জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১৬/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১৬

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

কানপুরে কয়েক মাস থাকলেও কাজকর্মের তেমন সুবিধা হল না। এই সময়টাকে অবশ্য অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যোগীন। অবসর সময় বৃথা নষ্ট না করে ধ্যান-উপাসনায় নিমগ্ন হলেন। তাঁর তীব্র অন্তর্মুখিতা মেসোমশায়ের নজর এড়ালো না। কানপুরে এই মেসোর বাড়িতেই উঠেছিলেন তিনি। যোগীনের উচ্চ চিন্তাসম্পৃক্ত জীবনধারা স্বভাবতই মেসোর পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় নি। তিনি যোগীনের পিতৃদেবকে পত্র মারফত জানালেন--“ছেলে বড় হয়েছে, এখন বিয়ে না দিয়ে এমন করে রাখলে বয়ে যাবে” ইত্যাদি। যোগীন এসব ঘুণাক্ষরে টের পান নি। এদিকে পত্র পেয়ে তৎপর হয়ে উঠলেন নবীনচন্দ্র। তিনি দ্রুত বিবাহের ব্যবস্থা করলেন। এরপর কানপুরে সংবাদ প্রেরণ করলেন--“যোগীনকে বাটীতে পাঠাইয়া দাও, বাটীতে অসুখ।” সংবাদ পেলেন যোগীন। ভাবলেন মা বোধহয় গুরুতর অসুস্থ। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে এসে উপস্থিত হলেন গর্ভধারিণীর কাছে। কিন্তু বাড়িতে যা শুনলেন ও দেখলেন তাতে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। কোথায় অসুখ! বরং সারা বাড়ি জুড়ে চলছে কোনও এক ভাবী উৎসবের তোড়জোড়। ক্রমে বুঝলেন এই উৎসবের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি  হতে চলেছেন স্বয়ং তিনিই! পিতা তাঁর বিবাহ স্থির করেছেন! মাত্র দু'দিন বাকি আছে! এক মহাসঙ্কটের মুখোমুখি হলেন। অবিবাহিত থাকবেন এই বিষয়ে স্থিতপ্রতিজ্ঞ ছিলেন। যাই হোক তীব্র মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে পিতাকে জানিয়ে দিলেন বিবাহ তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। শুরু হল পিতা-পুত্রে তীব্র দ্বন্দ্ব। তুমুল সমস্যা সৃষ্টি হল। পিতা নবীনচন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগলেন, অবাধ্য পুত্রের মুখদর্শন করবেন না। এমতাবস্থায় যোগীন জননী পুত্রের হাত দুটি ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,“বাবা, আমার মাথা খাও, অমত করো না; কর্তার মুখ রাখ-- তিনি কন্যাকর্তাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। তুমি অমত করলে তাঁর অপমানের অবধি থাকবে না। তোমার ইচ্ছা না থাকলেও তুমি আমার জন্য বে কর।” জননীর অশ্রুমোচন মাতৃভক্ত যোগীনের অন্তর আর্দ্র করে তুলল। যোগীন বিবাহ করলেন। তবে তাঁর বৈরাগ্য ও ব্রহ্মচর্য পূর্বের মতোই বজায় ছিল। দিন যত অতিক্রান্ত হতে থাকল উচ্চ আদর্শ, উচ্চ ভাবনার জীবন সুস্পষ্টভাবে প্রতিহত হতে থাকল। ফলস্বরূপ মানসিক শান্তি বিদায় নিল প্রায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা ভাবতেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু বিবাহ করে তিনি তো প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেছেন, সুতরাং তাঁর কাছে আর যাওয়া চলে না। 

   ভবিতব্য অবশ্য অন্য ছিল। ‘ঈশ্বরের আহ্বান‘ যে কত অমোঘ ক্রমেই তা প্রমাণিত হতে থাকল। আর বিশেষ করে তিনি যেখানে চিহ্নিত পুরুষ ছিলেন। যোগীনের ভাবনা ছিল এইরকম, যে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলতে পারে না তার মতো হীন আর কে আছে? তাঁকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি আর আগের মতো ভালোবাসবেন? তিনি কামকাঞ্চনত্যাগী, আর যোগীনকে সেখানে কামিনীকাঞ্চন নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে। এই অবস্থায় ঠাকুরের কাছে গিয়ে আর কি হবে? এদিকে ক্রমে যোগীনের বিবাহের সংবাদ ঠাকুরের কানে গেল। তাঁকে দেখবার জন্য বড় ব্যস্ত হলেন। নানা জন মারফত বারবার যোগীনকে বার্তা পাঠাতে থাকলেন। যোগীন এতদসত্ত্বেও গেলেন না। কোনও উপায় না দেখে ঠাকুর এক পরিচিত ব্যক্তিকে ডেকে বললেন-“অমুকের ছেলে কি রকম লোক? কানপুরে যাবার আগে তাঁর কাছে এখানকার পয়সাকড়ি কিছু ছিল, তার হিসাবও দেয় না, ডেকে পাঠালেও আসে না। বোলো তো তাকে।” লোকমুখে এই কথা শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন যোগীন। মন্দিরের খাজাঞ্চি একটি জিনিস কেনার জন্য কিছু পয়সা দিয়েছিলেন তাঁকে। উদ্বৃত্ত চার আনা তাকে আর ফেরত দেওয়া হয় নি, কেননা বিবাহজনিত ডামাডোলের মধ্যে তিনি ভবতারিণী মন্দিরে সময় করে আসতে পারেন নি। স্থির করেছিলেন ঠাকুরের কাছে না গিয়ে অন্য কোনওভাবে পয়সা ফেরত দিয়ে আসবেন, কিন্তু তার আগেই এমন অভিযোগ স্বয়ং ঠাকুরের কাছ থেকে শুনতে হল! অত্যন্ত ব্যথিত মনে ঠাকুরের কাছে একদিন এসে উপস্থিত হলেন। দেখলেন ঠাকুর ঘরে চৌকির উপর বিবস্ত্র হয়ে বসে আছেন। তাঁকে দেখামাত্রই পরনের কাপড়টি বগলদাবা করে শিশুর মতো ছুটে আসলেন। বাঞ্ছিত জনকে কাছে পেয়ে ভাবদুনিয়ার সম্রাট শ্রীরামকৃষ্ণ উদ্বেলিত হলেন। যোগীনের হাত ধরে বললেন,“বে করেছিস--তা কি হয়েছে? এই যে আমি বে করেছি। বে করেছিস তা ভয় কি? (নিজ বক্ষে হস্ত রাখিয়া) এখানকার কৃপা থাকলে একটা কি, লাখটা বে-তেও তোর কিছু করতে পারবে না। তোর যদি সংসারে থাকতে ইচ্ছা হয় তো তোর স্ত্রীকে একদিন এখানে নিয়ে আসিস। তাকে এমন করে দেব যে, সে তোর ধর্মপথে সহায় ছাড়া কখনও বিঘ্ন হবে না। আর যদি সংসার করতে না ইচ্ছা হয় তো বলিস, তোর মায়া মমতা সব খেয়ে ফেলব।” যোগীন শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপালাভে ধন্য হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ভগবদস্রোতে ভেসে গেলেন। 
    আগের মতোই সংসারে উদাসীন রইলেন যোগীন। তাঁর উদাসীনতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে গর্ভধারিণী বললেন,“যদি উপার্জনে মন দিবি না, তবে বিয়ে করলি কেন?” প্রত্যুত্তরে তিনি জানান, মাতার ক্রন্দন সহ্য করতে না পেরেই তাঁর বিবাহ করা। মাতা এই উত্তরে ক্রুদ্ধ হয়ে জানান,“ওটা আবার একটা কথা! ভেতরে ইচ্ছা না হলে তুই আমার জন্য বে করেছিস--এ কি সম্ভব?” এই কথায় মনে দারুণভাবে আঘাত পেলেন যোগীন। বুঝলেন এই সংসারে মন ও মুখে মিল থাকা মানুষ একমাত্র ঠাকুরই। তিনিই জীবনের ধ্রুবতারা। বৈরাগ্য আরও বৃদ্ধি পেল এইসব ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে। ঠাকুরের কাছে মাঝেমধ্যে রাত্রিবাসও করতে থাকলেন। তবে নেহাত ভক্তির আবেশে যুক্তি ও বুদ্ধি বিরহিত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ চরণে নতজানু হন নি। রীতিমতো যাচাই করে নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারটি ঠাকুর নিজেও সমর্থন করতেন। একদিনের ঘটনা। যোগীন সেদিন ঠাকুরের সম্মতিতে কালীবাড়িতে রাত্রিযাপন করছিলেন। ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গাদিতে রাত্রি দশটা বেজে গেল। আহারান্তে উভয়ে একই ঘরে শয়ন করলেন। মধ্য রাত্রে হঠাৎ যোগীনের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখেন ঠাকুর ঘরে নেই। দরজা উন্মুক্ত। সেদিন ছিল জ্যোৎস্নালোকিত রাত। ঠাকুরকে দেখতে পেলেন না বাইরে কোথাও। মনে সংশয় উপস্থিত হল। নহবতে বসবাসরতা পত্নী সংসর্গে যান নি তো! ঠাকুরের ঘরের নিকটবর্তী নহবতের পাশে একটি স্থানে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পঞ্চবটীর দিক থেকে চটির চটচট আওয়াজ শুনতে পেলেন,কিছু সময় পর ঠাকুর সেখান থেকে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে বললেন,কিরে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কী উত্তর দেবেন! লজ্জায় অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন! ঠাকুর তাঁর মুখ দেখে সব বুঝতে পারলেন। তবে অপরাধ গ্রহণ না করে আশ্বাস দিলেন “বেশ,বেশ, সাধুকে দিনে দেখবি, রাত্রে দেখবি, তবে বিশ্বাস করবি।” তবে এর সঙ্গে সেইদিন অলৌকিক অপার্থিব এক দর্শনলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল যোগীনের। নহবতের দিকে যখন তাঁর লক্ষ্য ছিল, হঠাৎই দেখলেন  চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিতা মা সারদামণি সমাধিস্থা! তাঁর স্পষ্ট অনুভূতি হল তিনি সাধারণ মানবী নন। সমস্ত সন্দেহ দৃরীভূত তো হলই, সেদিন থেকে শ্রীশ্রীমায়ের অনুগত ভক্তে রূপান্তরিত হন। ঠাকুরের দেহাবসানের পর সমগ্র জীবন মাতৃসেবাতেই মূলত নিয়োজিত করেছিলেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments