জ্বলদর্চি

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ (নেটিভ আমেরিকানদের গল্প)/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—
হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ (নেটিভ আমেরিকানদের গল্প) 

চিন্ময় দাশ

আগুন দাও, আগুন


[উত্তর আর দক্ষিণ দুই আমেরিকারই পশ্চিমে শুয়ে আছে দিগন্ত ছড়ানো প্রশান্ত মহাসাগর। প্রায় পৌনে ছ’শো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস আমেরিকার মাটিতে। তাদের অর্ধেক অংশই নেটিভ আমেরিকান (কিংবা আমেরিকান ইন্ডিয়ান, ফার্স্ট আমেরিকান ইত্যাদি) নামে চিহ্নিত। নেটিভ আমেরিকানদের এক অংশের বাস এই মহাসাগরের বুকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। তাঁদের মধ্যেই এই গল্পটি প্রচলিত আছে।]

বুড়ি আর চারজন ছেলে নিয়ে বাস করে এক জেলে। জলে ঘেরা, জলে ভরা দেশ। একটা নদীও আছে বাড়ির কাছেই। মাছ ধরাই তাদের পেশা। কাজটা চলে আসছে বাপ-ঠাকুরদা, বা তারও আগের আমল থেকে। 
ছেলে চারটেও বংশের পেশাতেই জুড়েছে নিজেদের। একসাথে থাকে চার ভাই। একসাথেই নদীতে যায়। একসাথেই ঘরে ফেরে কাজের শেষে।
এক দিনের ঘটনা। সেদিন সবে সকাল হয়েছে। ডুবসাঁতার ছেড়ে, সাগরের বুকে ভুস করে মাথা তুলেছে সূয্যিমামা। বড়ভাই ডাকাডাকি শুরু করে দিল ঘুমন্ত ভাইদের—উঠে পড়, উঠে পড়। সকাল হয়ে গেছে। বেরুতে হবে যে। 
সবাই ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। জলখাবারের পাট চুকিয়ে, চলল নদীর দিকে। নদীটা এখানে সাগর এসে মিশেছে। তাদের ডিঙ্গিনৌকাটা উল্টানো থাকে সেই মোহনার বালির চড়ায়।
জলে ডিঙ্গি ভাসিয়ে সবে কিছুটা দূর গিয়েছে। সেজভাইটা চেঁচিয়ে উঠল—আরে, দ্যাখো দ্যাখো। আগুন জ্বলছে যে ওখানে।
সবাই তাকিয়ে দেখল। সবাই অবাক। সত্যিই তো আগুন জ্বলছে ওখানে। যেখান থেকে ডিঙ্গি ভাসিয়েছে ছেলেগুলো, আলো ফুটে উঠেছে তার একেবারে পাশটিতেই। ছোট ভাইটা চেঁচিয়ে বলল—ডিঙ্গি ঘোরাও। একটু আগুন পেলে তো, বর্তে যাবো আমরা। ভারি উপকার হবে। 
মেজোও কম যায় না—বটেই তো, বটেই তো। সবকিছুই এবার থেকে আগুনে ঝলসে নিয়ে খাওয়া যাবে। দারুণ মজার ব্যাপার হবে একটা।
বড় বলল—সব ঠিক আছে। আগে কয়েকটা মাছ ধরতে হবে তো, না কি? আগুন তো আর খাওয়া যাবে না। 
সেটাই স্থির করা হল। কিছুটা মাছ জালে উঠলেই ফিরে যাওয়া হবে। আগুন যোগাড় করতেই হবে আজ। এমন মওকা হাতছাড়া করা যায় না। 
মন আনচান সকলেরই। মাছের দিকে যেন মনই নাই কারও। কয়েকটা মাছ জালে উঠতেই, জাল তুলে ফিরে চলল ডাঙ্গার দিকে।
ডিঙ্গি ভালো করে ভিড়েছে কি ভেড়েনি, বড়ভাইটা লাফ দিয়ে ডাঙ্গায় পড়ল। তারপরেই দৌড়। আগুনটা যেখানে দেখা গিয়েছিল, সেখানে হাজির হয়ে গেল।
এদিকে হয়েছে কী, একপাল জলমোরগ (অনেকটা আমেরিকান কুট-এর মতো সেগুলো) গোল হয়ে ঘিরে ছিল আগুনটাকে। কাঁচা কলা আগুনে চাপিয়ে সেঁকছিল তারা। তাদের চোখে পড়ে গেল, একটা ছেলে দৌড়ে আসছে এদিক পানে। ঝটপট করে আগুন নিভিয়ে দিল মোরগগুলো। ডানা মেলে উড়ে গিয়ে পড়ল সাগরের জলে। সাথেসাথে আগুনটা উধাও। বেমালুম কোথায় উবে গেল যেন। একেবারে ভোজবাজির মতো কাণ্ড!
মুখ গোমড়া করে ভাইদের কাছে ফিরে এলো বড়। সবাই জানতে চাইল—কেমন দেখতে ছিল আগুনটা? জ্বলছিলই বা কিসে?
বড়ভাইটা ভারি বিমর্ষ। সে বলল—কী করে বলব? আমি পৌঁছোবার আগেই তো নিভিয়ে দিল সেটাকে। দেখতেই পাইনি আমি আগুনটাকে। ভেবেছিলাম, কোন একজন মানুষ নিশ্চয়ই আছে ওখানে। আগুনটা তারই। কিন্তু তা নয়। আসলে আগুনটা ছিল একপাল জলমোরগের। আগুনে কাঁচকলা সেঁকে খাচ্ছিল পাখিগুলো। 
সেজভাইটা বলে উঠল—তাই বলি, আমাদের গাছের কলাগুলো যায় কোথায়? এবার বুঝেছি, সব এই ব্যাটাদের কাণ্ড।  
ছেলেগুলোর দুঃখ হোল যত, রাগ তার চাইতেও বেশি। সবাই মিলে ঠিক করল, আর মাছ ধরতে যাওয়া নয়। আবার কবে আগুন জ্বলে, নজর রাখতে হবে।
কিন্তু লাভ কিছুই হোল না তাতে। বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। আগুনের দেখাই নাই। এদিকে মাছ ধরতে যাওয়াও হচ্ছে না। পেট চলবে কী করে? অগত্যা আবার ডিঙ্গি ভাসানো হল জলে। 
অবাক কাণ্ড। সেদিনই আগুন জ্বলে উঠল। কিছুদূর গিয়ে, ডাঙ্গার দিকে চোখ ফেরাতেই আগুন দেখতে পেল তারা। 
এমনটাই চলতে লাগল নিয়মিত। যেদিন চার ভাই ডিঙ্গি ভাসায়, সেদিনই দেখা যায় আগুনটাকে। জলে ডিঙ্গি ভাসলো না, তো ডাঙ্গায় আগুন জ্বললো না।
বড়ভাই বললো—এবার বুঝেছি চালাকিটা। আমরা থাকলে, আগুন জ্বালে না মোরগগুলো।
মেজভাই বললো—এক কাজ করো, দাদা। আমরা তিনজনে যাই মাছ ধরতে। তুমি থেকে যাও। তাহলেই কাজটা উদ্ধার করা যাবে। 
বড় বলল—নারে, অত সোজা নয়। ওরা ঠিক গুণে দেখে নেবে, চারজন নয়, তিনজন যাচ্ছে ডিঙ্গিতে।
তাহলে? কিছুই করা যাবে না?—তিনজন একসাথে বলে উঠল। 
বড় জবাব দিল-- এক কাজ করব, বুঝলি। ফন্দি আঁটতে হবে। বোকা সাজাতে হবে মোরগগুলোকে। 
সেদিন মাছ নিয়ে হাটে গেল বড়ভাই। ফেরার সময় ইয়াব্বড় আর লম্বা এক লাউ নিয়ে এল কাঁধে করে। সেই লাউকে পোষাক-টোষাক পরিয়ে একেবারে একজন মানুষের মত সাজিয়ে ফেলা হোল। 
তার পর? পরের দিন সকালে সেই মানুষের পোষাকে সাজানো লাউ আর তিন ভাই—চারটিতে মিলে ডিঙ্গিতে চড়ে বসল। মাঝ ধরতে চলল মোহনার দিকে। 
জলমোরগগুলো তক্কে তক্কে ছিল। ডিঙ্গি ভাসতেই, তাদের মোড়ল এক-দুই-তিন-চার করে গুণে দেখল—না, আজও চারজনই আছে ডিঙ্গিতে। আজও আর কোন ভাবনা নাই। তারা ঝটপট ডাঙ্গায় উঠে, আগুন জ্বেলে ফেলল। এবার কলা সেঁকতে হবে। একটা মোরগ দৌড়ে গিয়ে কতকগুলো কলা এনে আগুনে ফেলে দিল। 
নিত্যদিন জেলে ভাইদের বাগান থেকেই কলা চুরি করে আনে মোরগগুলো। এতদিন চোরের হদিস করা যায়নি। এইবার সব জানা গিয়েছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে সবই দেখছে বড়ভাই। সে আগুন নেবে বলে লুকিয়ে আছে।
কলাগুলো চোখে পড়তেই, মাথায় রাগ চড়ে গেল ছেলেটার। লাফিয়ে গিয়ে পড়ল একেবারে আগুনটার পাশে, কপ করে ধরে ফেলল মোরগদের মোড়লটাকে। 
মোড়লকে পাকড়াও হয়ে যেতে দেখে, বাকিগুলোর সে কী অবস্থা। যে যদিকে পারল, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সটকে পড়ল প্রাণ নিয়ে।
মোড়ল মোরগটা তখন ছটফট করছে ছেলেটার হাতে ধরা পড়ে। ছেলেটা বলল—হতচ্ছাড়া, এতদিনে পাকড়াও করেছি তোকে। তাহলে তোরাই আমাদের কলা চুরি করিস। তোরাই আগুন লুকিয়ে রেখেছিস আমাদের থেকে! আজ তোর দফা রফা করে ছাড়ব আমি। মুণ্ডুটাই ছিঁড়ে নেব তোর। 
এমন হম্বি-তম্বি শুনেও, ভয় পেল না মোরগটা। এক্টুও ঘাবড়াল না, চমকাল না। বলল—সে নাহয় মারো তুমি আমাকে। কিন্তু আগুনের হদিশ পাবে কী করে তাহলে? গোপন কথাটা তো আমার সঙ্গেই চলে যাবে। 
ছেলেটা তো তখন রাগে গরগর করছে। কোন কথায় কান না দিয়ে, মোরগের গলা মোচড়াতে গেল সে। কিন্তু তখনও মোরগের গলায় ভয়ের লেশটুকুও নাই। সে আবার বলল—আবারও বলছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেই তোমার লাভ। আগুনের হদিশ একমাত্র আমিই জানি।
ছেলেটা একটু ধাতস্থ হোল এ কথায়। বলল—বল হতভাগা, আগুন কোথায়? 
মানকচুর পাতায় আছে আগুন। ঐ ঝোপটার কাছে যাও। ওখানে মানকচু পেয়ে যাবে। মোরগ বলল ছেলেটাকে।  
মোরগকে হাতছাড়া করা যাবে না। সেটাকে মুঠোয় রেখেই মানকচুর পাতা ভেঙ্গে আনল ছেলেটা। 
মোরগ বলল—ঐ দ্যাখো, লাঠি পড়ে আছে একটা। শুকনো লাঠিটা দিয়ে ঘষতে থাকো পাতার উপর। আগুন পেয়ে যাবে। 
মহা আনন্দ ছেলেটার মনে। লাঠিটা দিয়ে সে জোর জোর ঘষতে লাগল পাতার উপর। কিন্তু কোথায় আগুন? উল্টে পাতাটাই ছিঁড়ে যাচ্ছে। ছেলেটা হুমকি দিয়ে বলল—আগুন কোথায় রে, হতভাগা? 
আগুন তো আছে পাতার উল্টো দিকে। সোজা দিকে ঘষলে পাবে কী করে? 
এবার পাতা উলটে ঘষতে লাগল ছেলে। কিন্তু আগুন তো নাই। রেগে গিয়ে বলল—তবেরে ব্যাটা, বুদ্ধু বানাচ্ছিস আমাকে। 
ঠিক আছে তবে। সবুজ ডাঁটায় ঘষে দ্যাখো। এবার ঠিক পেয়ে যাবে।
মোরগের কথা মত, মানকচুর সবুজ ডাঁটাটা ভেঙ্গে নিয়ে ঘষা শুরু করল। তাতেও কাজের কাজ কিছুই হোল না। আগুনের দেখাটিও নাই।
মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে পাখিটা। আগুন জ্বলে উঠল ছেলেটার মাথায়। রাগে গরগর করতে করতে বলে উঠল—অনেক হয়েছে। আগুন চাই না আমার। তোর ব্যবস্থা করছি আমি। এইখানে লাঠিতে গেঁথে আধ মরা করে রেখে যাব তোকে। ধুঁকে ধুঁকে মরবি একটু একটু করে। তখন বুঝবি, মস্করা করবার কতখানি মজা। 
হাতের লাঠিটার দিকে চোখ গেল। গাছের শুকনো ডাল। একটু সূচালো করা দরকার এটাকে। এদিক ওদিক খুঁজে একটা পাথর জোগাড় করে আনল ছেলেটা। পাথরে ঘষতে লাগল ডালটাকে। 
একটু বাদেই অবাক কাণ্ড। দেখে চমকে গেল ছেলেটা। আগুনের ফুলকি! হ্যাঁ, ফুলকিই তো! পাথরে ঘষা খেয়ে আগুন তৈরি হয়েছে কাঠের মাথায়। 
শুকনো ঘাস-পাতা চাপা দিয়ে, জোরে জোরে ঘষা শুরু করতেই, দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। সত্যিকারের আগুন। মানুষের হাতে তৈরি প্রথম আগুন! 
মোরগ বলল—আগুন পেয়ে গেছ, এবার তো আমাকে ছেড়ে দাও। 
ছেড়ে দেব? তোকে? কত কলা খেয়েছিস আমাদের। সব হিসাব বুঝে নেব আজ। এই আগুনে সেঁকব তোকে। তার পর আয়েস করে খাবো চার ভাই মিলে। তখন বুঝবি, কলা চুরির মজা। 
মোরগটা কিন্তু তাতেও ঘাবড়াল না। বলল—কেমন মানুষ গো তুমি? ছোট্ট একটা জীব আমি। এমন আনন্দের দিনে, আমার প্রাণ নেবে? 
একটু নরম হোল ছেলেটা। বলল—ঠিক আছে। তোর জন্য আগুন পেলাম। তাই প্রাণে মারব না তোকে। তবে, বড্ড হয়রাণ করেছিস। একটু শিক্ষা দিয়ে দিই বরং। 
রাগের চোটে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মোরগটার মাথায় বেশ করে রগড়ে দিল। তাতে টকটকে লাল হয়ে উঠল চামড়াটা। ফেটে রক্ত বেরোবার জোগাড়।
তা দেখে, ছেলেটার মুখে তৃপ্তির হাসি—এবার যা। তোর ছুটি। ছেড়েই দিলাম তোকে। 
ছাড়া পেয়ে কোন রকমে ডানা ঝাপটে জলে গিয়ে পড়ল পাখিটা। তবে, দাগটা আর মুছল না তার মাথা থেকে। 
আজও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় দেখা যায়, টকটকে একটা লাল দাগ ফুটে আছে জলমোরগদের মাথায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments