ধির্ভবতু মে দেব ত্বৎপ্রসাদান্মহেশ্বর।। 👈

👉 প্রণাম : এইবার এই মন্ত্রটি পড়ে সাষ্টাঙ্গে শিবকে প্রণাম করে পূজা সমাপ্ত করুন।

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং গতিস্তং পরমেশ্বরম্।। 👈

👉 শিবরাত্রির ৫ অজানা তথ্য :

দেশ জুড়ে পালন হয় মহা শিবরাত্রি। শিবের মতো বর পেতে প্রায় সব হিন্দু অবিবাহিত মেয়েরাই সারাদিন উপোস করে রাত্রিবেলায় শিবের মাথায় জল ঢালবে। কিন্তু যার জন্য এত কিছু সেই দেবতা বা সেই উৎসব সম্পর্কে সব তথ্য কি জানেন? যদি না জানেন তবে জেনে নিন শিবরাত্রির ৫টি অজানা তথ্য।

১. বছরের প্রতি মাসেই আসে শিবরাত্রি। প্রতি কৃষ্ণ পক্ষের ১৪তম রাত্রি হল শিবরাত্রি। কিন্তু মাঘ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ১৪তম রাতে মহাশিবরাত্রি পালন করা হয় কারণ এই রাতটা মহাদেবের সবথেকে পছন্দের।

২. পুরাণ মতে মহাশিবরাত্রির রাত হল বছরের সবথেকে অন্ধকার রাত।

৩. অনেকের মতে, শিবরাত্রির দিনেই পার্বতীকে বিয়ে করেছিলেন মহাদেব। এই রাতেই মিলন হয়েছিল শিব আর শক্তির।

৪. অনেকে বলেন, এই দিনে শিব লিঙ্গ রূপ ধারণ করেছিলেন।

৫. শিব রাত্রির তিথি শুরু হওয়ার পর থেকে যে যার সময় মতো সময় করে শিবের মাথায় জল ঢালে। কিন্তু সবথেকে পবিত্র সময় হল ‘নিশিথ কলা’। এই সময়েই শিব, লিঙ্গ রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত  হন ।।                            

 🙏🙏হর হর মহাদেব 🙏🙏

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



                  

Post a Comment

0 Comments