জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন /পর্ব- ৯ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব- ৯ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মলয় সরকার

পামুক্কেল পর্ব

পরদিন সকালে উঠে সমস্ত মালপত্র নিয়ে আমরা একটি ছোট গাড়ীতে করে চলে এলাম পামুক্কেল। এখানে আমাদের সঙ্গে আর কেউ অন্য পর্যটক আসে নি। কয়েকদিন বেশ অন্য সবার সাথে ঘুরে একটা কেমন পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল, হোক না ভিন্ন ভিন্ন দেশের ,হোক না ভিন্ন ভাষাভাষী।


একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলি । মোটামুটি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে মিশে , স্বামী বিবেকানন্দের মত আমারও মনে হয়েছে, কোথাও যেন আমরা সবাই, সমস্ত মানুষেরা এক বৃহত্তর আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা, সেটা বোধ হয় মনুষ্যত্বের বন্ধন। সমস্ত মানুষই একভাবে আনন্দে হাসে, একভাবে দুঃখে কাঁদে, একভাবে খিদে পেলে খায়, একভাবে কষ্টে ব্যথা পায়। হতে পারে তার প্রকাশের মৌখিক ভাষা আলাদা , কিন্তু মনের ভাব বা ভাষা একই। সেইখানে আমার কাছে পৃথিবীর কোন প্রান্তের কোন মানুষকেই নিজের দেশের মানুষের থেকে আলাদা বোধ হয় নি।আমার কাছে চীনের এক বাজারের বিক্রেতা, কি মেক্সিকোর রাস্তার গাইয়ে, কি তুরস্কের ফেরিওয়ালা সবাই মনে হয়েছে এক, এক বিশ্বমায়ের সন্তান।


আজ সেই বিরহ বেদনাটাই মনে বাজছে, হোক না কেন একদিন বা দুদিনের দেখা শোনা।আজ আমরা গাড়ী করে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম একটি হোটেল এ। জানিনা সেটা ঠিক হোটেল না প্রাইভেটে একটা প্রাকৃতিক সম্পদকে ঘিরে নিয়ে ব্যবসা।আমরা জায়গাটার মধ্যে ঢুকে দেখলাম, প্রচুর জায়গা জুড়ে রয়েছে চেয়ার টেবিল পাতা, একটা বড় রেস্টুরেন্টের মত সুন্দর সাজানো। অনেক লোক খাচ্ছে বসে। আমাদের বলে দেওয়া হল, যা খাব, ওখানে অর্ডার করতে। বেলাও হয়েছিল। তা ছাড়া এর পর কোথায় কি পাব জানিনা। তাই অর্ডারটা আগেই দিয়ে দিলাম। সমস্ত বিদেশীরা আসে বলে প্রায় সব রকমেরই খাবার রয়েছে, এশিয়ান বা কন্টিনেন্টাল। এরপর বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি, রেস্টুরেন্টের ভিতরের চত্বরটা পুরো খোলা ও ‘উন্মুক্ত চারিধার’। 


সেখানে যা দেখলাম,দেখে চক্ষু ছানাবড়া। সামনেই একটা বড় ও অনেক ছোট ছোট জলের পুল রয়েছে। তাতে ক্রমাগত জল ঝরে ঝরে পড়ছে উপর থেকে।আর একটু সামনে তাকিয়ে দেখি একটা বিরাট বড় উঁচু দু তিন ধাপ বেদীর উপরে একটা গরম জলের ফোয়ারা অবিরাম জল উদ্গীরণ করে চলেছে। আর মাঝে মাঝে বেশ শব্দ করে অনেক উঁচু পর্যন্ত জল ও বাষ্প ছুঁড়ছে। সেই জল উপর থেকে ধাপে ধাপে নামছে চারিদিক দিয়ে।প্রতি ধাপে বেশ কিছু করে স্নানের পুল রয়েছে।শেষ ধাপে এসে জল একটা বড় একটু গভীর একটা  পুলে পড়ছে, যদিও তাতে জলের গভীরতা খুবই কম। জল বেরিয়ে যাচ্ছে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায়।এই সমস্ত পুলে অনেক পুরুষ মহিলা একসঙ্গেই স্নান করছে।মহিলারাও স্বল্পতম বসনে, এবং যথারীতি আমাদের মেয়েদের মত লজ্জাশীলা তো ওঁরা নন, কাজেই কোন অসুবিধা নেই। দেখলাম ফোয়ারার মুখ থেকে শুরু করে চারিদিক, পোড়া মাটির বা গাঢ় কালচে হলুদ  রঙের কাদা সুদীর্ঘকাল ধরে গড়িয়ে পড়ে জায়গাটার এক অদ্ভূত দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য তৈরী হয়েছে।অনেকে দেখি সেই কাদা মেখে স্নান করছে। এই স্নানের জন্য অবশ্য আলাদা দাম ধার্য করা আছে।এছাড়াও সেই জলের তাপমাত্রা থেকে, জলে কি কি আছে এবং তার উপকারিতা ইংরাজী ও তুর্কী উভয় ভাষাতেই লেখা আছে। 


পরে দেখলাম, এই হোটেলটার নাম “পাম থার্মাল হোটেল”। এখানকার জলের তাপমাত্রা ৫৬-৫৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।ভেবেছিলাম যত হলুদ কাদা সব বুঝি প্যাচপেচে নরম।তবে ভুল ভাঙ্গল পরে। চারিদিক সুন্দর পরিচ্ছন্ন।আমাদের এখানকার কোন প্রস্রবনের মত নয়।পয়সা নিচ্ছে ঠিকই তবে ব্যবস্থাও অনেক।প্রতি পুলের পাশে যথেষ্ট পরিমাণে ছাতা লাগানো চেয়ার আছে স্নানের পর বিশ্রাম বা রোদ পোহানোর জন্য। প্ররি ধাপে ওঠার জন্য ঝকঝকে বাঁধানো সিঁড়ি আছে একপাশ দিয়ে। তবু জুতো খুলে রেখেই গেলাম।ধীরে ধীরে প্রধান ফোয়ারা বা গীজারের সামনে গেলাম। গায়ের কাদাগুলোতে হাত দিয়ে দেখলাম, তা যথেষ্ট শক্ত।কবে থেকে জলের সাথে এই সমস্ত মিশ্রিত কাদার গুঁড়ো অল্প অল্প করে বেরিয়ে জমতে জমতে আজকের এই চেহারা নিয়েছে তা ভগবানই জানেন।এমনকি এই জমা কাদা একেবারে পোড়া মাটির মত শক্ত।যে জল বেরোচ্ছে বা জমছে তা- ও যথেষ্ট পরিষ্কার। 


একেবারে কাছে, ফোয়ারার বেদীমূলে গিয়ে দেখি ফোয়ারাটি তিন ধাপে গাঁথা।উচ্চতা ভূমি থেকে প্রায় আট- ন’ ফুট হবে। সবচেয়ে উপরের ধাপে হল ফোয়ারার মুখ। সেটা দিয়ে একটা বড়  ভাতের হাঁড়িতে জল ফোটার মত গরম জল লাফিয়ে লাফিয়ে ফুটছে।আর সঙ্গে বাষ্প বের হচ্ছে।এই জায়গাটাকে বলে কারাহায়িত স্প্রিং (Karahayit Springs which is known as Kirmizi Su (Red Water))। এই জায়গাটি পামুক্কেল এর কাছে।এই জলে অনেক ধরণের ধাতব পদার্থ মিশ্রিত আছে, যেমন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার ইত্যাদি। এই জায়গাটি বা এই ফোয়ারাটি নাকি বিগত পাঁচহাজার বছর ধরে মানুষকে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সাহায্য করে আসছে। এর জলে স্নান করলে শরীর , মন ঝরঝরে তাজা হয়, চর্মরোগ সহ নানাবিধ দুরারোগ্য রোগ সারে,  এই বিশ্বাস মানুষের মনের মধ্যে ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। সেই বিশ্বাসেই আজও হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন এর জলে অবগাহন করে সুস্থ হতে। এখানে স্পা-ও আছে।এখানে দেখা হল এক তরুণ তেলুগু দম্পতি ও তাদের বালক পুত্রের সাথে। তারা ওই পুলে নেমে তারুণ্যের উৎসাহে স্নান করল। আলাপ হল ওদের সঙ্গে। এই বিদেশে ভারতীয় কাউকে দেখে একটু নিজের মত বোধ হল।যদিও তারা এই দুজন বৃদ্ধবৃদ্ধার সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে রাজী ছিল না। বুলবুলের দিকে চেয়ে বললাম, নামবে নাকি ঐ রকম সাজে, যেমন সব মেয়েরা নেমেছে? ও মুচকি হেসে বলল, তুমিও ওই ছেলেদের মত নামতে পারবে নাকি , তাহলে আমি আছি।


আমরা তো স্নানের কিছু নিয়েই যাই নি, তাছাড়া এরকম যত্রতত্র স্নান বোধ হয় করতেও পারব না। আমি আর কিছু বললাম না।
এখানে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বের হলাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।


পামুক্কেলের একটা দোকানের সামনে এলাম। বোধ হয় এটা ওই টুর কোম্পানীরই ব্যবস্থা করা দোকান। এখানে মালপত্র নিয়ে বসে আছি, । বেশ কিছুক্ষণ পরে একজন এসে ডেকে নিয়ে গেল ।মালপত্র পড়ে রইল সেই দোকানে। গিয়ে দেখি একজন গাইড বেশ কিছু পর্যটক নিয়ে একটা গ্রুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যেতেই খুশি হয়ে সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, সবাই এসে গেছেন। আমার পিছনে পিছনে আসুন, একটা ঐতিহাসিক জায়গায় নিয়ে যাব। আমরা বেশ কিছুটা হেঁটে এক জায়গায় পৌঁছালাম।


সেখানে দেখি ধ্বংসাবশেষের ছড়াছড়ি।সেই এফেসাসের ধ্বংসাবশেষের মতই সব। তবে এখানে একটু বেশি ভাঙ্গা। এই জায়গাটার নাম হিয়েরাপোলিস।পামুক্কেলও বলে। পামুক্কেল কেন বলে, বলছি পরে।  


তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমে ডেনিজলি এলাকায় এই জায়গাটা গড়ে ওঠে প্রায় দ্বিতীয় খ্রীঃ পূর্বাব্দে । এই জায়গাটির গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে এখানকার, প্রায় দু’শ মিটার পাহাড়ী  উঁচুতে অবস্থিত যে গরম জলের ফোয়ারা আছে তাই। এই গরম জল তারা তখনকার দিনে স্পা হিসাবে ব্যবহার করত। এবং এর গুণে আকৃষ্ট হয়ে এক বিরাট শহর গড়ে ওঠে। এখানে আজও দেখা যায় অনেক বাড়ী ঘর, স্নানাগার, বড় বড় স্তম্ভ, এছাড়া একটি বড় নাট্যমঞ্চ- যেমন অন্য জায়গায় দেখেছি।( আমার মনে হয় সে যুগে মানুষ নাটক বা অন্য অনেক কিছুতেই এই মঞ্চটা ব্যবহার করত।তাই আমি বহু জায়গাতেই, যেখানেই বড় শহর, সেখানেই এই নাটমঞ্চ দেখেছি) সমস্ত রয়েছে। রাস্তা ঘাট যে সুন্দর পরিকল্পনার মতই তৈরী হত তা দেখেই বোঝা যায়। আজকের আমাদের যে কোন বড় শহরের সঙ্গে দু হাজার বছর আগের স্থাপত্য বিদ্যা কোন অংশেই কম ছিল না।বরং মনে হয় তারা আরও অনেক উন্নত ছিল। তাই এত বছর পরেও আমরা এগুলো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের আজকের সভ্যতার উপর যদি কালের করাল ছায়া কখনও নেমে আসে, ভবিষ্যতের মানুষ কিছুই দেখতে পাবে না । সব গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবে। পরবর্তী কালের রোমান কনস্টানটিনোপলের সময়েও ছিল এর রমরমা।


এখানে আরও রয়েছে গোরস্থান ,সুন্দর রাস্তা,কফিনের বাক্স- যেগুলো পাথরের তৈরী । এছাড়া অনেক বাড়ীর মাথায় ধনুকাকৃতি আর্ক।সেগুলো কিন্তু শুধু বড় বড় পাথর দিয়ে গাঁথা। কি করে সেগুলো ঝুলন্ত অবস্থায় আটকে আছে আজও এবং পড়ে যায় নি, তা সত্যিই আশ্চর্য । এখানে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার পর গড়ে ওঠে বহু চার্চ ও খৃষ্টীয় চ্যাপেল। তবে ৬০ খ্রীষ্টাব্দে  এক ভূমিকম্পে নাকি অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যায়।পরে আবার তা গড়ে তোলা হয়। তবে এটা প্রায় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত রমরমিয়ে চলেছিল। গ্রীক ও রোমান সভ্যতার সংমিশ্রণে এখানে যে স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল, তা সত্যিই দেখার মত।


এই ধ্বংসাবশেষের ভিতরে বেশি যাওয়ার সময় হয় নি। একটা পাশ থেকেই দেখে তৃষ্ণা মেটাতে হয়েছে। কারণ গাইড বোধ হয় নিজে দেরী করে ফেলেছিলেন বা তাঁর তাড়া ছিল। আমরাও আগে এর চেয়েও বড় ধ্বংসাবশেষ ভাল করে দেখেছি বলে খুব যে আক্ষেপ ছিল তা নয়। গাইড আমাদের এনে ফেললেন, যেখানে আনার মুখ্য উদ্দেশ্য -সেই পামুক্কেলে। যেটা বলছিলাম ২০০ মিটার উঁচু এই ফোয়ারাটি সত্যিই অনবদ্য।এখানে রয়েছে , সেই পুরানো ফোয়ারাটিকে ব্যবহার করে একটি গরম জলের স্পা বা স্নানাগার। তার নাম Antique Pool ।সেখানে ঢুকতে গেলে প্রথমেই টিকিট কাটতে হয়। সেটা গাইড ভদ্রলোকই কেটে রেখেছিলেন।

পরের পর্বে বলব ভিতরের কথা—--

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments