জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে --৯/ রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৯

বাবার আয় বলতে বিঘা কয়েক জমির ফসল। পাশের গ্রাম খড়কুশমায় ইংরেজ আমল থেকেই নিয়মিত বাজার বসে। এই বাজার ঘিরে রয়েছে নানারকম দোকান। মুদিখনা, মিষ্টির দোকান, মনোহারি দোকান, জামাকাপড়ের দোকান, ফল দোকান, রেডিমেড জামাকাপড় ছাড়াও সাড়ি ছিট কাপড় ইত্যাদির একাধিক দোকান ছিল। বাবার এই বাজারে কাটা কাপড়ের দোকান দেওয়ার কোনও সুযোগ ছিলনা। তাই অনেকের পরামর্শে আলিকাকা, পলটুকাকা ও আরও জনাদুই কারিগর  রেখে একটি  টেলারিং সপ খোলেন। ভালো রোজগার হত। সে কালে যৌথ পরিবার ছিল, পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে একটা দৃঢ় বন্ধন ছিল। কেনা পোশাকের চল ছিলনা বললেই হয়। গরিবগুরবো মানুষেরা হাটেবাজারে ছেলেমেয়েদের জন্য সস্তায় রেডিমেড  জামাকাপড় কিনত, ওরা বলত, ‘হেটোজামা’। সচ্ছল পরিবারে টেলারের কাছে ছেলেমেয়েদের মাপ দিয়ে দোকান থেকে সেই পরিমাণ দৈরঘের শার্টপ্যান্ট ও ফ্রকের কাপড় কিনে সেলাই করতে দেওয়া হত। বাড়ির বৌদের ভিন্ন রঙের কিন্তু  একরকম পাড়ের শাড়ি কেনা হত।
      ধিরে ধিরে দিন বদলের সাথে সাথে ফ্যাশন ও মানুষের পছন্দ বদলাতে  থাকল। ভাঙতে লাগল যৌথ পরিবার। সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলে গিয়ে খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো, মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনেদের মধ্যে একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। কার ড্রেস কার থেকে ভালো? কেনা পোশাকের দিকে মানুষের ঝোঁক বাড়তে লাগল। ফলে গ্রামাঞ্চলের টেলারিং সপের কারিগরদের রোজগার কমে গেল। এক সময় দোকান বন্ধ করে দিতে হল। সংসারে টানাটানি দেখা দিল। আমাদের এতগুলো ভাইবোনের পড়াশোনা, খাওয়া দাওয়া, অন্যান্য খরচ মা কীভাবে সামাল দিতেন জানিনা।
      বাবা যে গানবাজনার চর্চা করতেন, গ্রামে ফেরার কিছুদিন পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। ভোরে উঠে বাবার রেওয়াজ করা গ্রামের লোকের পছন্দ ছিলনা। আড়ালে তারা বলতে লাগল, ভোরেরবেলা ফজরের নামাজের সময়  নামাজ না পড়ে আ.....আ....করা, পাপ। বাবার কানে এ কথা পৌঁছালে সেই দিনই হারমোনিয়াম তুলে দিয়ে রেওয়াজ বন্ধ কনে দেন। খুব ছোটবেলার কথা আবছা আবছা মনে পড়ে, বৈঠকখানার মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে গানের আসর বসত। পাশের পাড়ার গজুকাকা(গজু সিং) বাবাকে তবলায় সঙ্গত করতেন। আমি পান দিতে যেতাম। বাবার নেশা এইটুকুই, সুপুরি আর চুন দিয়ে পান  আর গান।
    বলতে গেলে ছোটবেলার কোনো ইচ্ছেই আমার পূরণ হয়নি। সোভানারাদির গান শুনে গান শিখতে ইচ্ছে হয়েছিল, তা হয়নি। সাইকেল শেখার ইচ্ছেও পূরণ হয়নি। তখন সবে পুরনো সাইকেলটা বিক্রি করে বাবা নতুন সাইকেল কিনেছেন। বড়দা সেই সাইকেলে চড়ে গড়বেতার কলেজ যায়। আমি নতুন সাইকেলে চোট  লাগিয়ে দিতে পারি বলে দাদারা আমাকে ছুঁতেই দিতনা। শেষে ভাবলাম, কবিতা লিখে মেজকাকার মত কবি হব। খাতা পেন নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই ছন্দ মেলাতে পারলাম না। পরে চেষ্টা করব ভেবে রেখে দিলাম। তবে মায়ের বকুনি খেয়ে সূচিকর্মটা শিখে ফেলেছি। প্রথমে শোভানারাদির কাছে  আসন সেলাই শিখি, তারপর মামাবাড়ি গিয়ে ছোটোমামি আর ছোটমাসির কাছে নানা ধরনের এমব্রয়ডারি শিখে ফেলেছি।


    একবার বড়পিসি ছেলেমেয়ে, কাজেরলোক সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে মাকে অনেক করে বলে গেলেন, আমাকে যেন একবার পিসিরবাড়ি পাঠানো হয়। সেবার(১৯৬৭) সম্ভবত পঞ্চমশ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার পর মেজদা আমি ও ছোটঠাকুরদার দুইছেলে পিসিরবাড়ি রওনা হলাম। তখন সবে কাঁসাই নদীর বুকে নতুন ব্রিজের কাজ শুরু হয়েছে। পুরনো ব্রিজ দিয়ে খুব আস্তে বাস ও অন্যান্য যান চলাচল করত। বোম্বেরোডের কাজ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বাস  চলাচল শুরু হয়নি। এই রোড তৈরির সময় পিসিদের অনেক জমি সরকারকে বিক্রি করতে হয়েছিল। আমরা চৌরঙ্গীতে বাস থেকে নেমে বোম্বেরোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। তখন তো এসব কল-কারখানা গড়ে ওঠেনি। চৌরঙ্গী থেকে বড় পিসিদের পুকুর পাড়ের বাঁশ বাগানটা দেখা যেত।
    পিসিদের তখন ধান ঝাড়ার কাজ চলছে। জনা দশেক আদিবাসী মহিলা ধান ঝাড়ছে। পিসেমশাই তদারকি করছেন। খামারে বড় বড় কোঠাবাড়ির মত ধানের পালুই। পিসিদের পুকুরগুলোও বেশ বড় বড়। পিসির তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড়মেয়ের স্বামী প্রথমে ঘরজামাই ছিলেন। পরে পিসেমশায় এই গ্রামেই বাড়ি করে দিয়েছেন, এখন সেই বাড়িতে বাস করেন। দিদির ছেলেমেয়ে অনেকগুলি। পিসির  বড়ছেলে কেরামত আলির ডাকনামটি বেশ অদ্ভুত, ‘আমা’। তাঁরও আনেকগুলি ছেলেমেয়ে।  তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে বাবার বাড়ির একঅংশে ভিন্ন থাকেন। বৌদিকে দেখতে খুব সুন্দর। পিসির মেজমেয়ে হাজরা আমার সমবয়সীই মনে হয়।  ওর সঙ্গে খুব ভাব হয়ে যায়। তবে এরা বাইরে খুব একটা বের হয়না। স্কুলেও  মেয়েদের  পাঠানো হতনা। গৃহ শিক্ষক রেখে বাড়িতেই পড়ানো হত। মেয়েদের  লেখাপড়া করা প্রয়োজন মনে করা হত না। কোনরকমে লিখতে পড়তে পারলেই হল। এঁরা বেশিরকম প্রাচীনপন্থী ছিলেন। এছাড়াও এই পরিবারে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই রাখার রেওয়াজ ছিল। পিসির বড়মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই করে রাখা হয়েছিল। পরে বাইরে বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। পিসির দেয়রের মেয়ে-জামাই একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকে। মেয়েরা পরিবারে কিছুটা হলেও অবহেলিত ছিল। পিসির এক জ্যাঠতুতো ভাশুরের ছেলে পান থেকে চুন খসলেই বৌকে ধরে পেটাত। বউটি কোনো প্রতিবাদ করতনা মুখবুজে সহ্য করত। মার খাওয়ার পরেও সকালবেলা চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে স্বামীর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াত। স্ত্রীকে পেটানোটা যেন স্বামীর অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
    বড়পিসির  বাড়িতে সেইসময় কেরামতদার শ্যালিকা  এসেছিলেন বৌদির সংসার সামাল দিতে। কারণ বউদি সেসময় আঁতুড় ঘরে ছিল। বৌদির এই বোনের নাম আমার মনে নেই, আমি পরিদি বলতাম।আমার মাথা থেকে তখনো পরির ভূত নামেনি। এই পরিদি আমাকে খুব ভাল বাসত। বেশ আনন্দেই ছিলাম। তবে  একজন খুব বিরক্ত করত। ওই বৌপেটানো ভদ্রলোকের শ্যালক দিদির বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ত। আমাকে একা দেখলেই গান শুরু করত, ‘রূপের জন্য নাম রেখেছি সুন্দরী’......। আমি ভীষণ লজ্জা পেতাম। চেষ্টা করতাম যাতে ওর সামনে না পড়ি, তবুও কীভাবে যে সামনে পড়ে যেতাম.....। এখানে এসে প্রথম জানলাম মানুষ ভূমিহীন হয়। ভূমিহীন বহু মানুষকে পিসেমশাই জমি দিয়েছেন ঘর বানিয়ে থাকার জন্য।
      আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেল, খড়গপুর থেকে কেরামতদা  সবার জন্য জামাকাপড় কিনে এনেছে।  আমার জন্য শুধু ফ্রক নয়, স্যান্ডেল, চুড়ি,  চুলের ক্লিপ, ফিতে, নানারকম প্রসাধন সামগ্রী কে যেন কিনে নিয়ে এসেছেন। এর আগে একসাথে এত নতুন জিনিস কেউ আমাকে দেয়নি। পরেরদিন পিসি বললেন, বেবি আরও কয়েকটা দিন আমার কাছে থাক, সামনে পৌষ সংক্রান্তির মেলা, তারপর বকরিদ(ইদুজ্জহা)।এগুলো গেলে তারপর এসে নিয়ে যাবি। দাদারা বাড়ি চলে গেল।
    পৌষ সংক্রান্তির দিন বড় পিসির মেজছেলে বজলুদার সঙ্গে কাঁসাই নদীরধারে মেলা দেখতে গেলাম। সঙ্গে আর একজন ছিল, সম্ভবত বজলুদার খুড়তুতো ভাই। মেলায় গিয়ে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া, এতো জিনিস! বজলুদা বারবার জিজ্ঞেস করছে, কী নেবে বল? আমি তো লজ্জায় কিছু বলতেই পারছি না। তবে আমাকে আনেককিছু কিনে দিয়ে ছিল। বকরিদের সময় আবার ফ্রক, শালোয়ার, আরও কী কী সব কিনে দেয়েছিল পিসতুতো দাদারা।
    পিসিদের খড়গপুরেও বাড়ি ছিল। তার কিছুটা অংশে এক শিখ পরিবার ভাড়া থাকতেন। কারো শরীর খারাপ হলে রিকশায় করে ওই বাড়িতে গিয়ে ডাক্তার দেখানো হত। ডাক্তার বাড়িতে এসে দেখতেন, ডাক্তারের চেম্বারে যেতে হত না। পিসিদের বাড়িটা ছিল পিরবাবার মাজারের কাছে। একবার সামান্য জ্বর হওয়াতে পিসির সঙ্গে ওই বাড়িতে গেছলাম। আরো কে কে যেন গেছল। বাড়ির ছাদে উঠতেই একটা কবরস্থানটা দেখতে পেয়েছিলাম। একটি কবরে  দেখলাম্, একটা সাইনবোর্ড লাগানো আছে। তাতে কী লেখা ছিল, তা পড়তে পেরেছিলাম কিনা আজ আর মনে নেই। তবে জেনেছিলাম ১৯৬৫ সালে ভারত  পাকিস্তান যুদ্ধের সময় একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান সীমানা অতিক্রম করে কলাইকুণ্ডা ধ্বংস করার চেষ্টা করলে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। বিমাটি একটি আমগাছে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে আগুন ধরে যায়। ফলে এই যুদ্ধবিমানের কমান্ড আফজল খানের মৃত্যু হয়। সাইনবোর্ড লাগানো কবরটি সেই কমান্ড আফজল খানের। বয়স  কম হলেও কৌতূহল বেশি ছিল, তাই দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবর্তনের দিকেও কমবেশি নজর থাকত। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। মনে পড়ে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেছল। আমরা ছোটরাও স্কুলে এসব নিয়ে আলোচনা করতাম। একবন্ধু বলেছিল, জানিস? ইন্দিরা গান্ধী বাবার চিতাই ঝাঁপ দিতে গেছল? যাই হোক, অস্থায়ী  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গুলজারিলাল নন্দকে। এর পর প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। একটি বইয়ে পড়েছিলাম লালবাহাদুর খুব অভাবের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। ওনার মায়ের নাম ছিল দুলারী। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির চুক্তিপত্রে সই করার  জন্য(যাকে ‘তাসখন্দ চুক্তি’বলা হয়) উজবেকিস্থান গিয়ে  সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। এই মৃত্যু সবার কাছে খুবই আকস্মিক ছিল। শুনেছিলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেহ বিমানে তোলার সময় পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী আইউব খান কাঁধ দিয়েছিলেন। এবারেও গুলজারিলাল নন্দ আস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হন।   
    একটা কথা বলা হয়নি। বড়পিসি ছিলেন পিসেমশায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী বদরুননেশা বিবি ছিলেন নাসির খানের বোন। নাসির খান হলেন সেই ব্যক্তি, যার দান করা জমির ওপর খড়গপুর কলেজ নির্মিত হয়েছিল। একমাত্র সন্তান আঞ্জুমান আরার জন্মের পরেই বদরুননেশা বিবির মৃত্যু হয়। তার পরেই পিসেমশাইয়ের সঙ্গে বড়পিসির বিয়ে হয়। আগেই জানিয়েছি মুসলিমদের পিসতুতো মাসতুতো ভাইবোনে বিয়ে বৈধ। পরবর্তী কালে পিসেমশায়ের বড়মেয়ে, মানে নাসির খানের বোনের মেয়ে আঞ্জুমান আরাকে নাসির খান পুত্রবধূ করে নিয়ে যান। ওনাদের অনেক বড় পরিবার এক সঙ্গে বসবাস করার জন্য মেদিনীপুর শহরের জজকুঠিটি কিনেছিলেন। একদিন পিসির বড়ছেলে কেরামতদা আমাকে সঙ্গে করে জজকুঠি দেখাতে নিয়ে গেলেন। এতবড় বাড়ি আগে কখনো দেখিনি। ওই দিদির মেয়ে আমাকে ঘুরিয়ে ওপর নিচ, বাগান ছাদ দেখাল। সন্ধ্যাবেলা পিসিরবাড়ি ফিরে এলাম। তার কয়েকদিন পর মেজদা আমাকে নিতে এলো। বাড়ি ফেরার সময় খুব মনখারাপ হয়েছিল।
                                            ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments