জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ-১২/ শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ

বারো

শুভঙ্কর দাস 

"চলো বোঝা ফেলতে ফেলতে
চলো মরতে মরতে নিমেষে নিমেষে 
থেমো না, থেমো না
পিছন ফিরে তাকিয়ো না
পেরিয়ে যাও পুরানোকে জীর্ণ ক্লান্ত অচলকে.."

কুমারের হাঁটতে কোনো কষ্ট হয় না। তার হাঁটতেই ভালো লাগে।সে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে যে-কোনো যানবাহন। সবচেয়ে বড় কথা,তার যেকোনো যানবাহনে চড়ার মতো সার্মথ্য ছিল না। অবশ্য তাতে কুমারের কোনোদিন কোনো খেদ ছিল না!
লাট সাহেবের গৃহের সামনে দিয়ে দীর্ঘরাস্তা বেছে নিয়েছিল রোজ গঙ্গাস্নানের। তারপর স্নান সেরে আবার ছাত্রাবাসে ফিরে আসত।
সঙ্গে এক-দুবার গঙ্গাধর বা অন্য বন্ধুরা থেকেছে,কিন্তু তারা হাঁটার কষ্টকর অবস্থায় পড়ে দ্বিতীয়বার ঐ পথ আর মাড়ায়নি! কুয়োর জলেই সন্তুষ্ট থেকেছে। কিন্তু কুমার অন্য ধাতুতে গড়া।একবার যখন স্থির করেছে,তখন তা করেই ছাড়বে।
একদিন গঙ্গাস্নান সেরে মাথার ওপর ভিজে গামছা চাপিয়ে হনহন করে রৌদ্রময় পথ হাঁটছিল।লাট সাহেবের সুপ্রশস্থ গেটের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটি। একটি ঘোড়ার গাড়ি অতি দ্রুত গতিবেগে ছুটে আসছিল পথ দিয়ে। সহসা সহিস খুব জোরে ঘোড়ার মুখের লাগাম চেপে ধরল।কারণ সামনে এসে পড়েছে একটি জীর্ণ-শীর্ণ সবজিওয়ালা। মাথায় ঝুড়ি।লোকটির গা খালি।বুকের প্রতিটি পাঁজর দৃশ্যমান। ধীরেসুস্থে রাস্তা পার হচ্ছিল। আকস্মিক ঘোড়ার গাড়িটি আসতে দেখে বয়স্ক সবজিওয়ালা আতঙ্কিত হয়ে টাল সামলাতে না পেরে ঘোড়ার গাড়ির সামনে এসে পড়ল।মাথার ঝুড়ি রাস্তায় পড়ে নানা রকমের কাঁচা সবজি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিল।লোকটিও মুখ থুবড়ে পড়ল।তার মাথাটা একটা ইটে লেগে কেটে গেল।সে 'হায় আল্লা' বলে আর্তনাদ করে উঠল।সহিস যদি অতি তৎপরতার সঙ্গে ঘোড়াটিকে না থামাত,তাহলে হয়তো বৃদ্ধ ও রুগ্ন সবজিওয়ালার বুকের ওপর দিয়ে ছুটে যেত ধাবমান অশ্বশকটি।
ঘোড়াটি থেমে যাওয়ায় সুসজ্জিত ও পর্দাসীন বগিটি একটি হেলে গিয়ে স্থির হল। সেই বগির ভেতর দিয়ে একটি আগুনে চোখ এতক্ষণ বাইরের দিকে অগ্নিবর্ষণ করছিল।এবার বেরিয়ে এলো বাইরে। শক্ত বুটজোড়াটি শব্দ করতে করতে স্থির কাঁচা সবজির ওপর।কয়েকটি বেগুনকে বুট দিয়ে মাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সেই বুড়ো লোকটির দিকে।
দাঁত কিড়মিড় করে চিৎকার করে উঠল কোট-প্যান্ট-টাই পরিহিত সাহেবটি। 
"নেটিভ ইণ্ডিয়ান।টোমাদের এই রোড দিয়ে হন্টন করা নিষেড, এই নোটিশ কি ডেখা হয় নাই?"

বৃদ্ধ সবজিওয়ালা প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে কী বলল,বোঝা গেল না!
সাহেব আরও বিরক্ত হয়ে রাস্তার ওপর সবজিগুলোকে পা দিয়ে থেঁতলে দিতে লাগল। তারপর চাবুক এনে বসিয়ে দিল কয়েকটা মার,মুখে বলে উঠল," স্লামডগ কোথাকার! বার বার বলিয়া দিয়া হইয়াছে,এই রোড টোমাদের জন্য নহি,বাট এইসব শুকরকে শাস্টি না দেওয়া পর্যন্ট কোনো কথা কানে ডোকে নাই!
আবার চাবুক তুলে মারতে যেতেই এবার একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। রাস্তায় জমে যাওয়া পথচারীদের মধ্যে একজন বলিষ্ঠ যুবা সেই সবজিওয়ালাকে ঘিরে বসে পড়ল।এবং চাবুকের আঘাত থেকে তাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করল।ফলস্বরূপ সাহেবের চাবুকের মোক্ষম ঘা সেই যুবকটির গায়ে এসে পড়তে লাগল।
এবং সবচেয়ে দেখার মতো দৃশ্য, চাবুকের প্রতিটি ঘা নির্বিকারভাবে সহ্য করছিল যুবকটি।এবং স্থিরভাবে তাকিয়ে ছিল সাহেবের চোখের দিকে।
এমন ঘটনায় সাহেবটি প্রথমে হকচকিয়ে গেল,তারপর সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, " হু আর ইউ? ইডিয়ট? হামার গাড়ির অবস্টা ব্যাড করিয়ে দিয়েছে এই উল্লুখ ফার্মার, একে ছাড়িব নাহ্!"

দেখা গেল,সাহেবের ঘোড়া গাড়ির একটা চাকা, পাশের সরু নালায় আটকে গেছে। সেই সহিস অনেকক্ষণ ধরে সেই চাকা তোলার চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না!
চারিপাশে ছোট খাটো ভিড়ের জনতা সব দেখছে,তবে তাদের মধ্যে এসব নিয়ে কোনো হোলদোল নেই। প্রায় সবার চোখে অবশ্য সেই বৃদ্ধ সবজিওয়ালা দোষী।তাই এইসব ঘটনায় তারা ভালো দর্শক।এবং চূড়ান্ত দায়হীন।
সাহেবের কথা বুঝতে পেরে সেই যুবক সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘোড়ার গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলো।শক্তপোক্ত হাত দিয়ে গাড়ির চাকাটি ধরল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে চাকাটি নালা থেকে তুলে রাস্তার ওপর রাখল।তোলার সময় সাহেব আরও চাবুক মারতে যাচ্ছিল বয়স্ক সবজি ওয়ালেকে,কিন্তু সেই যুবকটির শান্ত ও স্থির চক্ষু দেখে থেমে গেল।তারপর যেভাবে একার হাতে ঘোড়ার গাড়ির চাকাটা তুলে দিল।তাতে অদৃশ্যভাবে যুবকটি শারীরিক ক্ষমতা যেন কোনো নির্দেশ দিচ্ছে।  তখন সাহেব ধীর পায়ে সরে এলো।এবং এসেই নিজের সহিসের গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলে উঠল,স্টার্ট সুন...  
সহিসটি ভয় পেয়ে অতি দ্রুত সাহেবকে বসিয়ে পড়ে থাকা সবজিওয়ালার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
অদৃশ্য চক্ষুর তরঙ্গে একটা জিনিস লক্ষ্য করা যায়,সেই ঘোড়া গাড়িটির পশ্চাতের পর্দা তুলে সাহেবটি এক দৃষ্টিতে সেই যুবকটির দিকে তাকিয়ে ছিল,যতদূর তাকে দেখা যায়।

সবজিওয়ালার ফুটি-ফাটা সব সবজি ঝাঁকায় তুলে দিল যুবকটি। সবজিওয়ালা ঠোঁটের রক্ত মুছে অশ্রুসজল চোখে জিজ্ঞেস করল,কে বাবা তুমি? এতো সাহস!
কুমার কিছুই বলল না।শুধু সেই লোকটিকে রাস্তার ধারে কল থেকে জল এনে খাইয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করল। আবার চলতে শুরু করল। 
না,ছাত্রাবাসের দিকে নয়।
আবার গঙ্গাস্নানের জন্য....
তার ভেতরে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
এ কেমন তার দেশ?
যেখানে তার দেশের মানুষের কোনো ন্যূনতম সম্মান নেই! দেশের শাসক যদি এতোখানি অহংকারী ও অন্ধ হয়, তাহলে দেশ চলবে কী করে? মানুষের প্রতি এই দিনের পর দিন অপমান, এতো একধরণের পাপ!
কোন্ গঙ্গাস্নানে এই পাপ ধুয়ে যাবে?
বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাস মনোযোগ দিয়ে করলেও শাসকের এই দুর্ব্যবহার কুমারকে চিন্তিত করে তুলল।
বিদ্যালয় শেষে বাসায় ফিরে চুপচাপ নিজের খাটে শুয়ে পড়ল কুমার। তার মন ভালো নেই। 
একবার একটি দোকানে সামনে দেখেছিল কুমার,একটু দেরি করে মাল দেওয়ার জন্য করার জন্য একজন ইংরেজ পুলিশ কীভাবে চাবকে ছিল,সেই দোকানদারকে। আশেপাশে সবাই মাথা নত করে এই দৃশ্য দেখছিল।কোনো প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না।
এসব কুমার গাঁয়ে দেখেনি,কারণ সেখানে সবকিছুর হর্তাকর্তা ছিল জমিদার।ফলে শাসকের এই রূপ কুমারের চক্ষুগোচর ছিল না!
তারপর আরও একটি দিক সে লক্ষ্য করে অন্তরে ভীষণ ব্যথিত।
একবার কী কার্যকারণে ইংরেজ পুলিশ বিদ্যালয়ে আগমন ঘটে।তাঁদের অনুসন্ধানের বিষয় ছিল,এই বিদ্যালয়ে গোপনে কোনো স্বদেশী আত্মগোপন করে আছে কি না?
কারণ সেই সময় আলিপুর বোম মামলার মারাত্মক আইনি যুদ্ধ শেষ হলেও তার রেশ কাটেনি।বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়েছে।বারীন্দ্র ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তসহ সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।এবং আশ্চর্যজনকভাবে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের হোতা অরবিন্দ ঘোষকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হয়।তিনি সহসা বিল্পবীপথ পরিত্যাগ করে গোপনে পণ্ডিচেরীতে আধ্যাত্মিক পথ বেছে নেব।ইংরেজ সরকার অনুশীলন সমিতি, স্বদেশ বান্ধব সমিতি,ব্রতী সমিতি,সুহৃদ সমিতি এবং সাধনা সমাজ প্রভৃতি রাজনৈতিক সমিতিগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।যুগান্তর পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ব্রিটিশ বিরোধী রচনা প্রকাশ করার জন্য ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে পুলিশ গ্রেফতার করে। একটা বছর জেলে ভরে রেখে দেয়। এই ভূপেন্দ্রনাথ হলেন প্রয়াত স্বামী বিবেকানন্দের ভ্রাতা।
ফলে বিবেকনন্দের মাতা ভুবনেশ্বরীদেবী একেবারে ভেঙে পড়েন।সেই সময় ডাঃ নীলরতন সরকারের বাড়িতে বাংলার মা-বোনেরা সমবেত হয়ে বিবেকানন্দ তথা ভূপেন্দ্রনাথের জননী ভুবনেশ্বরী দেবীকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রশস্তি পত্র তুলে দিয়ে সংবর্ধিত করা হয়।সেই পত্রটি ছাপিয়ে নানা স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।তাতে লেখা ছিল

সময়োচিত সম্ভাষণ পুরঃসর নিবেদন, 
আমরা কতিপয় বঙ্গনারী যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদভার লইয়া আপনাকে অভিনন্দন করিতে আসিয়াছি।আপনার পুত্র অকুণ্ঠিত সাহসভরে স্বদেশের সেবা করিতে গিয়া রাজদ্বারে যে নিগ্রহপ্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাতে আমরা প্রত্যেক বঙ্গনারী অসীম গৌরব অনুভব করিতেছি।পতিত জাতি ক্ষীণপুণ্য,হৃত ধর্ম ও লুপ্ত গৌরব পুনরায় লাভ করিতে গিয়া পদে পদে যখন তীব্র অপমান ভোগ করেন,তখন সে নিগ্রহ উজ্জ্বল মণির ন্যায় জাতীয় জীবনের শোভাবর্ধন করিয়া থাকে।বিধাতার শুণ বরে আপনার পুত্র অদ্য যে স্পৃহণীয় আভরণ অর্জন করিয়া আসিয়াছেন তাহার দীপ্তিতে কেবল আপনার কুল পবিত্র নহে,সমগ্র বঙ্গদেশ আলোকিত হইয়াছে। আপনার পুত্রের ন্যায় নির্ভীক স্বদেশসেবক পুত্র বঙ্গনারীর অঙ্কে অবতীর্ণ হউক,এই আশীর্বাদ অদ্য আমরা বিধাতার নিকট ভিক্ষা করিতেছি।"
ইতি
বঙ্গমহিলাগণ
বাংলা ২৪/৪/১৩১৪

এইকথাগুলোর মধ্যে 'স্বদেশসেবক' কথাটি কুমারের খুব ভালো লেগেছিল। সে যখন এই চিঠিটি পড়ার সৌভাগ্য পায়,তখন তার সর্বাগ্রে মায়ের কথা মনে পড়েছিল।সেও যদি স্বদেশসেবক হয়ে যায়,তাহলে তার মা কি এইভাবে গর্ব অনুভব করবে? তার মাও কী তাকে অন্তর থেকে আশীর্বাদ করবেন!
চিঠির শেষ বয়ানে কী অপূর্ব আলোকিত আশা ব্যক্ত," আপনার পুত্রের ন্যায় নির্ভীক স্বদেশসেবক পুত্র বঙ্গনারীর অঙ্কে অবতীর্ণ হোক"
সত্যি তো এখন দেশমাতা এই ধরণের সন্তান চায়,তাই তো বঙ্গদেশের অবগুণ্ঠনিত মা-বোনেরা প্রকাশ্যে এই আশা ব্যক্ত করেছে।
কুমার বিছানায় মধ্যে ছটপট করে।কী একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের ভেতর। কিন্তু সে তো কলকাতায় এসেছে পড়াশোনা করতে, পড়াশোনা শেষ করে চাকুরী নিয়ে টাকা উপার্জন করে সংসারের হাল ফেরাতে!
এই রকম পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে পুলিশ আসে। তল্লাশি ও অনুসন্ধানের নামে ইংরেজি চাকুরে পুলিশ কী অপমানই করেছিল একজন শিক্ষককে।তাঁকে ডেকে দীর্ঘসময় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।এবং তাঁর কোমরে যন্ত্রণাজনিত কারণ চেয়ারে বসতে গেলে লাথি মেরে চেয়ার ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই কাজ কোনো ইংরেজ করেনি সেদিন,করেছিল একজন বাঙালি।পুলিশের চাকুরীতে ঢুকে সেও স্বদেশবাসীকে অপর কোনো ইংরেজের মতো নিজের স্বাজাতিকে ঘৃণা করত,অত্যাচার করত এবং ইংরেজ শাসনকে স্বর্গ বলে গর্ব করত।
সেদিন কুমার এতোখানি আঘাত পেয়েছিল অন্তরে,রাতে কিছুই খেতে পারেনি, ঘুমোতে পারেনি ভালো করে।

আরে কী হল? কুমার? ঘুমের মধ্যে মানুষ কাঁদতে পারে নাকি? গঙ্গাধর প্রশ্ন করে উঠল।

কুমার বিছানায় একপাশে চোখ বন্ধ করে শুয়ে এইসব কথা চিন্তা করছিল,কখন যে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে যাচ্ছে, সে নিজেই বুঝতে পারেনি!
গঙ্গাধরের কথায় তার ভাবনার স্তর ছিন্ন হল।
সে অতি দ্রুত চোখ মুছে নিল,কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠল না!
গঙ্গাধর কাছে গিয়ে একটু চমকে উঠল,বলে উঠল,আরে কুমার,একি! পিঠে এ কীসের দাগ?একেবারে চাকা চাকা লাল! এ বাবা! কী হয়েছে? 

কুমার এবার ধড়পড় করে উঠে বসল এবং হাতের কাছে পিরানটা নিয়ে গাটা ঢেকে নিল।

আরে কী হয়েছে বল? এ তো দেখছি, কেউ যেন চাবুক মেরেছে!  নর্ম্যাল স্কুলের ছাত্রকে মারধর, এ তো অসম্ভব ব্যাপার।কী হয়েছে ভাই?

কিছু নয়, আমি ঠিক আছি মৃদুকণ্ঠে বলে উঠল কুমার।

কিছু নয় বললেই হবে,নিশ্চিত কিছু হয়েছে, কে মেরেছে আমায় বল? প্রিন্সিপালকে জানিয়ে পুলিশ কে জানানো হবে।

আবার সেই পুলিশ!  ইংরেজ পুলিশ। 
কুমার ঘৃণায় নাক কুঁচকে গেল,সে চেঁচিয়ে উঠল,দোর্ দোর্ রাখ তোর ইংরেজ পুলিশ, ছিঃ ছিঃ ওদের পায়ে পড়ার চেয়ে আমি হাজার গুণ মার খেতে রাজি। 

গঙ্গাধর চমকে উঠল।
কুমারের জ্বলজ্বলে চোখ দেখে সে থমকে গেল।
কুমারের মতো স্থিরচিত্তের যুবকের এই অস্থিরতা তার কাছে অবাক করার মতো ব্যাপার।
গঙ্গাধর আবার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল,সেই সময় অবিনাশ বলে একটি ছাত্র ঢুকল।

আরে ভাই সব, দারুণ একটা সংবাদ আছে,এটি বলে তার মুখেচোখে দারুণ উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে। 

কী? জিজ্ঞেস করল গঙ্গাধর। 

রাজার বাড়ি থেকে এসেছে নিমন্ত্রণ। 

রাজার বাড়ী

হ্যাঁরে,নববর্ষের এই সূচনায় ভারতসম্রাট পঞ্চম জর্জ আসছেন কলকাতায় তাঁর জন্য বিরাট সংবর্ধনা ব্যবস্থার আয়োজন করা হয়েছে, বাপ্ রে বাপ! ভাবতে পারিস, কী এলাহি ব্যাপার।

একথা শুনেই গঙ্গাধর আড়চোখে একবার দেখে নিল কুমারের দিকে।দেখল,তার দু’চোখে যেন কেউ জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে দিয়েছে!

অবিনাশ বলেই চলল,আরও শোনরে,আমাদের স্কুল সম্মানে আমন্ত্রিত,সেদিন ইংরেজ পুলিশ স্কুলে এসেছিল,ইন্সপেকশনে,তাতে তাঁরা দারুণ সন্তুষ্ট। তাই নর্মালের শিক্ষক-ছাত্ররা সেই সভায় যাওয়ার সৌভাগ্যলাভ করেছে,

সৌভাগ্য না কচুর মাথা! বলে উঠল,কুমার দাঁতে দাঁত চেপে...

কী বললি?

ও কিছু বলেনি! তুই বল? তাড়াতাড়ি  বলে উঠল গঙ্গাধর। 

ওহ্ আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, আমাদের মতো শেয়াল-কুকুরের দেশে সত্যিকারের এক সিংহ আসছে,তাঁকে কাছ থেকে দেখা যাবে, তাঁর কথা শোনা যাবে,এতো বিরাট ব্যাপার,ভাবা যায়,স্বপ্নের মতো!  এই আমন্ত্রণ ক'জনের ভাগ্যে ঘটে,আমি তো ভোর থেকে চলে যাবো।

তা বেশ,শুনলাম 

আচ্ছা, এই বলে অবিনাশ চলে যাচ্ছিল,তারপর আবার ফিরে এসে কুমারের সামনে এসে দাঁড়াল। ওহ্ কুমার তোকে প্রিন্সিপাল ডেকেছেন,তোর জন্য দারুণ খবর আছে।
ব্যাস বলেই চলে গেল।
গঙ্গাধর তো অবাক।
কুমার আবার কী করল? সে অপরিমেয় কৌতুহলে ছুটে গেল কুমারের সঙ্গে।
প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে কুমার দাঁড়িয়ে রইল।
প্রিন্সিপাল একটি মোটা ইংরেজি বই পড়ছিলেন।চোখে তুলে কুমারকে দেখলেন।

তিনি বলে উঠলেন, হ্যাঁ,কুমারচন্দ্র তোমার নাম?

আজ্ঞে 

আচ্ছা, শোনো, তোমার ওপর একটা গুরু দায়িত্ব দেবো,এমন দায়িত্ব খুব কমজনই পায়

বলুন?

রেড রোডের পাশে গড়ের মাঠে ভারতসম্রাটের সংবর্ধনা আয়োজন করা হয়েছে। এটাই এখন সমগ্র ভারতবর্ষের প্রধান সংবাদ।এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাটা কারও জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। 

কুমার নীরব।
পাশে দাঁড়ানো গঙ্গাধর বলে উঠল,হ্যাঁ স্যর, হ্যাঁ স্যর।

ঠিক আছে, শোনো কুমার,প্রাথমিক বিভাগের কুড়িজন ছাত্র তুমি পছন্দ করে নাও,এবং তাদের লিডার হয়ে তুমি সেই সভায় নিয়ে যাবে।তারা যে সুশৃঙ্খলভাবে সভায় যায় এবং সম্রাটের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদান করে।ঠিক আছে?

কুমার আবার নীরব। 
গঙ্গাধর বলে উঠল,হ্যাঁ স্যর,এটা তো খুব... 
প্রিন্সিপাল আঙুল দিয়ে গঙ্গাধরকে চুপ করিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন,কী কুমার, এই কাজ তুমি পারবে তো?বুঝতে পেরেছো তো কাজের গুরুত্ব! 

কুমার এবার স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।মুখে কিছুই উচ্চারণ করল না।

ঠিক আছে,যাও এইসব কাজে কোনো অন্যথা নয়।

বাইরে বেরিয়ে গঙ্গাধর বলে উঠল,কুমার একটা কথা মাথায় রাখ,এটি কিন্তু বড় ব্যাপার।স্কুলের মান-মর্যাদা নির্ভর করছে,তুই এখন ই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাচ্চাদের প্রস্তুতিতে লেগে যা

না,আমি পারব না।

কেন?

আমার যাতে মন সায় দেয় না,সে কাজ করতে পারি না,এতে আমার মন  নেই। 

আরে বাবা,এসব বলে লাভ নেই,স্বয়ং প্রিন্সিপালের হুকুম,যাবি কোথায়?

যাব না।কুমারের কণ্ঠে দৃঢ়তা।

মানে?

আমি সম্রাটকে দেখতে যাবো না,সম্মান দেখাতে পারব না,ওঁরা আমাদেরকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না,এর একটা প্রতিবাদ হওয়া চাই

তাই,তাহলে কী করবি?

এবার কুমার স্কুলের সামনের ছোট বাগানের একটি গাছের নিচে বসে পড়ল।গঙ্গাধরও তার পাশে বসল।
কুমার বলে উঠল,ডি. এল রায়ের এবছর একটি নাটক বের হয়েছে না!

হ্যাঁ,জানি তো, চন্দ্রগুপ্ত

তাতে একজায়গায় ছিল,গ্রীক সম্রাট সেকেন্দার শাহ এদেশের কথা বলতে গিয়ে বলছেন,সবার উপরে এক জাতি আছে,তাদের মুখে শিশুর সারল্য, দেহে বজ্রের শক্তি,চক্ষে সূর্যের দীপ্তি, বক্ষে বাত্যার বাতাস।এ শৌর্য পরাজয় করে আনন্দ আছে।পুরুকে বন্দি করে আনি যখন,সে কি বললে জানো?
সেলুকাস জিজ্ঞেস করলেন,কী সম্রাট?
তখন সেকেন্দার কী বলেছিলেন? 

কী? জিজ্ঞেস করল গঙ্গাধর।

আমার কাছে কীরূপ আচরণ প্রত্যাশা করো? পুরু নির্ভিক নিষ্কম্পস্বরে উত্তর দিয়েছিল,রাজার প্রতি রাজার আচরণ। 
সেকেন্দার পর্যন্ত চমকে উঠেছিলেন,এবং মুগ্ধ হয়ে পুরুর রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ,তা তো বুঝলাম,এখানে তুই কী বলতে চাইছি,রাজা এখানে একজনই,ইংরেজ, আর সবাই প্রজা তস্য প্রজা।

না

তাহলে?

আমি এইসব রাজা-প্রজা, শাসন-শোষণের কথা বলছি না,শুধু  চাইছি মানুষের কাছে মানুষের ব্যবহার।

বলেই কুমার উঠে চলে গেল।

যথারীতি ১ লা জানুয়ারি ভারতসম্রাটের সংবর্ধনার দিন এসে গেল।এবং দেখা গেল,কুমারচন্দ্র অনুপস্থিত। অধ্যক্ষ সকলের সামনে বললেন,কুমারচন্দ্র হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে,তাই যেতে পারবে না,তার পিঠে একটু ঘায়ের মতো হয়ে গেছে, চুপচাপ শুয়ে আছে।

এক গঙ্গাধর ছাড়া প্রকৃত সত্যি কেউ জানল না!সে যখন ছাত্রাবাসে নিজের কক্ষে ফিরে এলো,তখন দেখল কুমার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে,উচ্চারণ করে চলেছে...

"বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান"

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments