জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১৩ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-১৩

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

নিশীথের পালা কোল ছুঁয়ে আলগোছে

প্রহরের পথ ধরে আমি হেঁটে চলি...

জামালপুরে থাকাকালিন পাশের বাড়ির শেলু বেবুর বাবা ছিলেন নিমাই গুহ আর ওর বড় অবিবাহিত জ্যেঠু মুকুল গুহ। উনি ছিলেন অন্ধ। একসাথে থাকতেন। উনি গান আর সেতার শেখাতেন। আরও নানা রকম বাদ্য যন্ত্র। ওনার গানের স্কুলের ছাত্রী ছিল আমার ছোদ্দির বান্ধবী, নাম মিনতি। হঠাত ক্যান্সারে মারা যায় মাত্র সতেরো বছর বয়সে। তাই শেলুর জ্যেঠু মুকুল গুহ 'মিনতি' নামে গানের স্কুল খুলেছিলেন। মেয়ের মত ভালোবাসতেন ওকে। কারণ ওরা নাকি খুব গরীব ছিল। আমিও ঐ স্কুলেই নাচ শিখতাম, আর ছোদ্দি সেতার বাজানো শিখত।

শেলুর বোন বেবু কে একেবারে 'কাবুলিওয়া'লা” সিনেমার মিনি এর মতন দেখতে ছিল।

--কি করে বুঝলে? 'কাবুলিওয়ালা'” দেখেছিলে?

--না। তখন দেখিনি। ছোট ছিলাম তো। সিনেমা কি তখন দেখে নাকি? সিনেমা দেখতাম সেই যে কাপড় ঢাকা দিয়ে টিনের বাক্সে চোখ রেখে ... সেই সিনেমা। মাত্র কটা পয়সায় মুম্বাই, কলকাতা, চীন, জাপান, লন্ডন দেখা যেত। তখন তো আমেরিকার এত নাম ছিল না। কি ভীষণ আনন্দ হত কি বলব। কে আগে দেখবে এই নিয়ে একটু কান্নাকাটিও হত।...মনে হত যে আগে দেখবে সে বোধহয় বেশী দেখে ফেলবে। তিনজনের বেশি তো একসাথে দেখা যেত না। তিনটেই দেখার জানলা ছিল। একটা কাঠের দো-পায়া টুলের ওপরে একটা টিনের বাক্স রাখা হত তাতে তিনটে জানলা থাকত। তারপর একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হত, আমরা সেই কাপড়ের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে জানালা করা টিনের বাক্সে চোখ রেখে দেখতাম। গান হত আবার একটা চোঙা থেকে। তুমিও হয়ত তাই দেখতে, তাই না? হেসে ফেলল শিমুল। দেখতে দেখতে গান ও শোনা যেত- “ইয়েহ জাপানি গুড়িয়া...” ইশ! যদি ফিরে পেতাম সেই দিনগুলো।

একবার এক কাবুলিওয়ালা এসেছিল আমাদের পাড়াতে-বেবুকে দেখে বলেছিল, “খোঁকী? হমারা মিনি হোগী?” আমরা ভয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম।

ওদের মা আর আমার দিদিয়া মিলে খুব বকেছিল, “বলেছিল ওরা ওই ঝোলার মধ্যে করে ধরে নিয়ে যাবে যেদিন ওদের দেশে, বুঝবি? আমাদের ডাকলেও আর আমাদের কাছে আসতে পারবি না।”

তবে থেকে কাবুলিওয়ালারা আসলেই একেবারে সোজা ঘরের ভেতর। সেইসময় কাবুলিওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় আখরোট, কাজু, পেস্তা বিক্রি করতে আসত। আর আসত 'হরেক বাবু ছয়-আনা/ লে যা বাবু ছয়-আনা।” একটা কাঠের ট্রের মধ্যে করে চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখা আর চিনির গজা। এক টাকায় দিত একটা ঠোঙা। কিনতাম আমরা। এই কাঠের ট্রে-টা একটা মোটা দড়ি দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে ঠিক পেটের কাছে রাখত।

মিতান আর কালাচাঁদ, জমজ ভাই বোন। সব সময় ওরা ঝগড়া করত আর সেই ঝগড়া আমাদের থামাতে হত। আমরা তখন জমজ মানে জানতাম না। ভাবতাম জমজ আবার কি? কাউকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করিনি কোনদিন, এই ছিল আমাদের সহজ সরল শিশুবেলা। আর ছিল শুভা আর ডাবি। ওরা এক বাড়িতেই থাকত। ডাবি থাকত শুভার নিঃসন্তান বড় জ্যেঠুর কাছে। ও শুভার পিসির মেয়ে। আমরা ডাবিকে ডাকতাম, “ডাব ডাব ডিরবিরি ডাব”। আর ও রেগে যেত। তেড়ে তেড়ে আসত। আরও একটা ঘটনা আছে। তবে দুঃখের কথা কি বলতো? ডাবির বড় মামার যখন বেশি বয়সে বাচ্চা হল, ডাবিকে আবার তার মা-এর কাছে রেখে এসেছিলেন। যাবার সময় কি কান্না ওর। ও মামা মামীকে ছেড়ে যাবে না কোন্নগরে মা বাবার কাছে । মানুষ কি স্বার্থপর ভাবো। এখন ওই সব ভেবে খুব দুঃখ লাগে।

– “তোমার হৃদয়পুরে কতগুলো স্টেশন আছে, বলো তো শিমুল?”

-এই তো সবে শুরু হল।

পড়াশুনায় ডুবে গেলাম। মাত্র ছয়মাস মুঙ্গের রোডের এম ই(M.E) স্কুল এ পড়েছি। সেই ছয় মাসের মধ্যেই গেছিলাম হরিদ্বার, দেরাদুন, মুসৌরী। রেলের স্কুল ছিল তো। স্কাউট থেকে 'বুলবুল' গ্রুপ এ গেছিলাম। এখনও মনে আছে। বাবা কিছুতেই যেতে দেবেন না কারণ, আমি নাকি স্লিপ ওয়াকার ছিলাম। ঘুমের মধ্যে হাঁটতাম। তাকে নাকি 'নিশি' ডাক বলে। আর ছিলাম স্লিপ টকার ও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলতাম। তাই আমাদের মুঙ্গের রোডের বাড়িতে সব ঘরের পার্টিশন ওয়ালগুলো কেটে দরজা করে রাখা হয়েছিল।

ভারতের সব জায়গা থেকেই বুলবুল, গাইড, স্কাউট-রা এসেছিল। রাত্রে ক্যাম্প ফায়ার হত। এক একদিন এক একটা প্রোগ্রাম হত। একটা গান এখনও মনে আছে। “ রো রো রো দ্য বোট।” পুরোটা মনে নেই। আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গাওয়া হত, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পূর্ণ করো”। মাঝখানে আগুন জ্বেলে সবাই গোল হয়ে বসতাম। আগে মেয়েরা, পেছনের দিকে ছেলেরা। আমাকে সব সময় নজরে রাখত আমার দিদিয়ার বান্ধবী মীরাদির ছোট ভাই। প্রদ্যোত দত্ত। কেউ কিছু বললেই বলত। 'ওকে দেখাশুনা করতে বলেছে বলেছে আমার মা। আমাকে ওকে দেখতেই হবে। দুষ্টুমি করলেই বলে দেব ওর বাড়িতে।' আমার মনে হয় দিদিয়া বলে দিয়েছিল তার বান্ধবী মীরাদিকে।

--একটু চোখ মটকে পলাশ বলে ফেলল, “কি কাণ্ড!”

--বাড়িতে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।

-সে আমি জানি, শুনেছি তো তোমার 'বটি' মানে আমার প্রিয় বন্ধুর কাছে। তাহলে ঘোড়া রেসে আমিই ঠিক চালিয়েছি ঘোড়া... কি বলো?

--ধ্যাত ! কথার মাঝে বড্ড কথা বলো। খেই হারিয়ে ফেলি। ছোটবেলা ওরকমটি হয় সবারই। তখন কি আর জানতাম? চোখ গোল গোল করে বলে উঠল শিমুল। অস্পষ্ট চাঁদের নিচে উন্মত্ত গোপন ধন খোঁজে পুরুষেরা সেই ছোট বেলা থেকেই। শুনে পলাশ একটু লজ্জা পেল, মনে হয়। তখন ঠিক নিভন্ত দুপুর। দুপুর, মানে দুখানা... বহুকাল বাদে তোমাকে পেয়েছি, তোমাকে পেয়ে আমাকেও পেয়েছি।

--বিহারে 'ছট' পূজা হয়, শুনেছ কোনদিন।

--না শুনি নি তো। 'ছট পূজা' আবার কি?

--ছট পূজা হল সূর্য পূজা। বিহারের সেই কনকনে ঠাণ্ডার ছট পূজায় আমরা ভোরবেলা মঞ্জরীদের ট্রাকে করে জামালপুরের গঙ্গায় যেতাম। ওদের বাড়ির যিনি সবচেয়ে বয়সে বড়ো উনি বুক অবধি জলের মধ্যে ফল-ফুলের সাজি নিয়ে দাঁড়াতেন। তারপর সূর্য প্রণাম করে পুজো দিয়ে বাড়িতে এসে নতুন জামা কাপড় পরে ওদের বাড়ি যেতাম। অনেক কিছু খেতে দিত, তার মধ্যে ঘি এ চপচপে ঠেকুয়া, রাবড়ি, তিলুয়ার চাকরি, সেমুইয়ের পায়েস এরকম সব খাবার থাকত।

--খাই নি কোনদিন 'ঠেকুয়া'। ঠেকুয়া খেতে কেমন? তুমি কত জায়গায় ঘুরেছ, তাই এত সব জানো। তোমার তো খুব ভাল ভাগ্য স্বীকার করতেই হবে। আমি তো কোথায়-ও যাই নি। আর খুব কম জনের ভাগ্যেই তোমার মতন অভিজ্ঞতা জন্মায়।

--অসাধারণ খেতে ঠেকুয়া। একবার খেলে বার বার খেতে চাইবে। ময়দা, ঘি, গুড় আর ড্রাই ফল দিয়ে তৈরি হয়। অনেকটা মালপোয়ার মতন দেখতে হয়। উফফ! মনে হয় এখনও মুখে লেগে আছে তার স্বাদ। আর হাতে ঘি চপচপে। মালপোয়ার মতন রসালো হয় না। একটু শুকনো হয়।

এইবার বাবার কথা বলি একটু। বাবা যা মজার হিন্দি বলতেন না কী বলব। আমার বেশির ভাগ গল্পে সেই সব হিন্দি কথা থাকে। ডাক্তারকাকা আসলে শুরু হতো দুজনের মজার হিন্দি। কারণ ডাক্তার কাকাও তো ছিলেন বিহারের। বাবাও ছিলেন। যে ছেলেটা কাজ করত বাড়িতে, ওর সাথে বাবার হিন্দি কথা হত। “বেশি মুখের ওপর কথা বললে সোজা তেরা বাবার বাড়ি ভেজ দেগা। হুম...”

কিন্তু বাবা ইংলিশটা বেশি বলতেন। ডাক্তারকাকা আর বাবা সকাল বিকেল মর্নিং ওয়াক আর ইভনিং ওয়াকে -সাজগোজ করে বেড়োতেন। ডাক্তারকাকু যেই বলতেন ইভনিং ওয়াক খুব ভাল স্বাস্থ্যের পক্ষে। ব্যাস! লেগে গেল দুজনের। বাবা বলতেন: "মর্নিং ওয়াক অবশ্য বেশী ভালো, বাট, ইউ সি, ভোরে ঘুম তোমার ভাঙে না। আবার হেসে বলতেন, ইট ইজ এ ডক্টর'স ডিজিজ। সব বড় ডাক্তারের ঘুম ভাঙে সকাল নয়টায়।" বলেই দুজনে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেড়াতে বেরোতেন। ছুটির দিন আমিও যেতাম ওনাদের সাথে। ফেরত আসার সময় বিশুকাকার দোকানের গরম চা, আর সিঙ্গারা জিলিপি বাবা আর ডাক্তারকাকু খেতেন আর আমি খেতাম খালি কড়কড়ে জিলিপি। আমি তো চা খাই না। সিঙ্গারা আমি খুব একটা খেতে ভালোবাসি না। জব্বলপুরে আমার মাদ্রাজী বান্ধবী প্রভার বাবা নিজেদের বাড়িতে বলতেন যে, "আমি রিটায়ার্ড করলে শিমুলের বাবার মতন ফিটফাট হয়ে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেড়াতে বেরুবো।"

--অ্যাই! আমরা বাড়ি এসে গেছি। চলো স্নান সেরে খেয়ে নি। তারপর না হয় আবার বলব, নয়ত কাল বললেও চলবে। কাল তো ছুটি অফিসের। ডিনার আর বাড়ির কাজ সেরে এসে এবার বাড়ির পেছনদিকের প্যাটিও তে গিয়ে গাছগুলোতে একটু হাত দিয়ে দেখে নি। আবহাওয়াও খুব সুন্দর আজ। জ্যোৎস্না সারা প্যাটিওতে মাদুর বিছিয়েছে। তার উপর দোলনায় বসব দুজনে পরিপাটি করে। ফোটোনিয়া গাছগুলোয় জ্যোৎস্নার আলো পড়ে একেবারে ফিটফাট।

এইবার সব সেরে এসে প্যাটিওতে ওরা এল।

-শিমুল শুরু করল...আমি বিশ্বাস করি-সংসার আমাকে দিয়েছে অনেক, আবার আমার কাছ থেকে নিংড়েও নিয়েছে বহু কিছু। না: আমি অভিমান করিনি, ওইটি পরে শরীরের সাথে মিশে গেছিল। বরং এগিয়ে গিয়েছি পরের ধাপের দিকে...কেবল একটুকরো বিশ্বাস আর জীবনের প্রতি ভালোবাসাকে সঙ্গী করে। ভাবলে মনে হয়, কী আশ্চর্য রঙিন আর কর্মময় আমার এই জীবন! কত রকমের অভিজ্ঞতা, যেন এক কোঁচড়ে কুড়িয়ে রাখা নানা রঙের নুড়ি। যখন যে-কাজটি করেছি, ছাপ রেখে যাবার চেষ্টায় মেতে থেকেছি। সেই পর্যায়ে সম্ভবত সবচাইতে বেশি সৃষ্টিশীল থেকেছি। মানুষ ঠকিয়েছে, আমি ঠকেছি। চুপ করে সহ্য করেছি, প্রতিবাদ করিনি বা বলতে পারো কাউকে জানাই নি। আমি জয়ী নই, আমি পরাজিতও নই, আমি এমনি একজন সাধারণ মানুষ। এটা আমার উপমা নয়-স্পর্শকাতরতা।

যতই শোনে, ততই আশ্চর্য হয় পলাশ। ভাবে অতীত, অপ্রাপ্য। এবার আর থাকতে না পেরে বলে উঠল-ফ্লেক্সিবল হও, বুঝলে, ফ্লেক্সিবল হও। এখন যুগ অনেক বদলে গেছে।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments