জ্বলদর্চি

শীতলার বিবাহ / ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ১৩
শীতলার বিবাহ 

ভাস্করব্রত পতি

বিবাহ যে এরকম লৌকিক উৎসব আকারে হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। দেবীর জড় মূর্তির সাথে জলজ্যান্ত মানুষের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় এই লৌকিক উৎসবে। সেই বিবাহের আসরে কন্যাপক্ষ বা পাত্রপক্ষ কোনও পক্ষেই না থেকেও আনন্দ এবং বিস্ময় উপভোগ করতে পারা যায়। এবং চমকিত হতে হয়। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমার থানার দক্ষিণ নারকেলদা গ্রামে (জে.এল নং-২৪) আয়োজিত হয় এক অভিনব বিয়ের আসর। দেবী শীতলার বিবাহ বাসর। দেবীর সাথে বিবাহ হয় ‘ঘন্টাকর্ণ'’ রূপী মানুষের। দক্ষিণমুখী পিতলের শীতলা মূর্তি থাকেন স্থানুবৎ। অথচ সেই জড় দেবীর সাথেই বিবাহ হয়। যাবতীয় নিয়মনীতি মেনেই এই বিবাহ। পাঠককুলকে কেবল এই বিবাহের উপচার এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী ছাড়া নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের প্রসঙ্গ আলোচনা না করে বিবরণ জানাতে চেষ্টা করছি।

মোট আটদিনের অনুষ্ঠান। গ্রামীণ শয়াল পূজা বা দেশ পূজার একটি অঙ্গ হল এই শীতলার বিবাহ। কুসংস্কার বা ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা কেউ কেউ বললেও এটিকে গ্রামবাংলার লৌকিক সংস্কৃতিই বলা যায় নিঃসন্দেহে। এরকম বিবাহ ভূভারতে কোথাও দেখা যায় কি? ঐ আট দিনে কি কি হয় তা নিচে জানালাম -

প্রথম দিন -- শ্রী শ্রী শীতলা মাতার ঘটোদক এবং সংকল্প ও পূজা। 'মালাচন্দন' হয়। তেত্রিশ কোটি দেবতার বন্দনা করা হয় এদিন। সেইখানে শীতলার বন্দনা গান ও শীতলার জন্ম পরিবেশিত হয়।
দ্বিতীয় দিন – নিমা জাগাতির গান হয়।
তৃতীয় দিন — বিরাটের পালাগান আয়োজিত হয়।
চতুর্থ দিন – দেবী শীতলার সাথে ঘন্টাকর্ণের বিবাহ হয়। সেইসাথে শ্রী শ্রী শীতলা মায়ের ষোড়শদান মহাবিহিত পূজা, হোম ও পুষ্পাঞ্জলী এবং ঘন্টাকর্ণ সহ গোটা গ্রাম পরিক্রমা হয়।
পঞ্চম দিন – রাবণ রাজার উপাখ্যান হয়।
ষষ্ঠ দিন – বড় পূজা অনুষ্ঠিত হয় এদিন। চণ্ডীমঙ্গল পালা অনুষ্ঠিত হয় এদিন। সেইখানে ওলাবিবির পূজার গান হয়।
সপ্তম দিন - মনসার গান ও গোষ্ঠ পূজা হয়।
অষ্টম দিন – শিবায়ন ও অষ্টমঙ্গলা বিহিত সমাপনান্তে মায়ের বিসর্জন হয়। মনসামঙ্গল এবং বিদায় গান হয়।

শীতলার বিবাহ উপলক্ষে পূজায় গ্রামবাসীরা খরচ করে আড়াই লক্ষ টাকার বেশি। এর মধ্যে সয়াল গানের দল নেয় ৮০ হাজার টাকা। আট দিন ধরে পালাগানের ভার তাঁদের ওপরেই। তাঁদেরই একজন ঘন্টাকর্ণ সাজেন। যিনি দেবী শীতলাকে বিবাহ করেন। মেচেদার শান্তিপুর থেকে আসেন শয়াল গানের দল। এই দলেরই এক ব্রাহ্মণ নন্দলাল ঘোষাল (বাৎস্য গোত্র) হন ঘণ্টাকর্ণ! (তথ্য সংগ্রহ - ১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪২১ তথা ৩ রা জুন, ২০১৪ )
আটদিনের নানা উপচারের ফর্দ করে দিয়েছেন ময়নার কিয়ারানা গ্রামের স্মৃতিকন্ঠ সিদ্ধান্ত বাচস্পতি শ্রীরজনীকান্ত আগমবাগীশ। একসময় ১২ বছর অন্তর এখানে শীতলার বিবাহের আসর বসত। এখন ৪ বছর অন্তর হয়। 

বিবাহ বাসরের আগে বাদ্যি বাজনা সহ গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন গ্রামবাসীরা। সুসজ্জিত শোভাযাত্রা থাকে। আতসবাজি ফাটানো হয়। সেইসাথে সামনে থাকে ঘণ্টাকর্ণ রূপী বিবাহের বর। তাঁর সাথে থাকেন শিব, কৃষ্ণ এবং ব্রহ্মা-র সঙ সেজে থাকা গ্রামবাসীরা। এই উৎসবকে ঘিরে এই সঙ সাজা বেশ চিত্তাকর্ষক। এবার যাঁরা যাঁরা সঙ সেজেছিলেন তাঁরা হলেন --  ঘণ্টাকর্ণ – নন্দলাল ঘোষাল, শিব – লক্ষ্মীকান্ত সাউ, কৃষ্ণ – চন্দন জানা, ব্রহ্মা -- বলরাম প্রধান।

গোটা গ্রাম ঘুরে আসার পর ঘন্টাকর্ণকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় ছাদনাতলায়। দেবী শীতলার মন্দিরের সামনে তৈরি হয় এই ছাদনাতলা। গোটা গ্রাম জুড়ে আলোময় হয়। সেই ছাদনাতলায় সাজানো থাকে বিবাহের যৌতুক। দেবীকে প্রণাম করে দেবীকে বিবাহের জন্য বসেন দাঁড়ি গোঁফ পরিহিত ঘন্টাকর্ণ ঋষি। সন্ধ্যা ৮.২৭ এ বিবাহের লগ্ন শুরু। রাত ১২.৪০ তে লগ্ন শেষ। কিন্তু প্রথম লগ্নতেই বিবাহ হয়।

দক্ষিণ নারকেলদা গ্রামের শীতলার বিবাহের দর্শক হিসাবে আসেন পার্শ্ববর্তী কামারদা, সাঁওতানচক্, বাড়বহিচবেড়িয়া, রাউতৌড়ি, মহাদধিপুর, কুলবেড়্যা, গণপতিনগর, নিমতৌড়ি, উত্তর নারকেলদা, বেঙ্গি মুদিয়া ইত্যাদি গ্রামের অসংখ্য মহিলা পুরুষ। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় তখন তিলধারণের স্থান থাকেনা। পুরানো মন্দিরটি ভেঙে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ১৩৮০ তে বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল। এ গ্রামে শীতলার শয়াল সহ মোট চারটি পূজা অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সময়ে। চৈত্র মাসে শিবের গাজন, অমাবস্যায় কালী পূজা এবং যে কোনও শুভ দিনে মহাপ্রভু পূজা হয়। গ্রামবাসীরা এই বিবাহ বাসরকে বলেন 'বিবাহ যজ্ঞ'।

বিয়েতে ছেলের বাবা হয়েছিলেন গ্রামবাসী অসিত পট্টনায়ক এবং মেয়ের বাবা হয়েছিলেন রতনচন্দ্র জানা। এখানে দেবী শীতলার অন্য নাম 'শুভঙ্করী'। বিবাহের বাসরে দানসামগ্রী হিসেবে গ্রামবাসীরা দেন থালা, বাটি, গ্লাস, কলসি, বিছানার যাবতীয় সাজসজ্জা ইত্যাদি। ঐ শয়াল দলের পক্ষে ঘন্টাকর্ণ রূপী নন্দলাল ঘোষাল এসব পান। বিবাহের শেষে গ্রামবাসীরা পাত্রপক্ষ এবং কন্যাপক্ষের (আগত দর্শক) জন্য ২০ কেজি বাতাসা ছড়ান বিয়ের ভোজ হিসেবে। সেইসাথে ২০ কেজি ময়দা ও ১০ কেজি সুজির গুড় পিঠা তৈরি করেও ছড়ানো হয় সেখানে। এছাড়া নারকেল নাড়ুও ছড়ানো হয় তখন। গ্রাম কমিটির পক্ষে এই বিবাহ বাসর পরিচালনা করলেন সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ মাল, সভাপতি মোহনলাল বেরা এবং কোষাধ্যক্ষ শশাঙ্ক বায়েন। গ্রামের শীতলা মন্দিরে দুর্গাপদ মিশ্র সবসময় পূজা করেন। 

বড় পূজার দিন ৭টি ডিঙা সাজিয়ে ঘট তোলা হয়। একে 'বোঁচ' বলে। বংশ পরম্পরায় এখানে পূজার কাজ পরিচালনা করছেন ‘মিশ্র' পদবীধারীরা। এই মন্দির স্থাপনের পিছনে একটা ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তা হল – একসময় জনৈক প্রসন্ন ঠাকুর (ভট্ট) নামে এক ব্যক্তি শীতলা ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই শীতলার বিবাহের চল চালু করেন। তাঁর কোনও সন্তানাদি ছিল না। সেসময় গ্রামে গঞ্জে বসন্ত রোগের প্রাধান্য ছিল। তা থেকে গ্রামবাসীকে রেহাই দিতে তিনি শীতলা ঠাকুর পূজা এবং তার সাথে ঘন্টাকর্ণের বিবাহের প্রচলন করেন। তখন প্রসন্ন ভট্ট এবং অঘোর মিশ্র এই গ্রামের শীতলা ঠাকুরের দুই শরিক ছিলেন। দুজনের অর্ধেক করে 'শেয়ার' ছিল। কিন্তু গ্রামের সাথে দুর্ব্যবহার করায় দক্ষিণ নারকেলদা গ্রামের বাসিন্দারা ঐ প্রসন্ন ঠাকুরের শরিক বা মালিকানা থেকে তাঁকে বাদ দিয়ে দেয়। ঐ মালিকানা গ্রাম নিয়ে নেয়। বাকি অর্ধেক অংশ থাকে অঘোর মিশ্রের হাতে। বর্তমানে এই মন্দিরের পূজার কাজ বংশপরম্পরায় চালান অঘোর মিশ্রের পরিবারের লোকজনই। এই অঘোর মিশ্ররা দুই ভাই। তাঁর ভাই ক্ষীরোদ মিশ্ররা এই পূজার সাথে সম্পৃক্ত নয়। অঘোর মিশ্রের পর তাঁর পুত্র দিবাকর মিশ্র দেবী শীতলার প্রধান পূজক হন। এরপর দিবাকরের ছেলে দুর্গাপদ মিশ্র প্রধান পূজক হন। বর্তমানে তিনিই দেবীর পূজার দায়িত্বে।

দক্ষিণ নারকেলদা গ্রামের শয়াল পূজার অন্যতম আকর্ষণ শয়াল গান। এখানে মূল গায়েনই হন ঘন্টাকর্ণ। বসন্ত রোগের দেবী শীতলার জন্ম সংক্রান্ত উপাখ্যান গীত হয় শয়াল দলের দ্বারা। শীতলামঙ্গলে 'জাতি অনুসারে বসন্তের প্রকোপ' অংশে পয়ার ছন্দে গীত হয় ৬৪টি বসন্তের নাম। শীতলা পূজার মন্ত্রে ব্যবহৃত ৬৪টি বসন্তের নামগুলি হল – "১, ওঁ বিসমচর্মদলায় নমঃ ১. ওঁ রক্তচর্মদলায় নমঃ ৩, ওঁ ধ্রুকুণ্ডিচর্মদলায় নমঃ ৪, ওঁ মহিষ চর্মদলায় নমঃ ৫. ওঁ  রক্ত চর্মদলায় নমঃ ৬. সর্বত্র রোগরাজায় ৭ সর্বত্র গুণ রাজায় ৮, ওঁ সূর্য্যমুখায়ঃ ৯, আসবাতায় ১০, বাতরাজায় ১১, বিস্ফোটকায় ১২, গর্বচনায় ১৩, নাগান্তকায় ১৪, শরান্তকায় ১৫, গজহাটকায় ১৬, কুলান্তকায় ১৭, জবালান্তকায় ১৮, কুচ্ছিতকায় ১৯, গুরুদলায় ২০, কুশধুলায় ২১, হাম্বিরায় ২২, সন্নিপাতায় ২৩, ভূতমুখায় ২৪, শিশিরায় ২৫, বেঁচায় ২৬, মসুরায় ২৭, তিলায় ২৮, বেত্রফুলায় ২৯, কালচিমটায় ৩০, মহিষায় ৩১, মুদগাঁয় ৩২, সন্নিশীলায় ৩৩, রক্তায় ৩৪, চন্দ্রমুখায় ৩৫, অস্থিগলায় ৩৬, মাংসঝরায় ৩৭, গলাফুলায় ৩৮, তরান্যৈ ৩৯, জীবান্যৈ ৪০, পানিফলায় ৪১, ঝঙ্কারায় ৪২, ঝর্ঝরায় ৪৩, জম্বিকারৈ 88, ধকধকায় ৪৫, কটকটায় ৪৬, চিড়চিড়ায় ৪৭, কিটকিটায় ৪৮, ঘুটঘুটায় ৪৯, সরিষাফুলায় ৫০, কুচমুড়ায় ৫১. বেলপাড়ায় ৫২, কালমুখায় ৫৩, ধুতরায়ৈ ৫৪, বেলথপায় ৫৫, কিরীটায় ৫৬, স্বর্ণপায়ৈ ৫৭, লঙ্কাটায় ৫৮, নারঙ্গায় ৫৯, পর্বতচূর্ণায় ৬০, কণ্ঠনালায় ৬১, অন্তপাতকায় ৬২, কোচমুখায় ৬৩, শীলানীলায় ৬৪. সর্বত্র ওঁকারাদি নমোহস্তেন পূজায়েৎ"! 

যাবতীয় নিয়মনীতি মেনেই বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদন করা হয় এখানে। খৈ পোড়ানো, ফুল ছড়ানো বা পুষ্প বৃষ্টি এবং সবশেষে মিষ্টি ছড়ানো হয়। শয়াল পূজা উপলক্ষ্যে দেবী শীতলার পিতলের মূর্তিটি মার্জনা করা হয়। নতুন শাড়ি, অলঙ্কার, শাঁখা, নোয়া, সিঁদুর, নতুন চাঁদমালা দিয়ে সাজানো হয়। ঘন্টাকর্ণ রূপী মানুষকে পরচুলা এবং রক্তবস্ত্র পরানো হয়। মন্দিরে ঘন্টাকর্ণের ঘটের পূর্ব দিকে থাকে দেবী শীতলার ঘট। তারও পূর্ব দিকে থাকে ব্রহ্মার ঘট। শয়াল পূজার চতুর্থদিন দেবী শীতলার সাথে ঘন্টাকর্ণের বিবাহ হয়। দেবী মন্দিরকক্ষে থাকলেও ঘণ্টাকর্ণ ছাদনাতলা থেকে মন্দিরকক্ষে যান। সেখানে পূজক ব্রাহ্মণের সহযোগিতায় পাত্র-পাত্রীর মেলবন্ধন ঘটে। 

এ এক অনন্য লৌকিক উৎসব। কল্পিত দেবতার সাথে কল্পিত  মানুষের বিবাহ। নারকেলদা গ্রামের এহেন লৌকিক উপচারটি এরাজ্যের লৌকিক উৎসব মানচিত্রে বিরলতম বৈকি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments