জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১৫/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-১৫

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

ছোটবেলায় একবার সাবিত্রী মন্দিরে গেছিলাম। ঝাড়্গ্রামের সবচেয়ে পুরানো ৩৫০ ফুট উঁচু সাবিত্রী মন্দির । শোনা গল্প: সাবিত্রী নামে একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে রোজ স্নান করতে আসত রাজবাড়ির কাছে এক নদীতে। একদিন রাজা সর্বেশ্বর মল্লদেব তাঁকে দেখেন এবং প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন। বাগে বাগে থাকতেন তাঁকে ধরার জন্য। একদিন গাছের আড়াল থেকে তাকে স্নানরতা অবস্থায় দেখেন। জলের মধ্যে সূর্য আর ছায়ার সাথে জলকেলি করে সেই মেয়ে। সেই সুযোগ হাতে নিলেন। জলে ডোবা সাবিত্রীকে ধরবার জন্য রাজা ধীরে ধীরে যেই জলে নেমেছেন সঙ্গে সঙ্গে সে গভীর জলে ডুব দেয়। তার লম্বা চুল জলে ভেসে উঠলে সেই চুল ধরে টান দেন। কিন্তু সেই চুল তাঁর হাতে চলে আসে। তিনি অবাক হয়ে যান। বুঝতে পারেন এই সাবিত্রী সাধারণ কোনো নারী নন। তখন তিনি তাঁর নামেই সাবিত্রী মন্দির স্থাপন করেন। যেহেতু তিনি তাঁর মুখ ভালভাবে দেখেন নি, তাই একটি পাথরের মূর্তি গড়ান। আমরা দেখলাম তো সেই মূর্তি, তাই না? মূর্তির নীচে সেই চুল নাকি আজও রাখা আছে। মনের দুঃখে রাজা আবার ঝাড়খণ্ডে ফিরে আসেন। এবার যখন গেলাম কেয়ারটেকারের কাছে সব শুনলাম তো।

তবে সেই রাজবাড়ির জৌলুস আর নেই। ছন্নছাড়া হয়ে আছে।

আরও এক রাজবাড়ি আছে...চিল্কীগড়! ওটা আমার নদাদার প্রিয় বন্ধু পঙ্কজদাদের রাজবাড়ি। আর ঝাড়্গ্রামের রাজবাড়ি হল ওনাদের মামার বাড়ি। পঙ্কজদা আর কিরণভাবী আমাদের ব্যটনরুজে থাকতেন। ওনার কাছেও অনেক গল্প শুনেছি রাজবাড়ির। ঝাড়গ্রাম থেকে বারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেই রাজবাড়ি।

পরে ১৯৮৯ এ আমেরিকায় প্রথম যখন আসি তখন নদার বন্ধু চিল্কীগড়ের রাজবাড়ির সব চেয়ে ছোট বংশধর পঙ্কজ ধবল দেব-এর সাথে আলাপ হয়।

কনক দুর্গা মন্দির চিল্কীগড়ের জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। ইতিহাস অনুযায়ী প্রসিদ্ধ এই মন্দির তৈরি করেছিলেন জামবনীর রাজা কমলা কান্ত। তাঁর রাজপ্রাসাদ ছিল ডুলুং নদীর অন্য পাশে। প্রধান মন্দির তৈরি হয়েছিল টিপিক্যাল পঞ্চরত্নের স্টাইলে। এখন অনেক কিছু বিস্মৃত হলেও কিছু এখনও সেইরকম আছে। চারশো বছরের পুরানো মন্দির টেরাকোটা আর মকর পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখন অনেক ধ্বংসাক্ত থাকলেও কিছু কিছু অবশিষ্ট আছে।

আরেকটা মন্দির ছিল বাহান্ন ফুট লম্বা, তার নাম কনক দুর্গা মন্দির। পুরানো মন্দিরের পাশেই থাকত এই মন্দির। রাজা জগদীশ চন্দ্র দেও ধবল ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেছিলেন এই মন্দির। উড়িষ্যার মন্দিরের মতন দেখতে অনেকটা। বড়দিনের ছুটিতে একবার পঙ্কজদা আর কিরণ ভাবীর সাথে গেছিলাম ঝাড়্গ্রামের রাজবাড়ি। কি রাজকীয় আদর-ভাষায় বোঝানো যাবে না। রুপোর বড় বড় থালায় গোবিন্দভোগ চালের ভাত তাতে গাওয়া ঘী। থালার চারিপাশে নানা রকম খাবার রুপোর বাটি দিয়ে সাজানো। ~আহা! কিরণভাবী বিলাসপুর রাজবাড়ির রাজকন্যা। পঙ্কজদা তো মারা গেছেন হার্ট এটাকে। ভিষণ মদ আর সিগারেট খেতেন।

বিষ্ণু মন্দির -এর কথা এখনও মনে আছে। ত্রিশ ফুট উঁচু মন্দিরের ওপর একটা চক্র আছে। সাঙ্ঘাতিক এক কাঠের দরজা আছে। সেটা লাগানো থাকত সব সময়। শুনেছিলাম, অনেক গুপ্তধন সেখানে নাকি রাখা থাকত। আমার বিশ্বাসের পটভূমি ঝাড়গ্রাম। আসলে সব আজ মনে পড়ছে। ত্রিশ মিনিট শাল আর বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সেদিনও মনে হয়েছিল যেন এক স্বপ্নরাজ্যে যাচ্ছি আমরা, তাই না? কত স্মৃতি উপচিয়ে পড়তে চাইছে, দেখেছো?

মেজদা আই সি ভি পলিটেকনিক(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পলিটেকনিক) এ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজে নিযুক্ত হলেন। মা-এর ইচ্ছে আমরা ছোট দুই ভাই-বোন মেজদার কাছে থাকলে পড়াশুনায় ভাল হব। কিন্তু ঝাড়গ্রামের আবহাওয়া মা-এর শরীরে সহ্য হচ্ছিল না। সেজদা তখন মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর-এ। সেজদার ইচ্ছে বাবা মা তার কাছে থাকুক। বড় কোয়ার্টার পেয়েছে, আর সব বাড়ীর কাছে স্কুল কলেজ। কিন্তু মা-এর রোখ, না। মেজদার ডাক নাম ভানু... তার কাছেই পড়াশুনা ভালো হবে। কারণ মেজদা ছিলেন প্রফেসর। পড়াশুনা ছিল তার প্রাণ। তাই আমরা থেকে গেলাম সেখানেই।

শুরু হল পড়াশুনা। প্রথমে ভর্তি হলাম ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়ে। কারণ বিহারে থাকার দরুন ইংলিশ একেবারে জানতাম না। যেহেতু বাংলা, এবং অংকতে খুব ভালো ছিলাম তাই ননীবালা গার্লস-এ ক্লাস ফাইভ-এ ভর্তি হলাম আর ছোট ভাই বাড়ির কাছের স্কুল ননীবালা বয়েজ এ ক্লাস ফোর-এ ভর্তি হল। আমি যাও বা একটু ইংলিশ জানতাম ও একেবারে কিছুই জানত না। ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- নদীর ইংলিশ কি? সাথে বটি গিয়েছিল। তখন আস্তে করে বটিকে জিজ্ঞেস করেছিল- “কী রে বটি”? বাড়িতে এসে সে কি হাসি সবার।

-বাবু তো? ওর তো বৌ আমেরিকান -ছেলে মেয়ে নিয়ে দিব্বি আছে। এরকমও হয় বোঝো। এখানেই তো ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করেছে। বাবু-প্যাম তো মন্দির করেছে বাড়িতে, বলল সেদিন।

-বেশ চলছিল পুতুল খেলা, এক্কা দোক্কা, বুড়ি ছোঁ-এর সাথে সাথে মায়ের পানের ডব্বা ধোওয়া, পানের বোঁটা খুলে একটা একটা পান ধুয়ে, পানের বোঁটায় চুন লাগিয়ে আবার মায়ের রূপোর পানদানীতে রাখা, ঠাকুরের পেতলের বাসন তেঁতুল আর মাটি দিয়ে চকচক করে মাজা। তারপর স্কুল যেতাম।

স্কুল থেকে ম্যাগাজিন এ লিখতে বলেছে, “চুপ করে বসে আছি জানলার কাছে। সামনে খোলা রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলী। বয়স আর কত সাত তখন। মা এসে আমার ঝাঁকড়া চুলগুলোকে নিয়ে একটা ফিতে দিয়ে বেঁধে দিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কি এত চিন্তা করছিস, মা? আমায় বলবি না?”

বললাম: “ ও মা! স্কুল থেকে গল্প লিখতে বলেছে। কি যে করি? আমি তো কিছু গল্প জানি না।”

– “তো কি হয়েছে আমি বলে দেব । লেখ।” আমি তো হেসেই খুন। “মা কী গল্প বলবে?”

তখন কি জানতাম, কত কিছু হারিয়ে ফেলব আর কিছুদিনের মধ্যে। আর কেউ লেখার কথা মনে করিয়ে দেবে না। মা যে মা -ই হয়। তাই তো কাজে ঢুকেই মা-এর আশীর্বাদেই আবার লেখায় মন দিয়েছি। কারুর সাহায্য ছাড়াই সব জায়গায় লেখা পাঠাই-তাঁরা প্রকাশ করলে খুব আনন্দ হয়-চোখে জল ভরে যায়। মনে মনে বলি-”জিতেছি”। কয়েকজনকে বলিঃ “একটু এডিট করে দেবেন?” কিন্তু না -সে সুযোগ আমাকে কেউ দেন না।

-“মা তুমি গল্প বলবে?” না শোনা হয় নি সে গল্প সেদিন। তখন ছোট্ট আমি কী জানতাম, মা একদিন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে কেউ বলবে না- “আমি বলি তুই লেখ”। না কেউ আর বলে না গল্প লিখতে...বাংলা লিখি বলে-উপহাস ও করে। তাও নিজেই লিখে চলি... অনেক পড়লে ভালো লেখা যায়...তা থেকেও বঞ্চিত আমি। এ যে মদ খাই নি জীবনে কোনদিন কিন্তু লেখা যেন এক পেগের চেয়েও ভয়ংকর নেশা। আজ মনে আসছে সেই মিহি পুরবৈয়া।

একটা মজার ঘটনার কথা বলি? ঝাড়গ্রামে আমাদের ননীবালা স্কুলের কাছে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে একজন সাধু এসেছেন। পাড়ার সবাই বলছে উনি নাকি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁকে দেখার জন্য সে কি ছুট আমাদের। মা ও অন্যান্য-রাও পরে গেছিলেন। তবে আমরা কচিকাঁচারা যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন বেশি লোকজন আসেনি। একমুখ কালো দাড়ি সমেত মাটিতে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসে আছেন। জানলা দিয়ে রোদের টুকরো পড়ে ওনার মুখটা জ্বলজ্বল করছে।

উনি আমাকে দেখেই বলে উঠলেন: “তুই একদিন মন্ত্রী হবি বেটি। তোর অনেক নাম হবে।” তখন আমরা বাড়ি আসার সময় এ ওর গায়ে পড়ে খুব হেসেছিলাম। মা শুনে বললেন, “হাসছিস কেন? হতে পারবি ঠিক।”-হি হি হি। আজ মনে হলে অদ্ভুত লাগে সব। কই মন্ত্রী তো হলাম না। তবে স্কুল, কলেজ, চাকরীর ক্ষেত্রে যেখানে যাই খুব ভালোবাসা পেয়েছি, পাই । ব্যাস ওইটুকু।

ননীবালা দেবীর নাম শুনেছো কি? উনি স্বদেশী ছিলেন। ওনাকে শাড়ি ব্লাউজ খুলে সারা শরীরে লংকার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ দানবেরা। কিন্তু তাতেও দমে যান নি। চোখে জল আসে...সত্যি চোখে জল আসে।

কিছুদিন পরেই মা এর অসুখ ধরা পড়ল। একদিন স্কুল ছুটির দিনে দুপুরবেলা মা স্নান করতে বাথরুমে ঢুকলেন। আমি উঠোনের কাছে আমগাছের নিচে লাল রঙের চাতালে বসে আমার সদ্য প্রাইজ পাওয়া ঠাকুমার ঝুলি পড়ছি। হঠাৎ কাঁপা গলায় মা ডাকতে লাগলেন, “সিমটি! শিগ্রী আয়।” মা আমাকে আদর করে সিমটি বলে ডাকতেন তো। ছুটে গিয়ে দেখি মা একটা গামছা দিয়ে নিজের শরীর জড়িয়ে বলছেন, “আমাকে আস্তে আস্তে ঘরে নিয়ে চল তো মা।” মা কাঁপছেন ঠকঠক করে। আমি কেঁদে ফেল্লাম মা-কে ওই অবস্থায় দেখে। জানি না কি বুঝেছিল আমার মধ্যের সেই ছোট্ট মেয়েটা। চিৎকার করে মেজদাকে ডাকতে লাগলাম। মেজদা তখন ছাত্র পড়াচ্ছিল। দৌড়ে আসলে তার সাথে ছাত্ররাও এসে মা কে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। তারপর লোকাল হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার দেখানো হলে জানা গেল মাকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই হবে।

মাকে নিয়ে যাওয়া হল জামালপুরের ডাক্তার কাকার কাছে। উনি স্টেশনে মা কে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, মা সেই কঠিন রোগে আক্রান্ত, যে রোগ সারার নয়। সেই মহাব্যধি ক্যান্সার।

তারপর সেখান থেকে ওনার নির্দেশে মা কে কলকাতার পি জি হাস্পাতালে-এ ভর্তি করা হল। ইউটেরাস ক্যান্সার এর লাস্ট স্টেজ। তখন তো আর এখনকার মতন ওষুধ পাওয়া যেত না। নদাদার বন্ধুরা তখন আমেরিকায়। তাদের সাথে যোগাযোগ করে ওষুধ আনা হত। যা দেশে পাওয়া যায় না। মা ওষুধ দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, আর দিদি/দাদাদের বলেছিলেন, “কি এমন অসুখ করেছে যে, এখানে ওষুধ পাওয়া যায় না। কোনটা তামার মতন তো কোনটা রুপোর ছিলকা”।

মা কে শুয়ে থাকতে দেখে আমরা দুজন ছোট ভাই বোন খুব কান্নাকাটি করতাম। আমি আট আর ভাই ছয়।

তখন ছোটদের মা এর রুমে ঢোকার পারমিশন ছিল না। কিন্তু যে দারোয়ান ঘরের সামনে টুলে বসে পাহারা দিত, সে ছিল ভুটিয়া। আমাদের দেখে তার খুব মন খারাপ হত। তার কোটের মধ্যে আমাদের আড়াল করে মা -এর ঘরে নিয়ে যেত, আর বলত “তুরন্ত মাতাজি কো দেখকেই আ জানা। নেহি তো ডক্টরসাহেব ডাঁটেগা।” আমাদের কান্নাকাটি করা দেখে বাবা মেজদিদিয়াকে বলেছিলেন, নিউ ব্যারাকপুরে বড়দির কাছে রেখে আসতে।

আমরা দুই ভাইবোন এবার ব্যারাকপুরে থাকতে লাগলাম। তারপর ছয়মাস পর ডাক্তারের নির্দেশে মা কে দাদারা/দিদি মিলে এনে রাখল লেক গার্ডেন্স-এর একটা ফার্নিশড বাড়িতে। রেগুলার চেক আপ চলছে। আমরাও এসে গেলাম ব্যারাকপুর থেকে লেক গার্ডেন্স এ মায়ের কাছে। মা কে দেখে বুঝতেই পারছিলাম না যে, মা এতবড় একটা কঠিন ব্যধিতে আচ্ছন্ন। সব সময় মা এর মুখে হাসি লেগেই থাকত। তখন কি যে আনন্দে ছিলাম তা প্রকাশ করা যাবে না। ঐ গানটা বাজত মনে আছে, “নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখীরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়-”। তখন কি আর এই গানের মানে বুঝতাম?

মা চেক আপ করাতে গেলে মাঝে মাঝে ডাক্তার-রাও ভুল করতেন যে, মা অসুস্থ। মা আমাকে একবার বলেছিলেন, “সিমটি চল আমার সাথে।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, “না মা, আমি হাসপাতালে যাব না।” আমার আজ পর্যন্ত সে আফশোষ যাবার নয়। আজও আমি হাস্পাতাল যেতে ভয় পাই। ছয় মাস পর আবার মাকে ভর্তি করানো হল। আর আমরা ফিরে গেলাম ঝাড়্গ্রাম। ছোট পিসীমাকে এনে ঝাড়্গ্রামে রাখা হল আমাদের দুই ভাইবোনকে দেখাশুনার জন্য। কোনো দাদার তখন বিয়ে হয় নি।

এরপর একদিন অসময়ে শীত আসব আসব করার সময় মা আমাদের সবাইকে রেখে মাত্র তিপান্ন বছর বয়সে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। দিনটা ছিল ৫ই সেপ্টেম্বর। আকাশে তারাদের মাঝে মা -এর পার্মানেন্ট যায়গা হয়ে গেল। আজও হন্যে হয়ে আমি রাতের তারাভরা আকাশে মা কে খুঁজে বেড়াই। দুঃখ হলে চুপ করে কাঁদি, অভিমান করি। প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগে শরীরে, মনে। চোখের ভিতরে শুধু জল আর বুকের ভিতরে? সেখানেও শুধু উতাল পাতাল জল। আফতের জীবন? না জীবনের পরে? জীবনের পরে তো জীবন থাকতে পারে না।

নিউ ব্যারাকপুর

বড়দিদিরও বিয়ে হয়েছিল খুব ছোট্ট বেলায়। মায়ের সঙ্গে ঠাকুরের বই দেখতে গেছিল। জামাইবাবুও গেছিলেন ওনার মায়ের সাথে। উনি বড়দিদিকে দেখেই ওনার মা কে বলেন “মা আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করব।” বড়দিদি তখন ক্লাস টেন্থ এ পড়ে। সব পরীক্ষায় প্রথম হত।

বড়দিদির দুই মেয়ে আর তিন ছেলে। বড় মেয়ে আর বড় ছেলের পরে বড়দির মেজ ছেলে আর আমি ছয় মাসের ছোট বড়। আমরা জোরে জোরে পড়তাম। বড়দিদি উনুনের কাছে বসে রুটি করত আর আমাদের মুখে মুখে শেখাত-” ১৫ ১৫-এ , ২৫ ২৫-এ , ৩৫ ৩৫ এ এইরকম কত? একবার বলে দিত আর শিখিয়ে দিত কি ভাবে এই গুণ মুখে মুখে করতে হবে। আজও আমি ভুলি নি সেইসব। উচ্চশিক্ষা করতে গিয়ে খুব কাজে লেগেছিল এই অংক। তারপর বড়দিদি বলত, “যে ভালো পড়াশুনা করবে তাকে এক ভাঁড় মাটির খুড়িতে লাল দই দেব পুরস্কার হিসেবে।” বড়দিদির ছোট ছেলে ঠিকু আর মেয়ে ডালি একসাথে পড়ত ক্লাস ওয়ান এ। বড় জামাইবাবু আর বড়দি আমাকে আর বাবুকে নিজেদের ছেলে মেয়ে বলতেন।

একটা মজার কথা বলি। সেইবার পরীক্ষার সময় ওদের সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষা ছিল। ডালিয়া ক্লাসে ফার্স্ট হত আর ঠিকু সেকেন্ড। সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষায় ওদের প্রশ্ন ছিলঃ “১) তোমার বাবার নাম কি লেখো। ২) ভারতের রাষ্ট্রপতি কে? ৩) কিছু সাদা ফুল আর লাল ফুলের নাম।” ডালি খুব চালাক চতুর ছিল। ডালি লিখেছিল: বাবার নাম পি এস মুখার্জ্জী, আর রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণ। আর ঠিকু লিখেছিল: বাবার নাম পুণুন্দু মুখারজ্জী। আর রাষ্ট্রপতি পল্লী।” এখনও মনে আসলে খুব হাসি পায়।

পলাশ অবাক তখন, ভাবে শিমুল জীবনটাকে কবিতার মতো করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাঘনিশীথের শেষমেলা খেলাভোলা শিশু। এইভাবে ঘটে যায়, কালধারা সুদূরপ্রসারী।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments