জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ /পর্ব ১৩ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ 
পর্ব ১৩ 
 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

" কবিতা চরের পাখি, কুড়োনো হাঁসের ডিম,গন্ধভরা ঘাস 
ম্লানমুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো  বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীলখামে সাজানো  অক্ষর 
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার’’ ( কবিতা এমন/ আল মাহমুদ) 

কবিতা পড়তে পড়তেই তো মানুষের পথচলা। যে পথের বিরাম নেই।জীবনপিপাসা থেকেই কবিতার কাছে এসে বসা। এই ধারাবাহিক গদ্যে বিভিন্ন কবি তাঁদের নিজস্ব স্বর নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন যাঁদের কবিতা আমার অন্তর ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন। যাঁদের কবিতা বারবার উচ্চারণ করি পথ চলতে চলতে। এই পথই তো কবিতা অ্যাভিনিউ। কবি আল মাহমুদ আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম। মায়াবী পর্দা দুলিয়ে তিনি কোথায় চলে গেছেন কোন রহস্যের দেশে। কালের কলসে রয়ে গেছে তাঁর  শিল্পসম্ভার।মীর  আবদুস শুকুর আল মাহমুদ  বাংলা সাহিত্যে  যিনি আল মাহমুদ  নামে স্মরণীয়  হয়ে থাকবেন চিরকাল । আল মাহমুদ জীবনানন্দ- উত্তর  বাংলা  কবিতায়  এক উজ্জ্বল  মাইলস্টোন। পঞ্চাশের বাংলা কবিতাকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন নতুন চেতনায় শিল্পে ও বাকশস্যে।
শুধু কবিতা নয় শিল্পসাহিত্যের প্রায় প্রতি স্তরেই রেখেছেন নিজস্ব চিন্তার স্বাক্ষর। এমনকি দেশের সামাজিক আন্দোলনে অগ্রণী  ভূমিকা নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ  করেছিলেন  । সেই সময় পাকিস্তান  স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে তার কলমে উচ্চারিত  হয়েছিল প্রতিবাদী  স্বর। তাদের দমনমূলক নীতি  অত্যাচার  অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ তীব্র হয়েছিল তাঁর কবিতা।  এবং স্বাধীনতা  পরবর্তী কালে দৈনিক জনকন্ঠ সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটিকেও সুপ্রতিষ্ঠিত  করেছেন। সম্পাদক থাকাকালীন এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাবরণ করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়।  গল্পেও তিনি তুলে ধরেন জীবন বাস্তবতার কথা। বাংলাদেশের লোকায়তধ্বনির পাশাপাশি  এসেছে মানুষের যন্ত্রণা বিদ্ধ স্বরের নিবিড় উচ্চারণ।১৯৩৬ সালে অবিভক্ত  বৃটিশ  ভারতের ( বর্তমানে বাংলাদেশ  ) ব্রাহ্মণবেড়িয়ার  মোড়াইল গ্রামে তাঁর  জন্ম। ১৯৫৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তাঁর  কাব্যচেতনার স্ফুরণ  ঘটে।সিকান্দার আবু জফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকার তাঁর  প্রথম কবিতা প্রকাশের সাথে সাথেই সুধীজনের দৃষ্টি  আকর্ষণ  করে।১৯৬৩ সালে তাঁর  প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর প্রকাশের মধ্য দিয়েই  তাঁর ভিন্নধর্মী নির্মাণ  তাঁকে  বিশিষ্ট  কবিদের মধ্যে মর্যাদার জায়গা করে দেয়।এরপর একে একে  প্রকাশিত  হতে থাকে কালের কলস , সোনার কাবিন।শুধু কবিতা নয় কথাসাহিত্যিক  হিসেবেও  তিনি তাঁর  শিল্পীসত্তাকে বিকশিত করেছেন কবি ও কোলাহল  কাবিলের বোন প্রভৃতি উপন্যাসে।
কবি আল মাহমুদের জীবন-পিপাসা ও সময় সচেতন প্রত্যয়ের স্বাতন্ত্র্য, মানুষের ব্যথা বেদনা ও যন্ত্রণার ছবি  এর পাশাপাশি সংগ্রামের সর্বব্যপ্ত সপ্রেম সাহস বাংলা কবিতায় এক বিস্ময়কর সংযোজন। দেশজ ঐতিহ্যকে গভীর ভাবে আত্মস্থ করেছেন তাঁর কবিতা এত মরমী এত মোলায়েম।
 বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই 
দোহাই মাছ মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর
কথার খেলাপ  করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো বিদ্যুতের ফলা।
কতদূর এগোলো মানুষ!
কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে 
আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় 
মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে 
ভাবলাম , এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার… 

  তোমাকে বসতে হবে এখানেই
আদরে এগিয়ে দেয়া হুঁকোটাতে সুখটান মেরে
তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছু পিছু
কতদূর গিয়েছিলে  পার হয়ে পানের বরুজ।


ঢেউয়ে ঢেউয়ে মুখ দেখ, এই স্বচ্ছ
সজল স্ফটিকে 
একটি নৌকো তোর দে ভাসিয়ে
অপার তরলে
পবন পালের নায়ে ভেসে যাও
যাও রে প্রেমিক… 


বৃষ্টিহীন পরাজিত মেঘ 
বজ্রের আওয়াজ তুলে ফিরে যায় দিগন্তের দিকে।
৬ 
এভাবে সন্ধ্যা নামে , 
সব পাখি ফিরে যায় নীড়ে। 
আল মাহমুদ নিজস্ব মাটি ও শেকড়কে চিনেছেন গভীরভাবে। কোন রকম আধুনিক পাশ্চাত্য মতবাদ বা শিল্প প্রকরণের অনুসারী হওয়ার প্রণোদিত কৃত্রিমতাকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাই তাঁর কবিতা কখনও জটিল ও বিমূর্ত হয়ে ওঠেনি।
কবিকে জানতে গেলে তাঁর জীবনপথ ও সৃষ্টিকর্মকে জানা অত্যন্ত জরুরি।গ্রামীণ জীবন, নারীর রূপমাধুরী এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয় তাঁর সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। 
প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে  উল্লেখযোগ্য 
১ লোক লোকান্তর 
২ কালের কলস 
৩ সোনালী কাবিন 
৪ মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো 
৫  আরব্য রজনীর রাজহাঁস
৬  বখতিয়ারের ঘোড়া 
৭ অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না 
৮ দিনযাপন
৯ দ্বিতীয় ভাঙন
১০  একটি পাখি লেজ ঝোলা 
১১  পাখির কাছে ফুলের কাছে
১২ Selected poems 
১৩ কবিতা সমগ্র -১
১৪ কবিতাসমগ্র -২ 
১৫ না কোন শূন্যতা মানি না
১৬ পানকৌড়ির রক্ত
১৭ আল মাহমুদের গল্প
১৮ গল্পসমগ্র 
১৯ প্রেমের গল্প
২০  কিশোর সমগ্র
২১  কবির আত্মবিশ্বাস
২২  যেভাবে বেড়ে উঠি
২৩  সৌরভের কাছে পরাজিত
২৩ গন্ধবণিক 
২৪ ময়ূরীর মুখ
২৫  নদীর ভেতরের নদী 
২৬ পাখির কাছে, ফুলের কাছে
২৭  প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা
২৮ প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনার কবিতা 
২৯ প্রেমের কবিতা সমগ্র
৩০ উপন্যাস সমগ্র-১
৩১ উপন্যাস সমগ্র -২ 
৩২ উপন্যাস সমগ্র -৩  
৩৩ উপমহাদেশ 
৩৪ ত্রিশেরা
৩৫  বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ 
৩৬ ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় 
৩৭  তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে
৩৮ উড়াল কাব্য 
৩৯  এই গল্পের শেষ নেই, শুরুও নেই 
৪০ একচক্ষু হরিণ 
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার,  হুমায়ূন কবীর স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার , নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক, লালন কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার সহ  প্রচুর পুরস্কার এবং পাঠকের আত্মমগ্নতা তিনি অর্জন করেছেন তাঁর সৃজনশীল কর্মের জন্য। 
গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটে আধুনিকতার যন্ত্রণা, নৈরাশ্যের বিপরীতে আত্মমগ্ন নিঃসঙ্গতাই তাঁর কবিতায় বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বুঝেছিলেন লোকায়ত কাব্য ঐতিহ্যের কোন দেশকাল মানচিত্র নেই।ফলে ঐতিহ্যিক শিকড় আশ্রয়ী স্বকালচেতনায় প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। জনবান্ধন রাজনৈতিক দর্শন, ইতিহাসভাবনা, আধ্যাত্ম্য সংকট এবং যৌনচেতনার অপূর্ব সংশ্লেষণ  আছে তাঁর কাব্যশরীরে। নিরাভরণ সরলতার ভেতর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিস্ময়ের দুনিয়া। তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন সৌন্দর্যসৃষ্টি আর সম্ভোগের যৌথ স্বাক্ষর। 
শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হয় শ্বেতপদ্মকলি
 কোন নারী কোনদিন  তার তরে মাখেনি কাজল
আমার কবিতা শুধু ওই চোখের কসম
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গুটাও ফণা  কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে
প্রবল ছোবলে তুমি  যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তারও চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে
তুমি এসো , কোমরে পেঁচিয়ে শাড়ি 
দুঃখের ঘরকে করো শোকোত্তীর্ণ প্রাণের বাগান 
৬ 
 অক্ষরে বিম্বিত হতে চাও যদি, খুলে ধরো  সমস্ত গোপন। 
৭ 
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো  যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারোও বেশি ঢেলে দেব আন্তরিক রতির দরদ
আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন
লুকানো যায় না তবু অনিবার্য যৌবনের ফুল প্রতীকের
মতো জেগে থাকে তোমার জঘন।
তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি নরমগুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ
১০
আবার বুকের কাছে মুখ। ঘামে ভেজা মাংসের কিষাণ
তৃপ্ত করে জ্যামিতির গুল্মময় ত্রিকোণ কর্দম। 
১১
তবুও তো চাঁদ উঠে জনপদে
ব্রাকের আপার মতো ঠাট
চান্দেরী শাড়ির নিচে জোছনা দেখানো গুঢ় রাত 
১২
জলজ তুনের মতো ফের
জন্ম নেবে ধরিত্রীর  মুত্রভেজা যোনির দেওয়ালে
গ্রামীণ  প্রকৃতি এবং নারী তাঁর  কবিতার নিউক্লিয়াস। রহস্যময় নিসর্গ এবং নারী যা দেহ এবং দেহাতীত কৌতুহলের এক অপূর্ব ব্যঞ্জনায় মুখরিত হয়েছে তাঁর  কাব্যপথ।নদীমাতৃক  জনপদ মাটির মায়াবী পর্দা  লোকজীবনের পরতে পরতে  জমে থাকা জৈবরসায়ন  এবং নারী শরীরের আবেদনমুখর রহস্যলোক তাঁর কবিতাকে দিয়েছে অপরূপ শিল্পের সুষমা।নারীশরীরের অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প বাংলা কবিতায় এত সুন্দর এবং শিল্পময় ভাষায় বলার স্পর্ধা তিনিই দেখাতে পেরেছেন – ‘ আমার চুম্বনরাশি ক্রমাগত ঢেলে দেব তোমার গতরে/ ঢেলে দেব চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল/ এর ব্যতিক্রমে বানু এ মস্তকে  নামুক লানত/ ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।’ ( চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments