জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--১৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে স্বামী যোগানন্দজীর পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা উভয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ সন্তান। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংঘাত কি পারস্পরিক সম্পর্কে ছায়া ফেলেনি? অবশ্যই ফেলেছিল। ঠাকুরের কৃপায় অবশ্য সেসব দূরীভূত হয়ে তাঁদের ভালোবাসার ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবেই বজায় থেকেছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর গৃহে(অধুনা বলরাম মন্দির)একবার স্বামীজীকে যোগানন্দজী বলেই ফেললেন, “তোমার এসব বিদেশী ভাবে কার্য করা হচ্ছে। ঠাকুরের উপদেশ কি এরূপ ছিল?” উত্তরে স্বামীজী জানালেন,“তুই কি করে জানলি এসব ঠাকুরের ভাব নয়? অনন্তভাবময় ঠাকুরকে তোরা বুঝি তোদের গণ্ডিতে বদ্ধ রাখতে চাস? আমি এ গণ্ডি ভেঙে তাঁর ভাব পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়ে যাব।” আর একবার ব্রাহ্মসমাজের প্রিয়নাথ শাস্ত্রী স্বামীজীকে বলেন, “আমরা সব বিষয়েই আপনাদের সহিত একমত, শুধু আপনাদের ওই অবতারবাদে সায় দিতে পারি না।” এর উত্তরে স্বামীজী বলেন, “আমি তো ঠাকুরকে অবতার বলে প্রচার করিনা।” একথা শুনে সেখানে উপস্থিত যোগানন্দজী উত্তেজিত হয়ে পড়েন, ভাবেন,“নরেন বলে কি?” শাস্ত্রী মশায় বিদায় নিলে স্বামীজীর এই মন্তব্যে ঘোরতর আপত্তি জানান। স্বামীজী অবশ্য হাসতে হাসতে বলেন, “আমি যদি প্রচার না করতুম, তোদের ঠাকুরকে কে চিনত?” অধিকতর উত্তেজিত হয়ে পড়ে যোগীন মহারাজ বলে বসেন, “তিনি না থাকলে তুমি বড় জোর একজন ডব্লিউ সি ব্যানার্জির মতো বড় ব্যারিস্টার হতে।” এইভাবে বিষয়টি গম্ভীর হয়ে ওঠে। ভাবাবেগে উদ্বেলিত স্বামীজী চোখের জল সংবরণ করতে না পেরে ঘরে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হলেন। তাঁর দুর্বল শরীর ভাবের উত্তেজনায় যাতে অধিকতর দুর্বল না হয়ে পড়ে সেই বিষয়ে গুরুভ্রাতারা সবসময়ই সতর্ক থাকতেন। ঘটনার পরিণতিতে যোগানন্দজীও দুঃখিত হন, কেননা তিনিও স্বামীজীর শরীর বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন। পরে স্বামীজী তাঁকে বলেছিলেন,“দেখ যোগা, তোরা কি আমায় কাজ করতে দিবি না? তোরা অবতার কি বলছিস, অবতার তো ছোট কথা, ঠাকুর যে বেদমূর্তি। আমি তাঁর আদেশেই কাজে নেমেছি।” সঙ্গে সঙ্গে যোগানন্দজী বলেন,“আমরা তো চিরদিনই তোমার কথা মানি। তবু কি জান মাঝে মাঝে কেমন খটকা লাগে--ঠাকুরকে অন্যরকম দেখেছি কিনা!” সুতরাং দেখা যাচ্ছে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও প্রীতির সুগভীর বন্ধনে তাঁরা এতটাই আবদ্ধ ছিলেন যে এসব কখনওই মাথাচাড়া দিতে পারত না। যোগীন যহারাজকে এমন কথাও বলতে দেখা গিয়েছে, “আহা, নরেনের বিশ্বাসের কথা শুনলি? বলে কিনা ঠাকুরের কৃপা কটাক্ষে লাখ বিবেকানন্দ তৈরি হতে পারে। কি গুরুভক্তি!” আবার এক জায়গায় বলেছেন--“নরেন নর ঋষির অবতার। নরেনের মধ্যে ঋষির বেদজ্ঞান, শঙ্করের ত্যাগ, বুদ্ধের হৃদয়, শুকদেবের মায়ারাহিত্য ও ব্রহ্মজ্ঞানের পূর্ণবিকাশ একসঙ্গে রয়েছে।” বস্তুতপক্ষে স্বামীজী জানতেন ঠাকুর নিজকার্য সাধনের জন্য তাঁর সন্তানদের এক অনন্য প্রীতিসূত্রে গ্রন্থন করেছেন। যোগানন্দজীর উপর তাঁর নির্ভরতাও ছিল অপার। রামকৃষ্ণ মিশনের উপসভাপতি করেছিলেন তাঁকে। বেলুড় মঠের জন্য নির্বাচিত জমি কেনবার আগে স্বামীজী যোগীন মহারাজকেই সেটি চূড়ান্তভাবে দেখার জন্য পাঠান। জমি দেখে এসে স্বামীজীকে বলেন,“ফলাও জমি , সুন্দর; তুমি একবার দেখে এস।” স্বামীজী অবশ্য যাননি। তাঁর কথাতেই পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন।

 জীবনের শেষ ক'টি বছর যোগানন্দ স্বামীর ভগ্নশরীর নিয়ে অতিবাহিত হয়। অথচ এই স্বাস্থ্য নিয়েই ১৮‌৯৫ সালে ঠাকুরের জন্মোৎসব পালনের কাজটি নিষ্পন্ন করেন। এই কাজে তিনিই ছিলেন মূল হোতা। ১৮‌৯৭ সাল পর্যন্ত এই উৎসব হয়েছিল কিন্তু ১৮‌‌৯৮ সালে দক্ষিণেশ্বর মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও বিষয়ে মতবিরোধের কারণে উৎসব সম্পন্ন করা সম্ভব হয় নি। যোগানন্দজী অবশ্য পিছপা না হয়ে বেলুড়ে দাঁ-দের বাড়িতে সেই বছর ঠাকুরের জন্মোৎসব মহা সমারোহে সম্পন্ন করেন। কিন্তু শরীর আর এইসব ধকল নিতে পারল না। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শ্রীশ্রীমা তখন ২০/২ নম্বর বোসপাড়া লেনে থাকতেন। যোগানন্দজী সেই বাড়িতেই শেষ রোগশয্যা গ্রহণ করলেন। সময়টা ছিল ১৩০৬ সালের অগ্রহায়ণ মাস। এই সময় তাঁর দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ত এবং সারা মুখ রক্তে ভরে যেত। পুত্রের শেষ রোগশয্যায় পিতামাতা এসেছিলেন, যোগানন্দজী তাঁদের দেখে বলেন,“আমি আশীর্বাদ করি তোমাদের ভক্তিলাভ হোক।” সমস্ত জাগতিক মায়া, লৌকিকতার পারে তখন তাঁর মন! স্বামীজী ভীষণ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন,“যোগীন, তুই বেঁচে ওঠ, আমি মরি।” আরোগ্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকল। সে বছর ঠাকুরের উৎসবে যোগ দিতে পারলেন না। বেলুড় মঠ ততদিনে স্থাপিত হয়েছে, সেই মঠেও তাঁর আর বাস করা হয়ে ওঠেনি। স্বামীজী একদিন নৌকা করে তাঁকে বেলুড় মঠ পরিদর্শন করিয়ে যান।
  তাঁর যখন প্রায় অন্তিম অবস্থা সেই সময় শ্রীশ্রীমা যোগানন্দ স্বামীর পত্নীকে তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। জগজ্জননীর ইচ্ছা বোঝা দায়! যোগানন্দজী তীব্র আপত্তি জ্ঞাপন করেছিলেন স্ত্রীর সেবা গ্রহণে। শ্রীমা তখন বলেন,“তুমি একে দু-একটি কথা বল, একটু উপদেশ দাও।” চিরবৈরাগ্যবান যোগীন মহারাজ উত্তর দেন,“আমি ওসব পারব না, আপনি সেসব বুঝুন।” ১৮৯৯ সালের ২৮ মার্চ এল শেষের সেদিন। বাংলা ১৩০৬ সালের ১৫ চৈত্র। বিকেল তিনটে দশ মিনিটে মহা সমাধিতে লীন হলেন। স্বামীজী বললেন,“কড়ি খসলো! এবার ধীরে ধীরে সব বর্গাও খসে পড়বে।” বেদনাহত শ্রীশ্রীমা বলেন,“বাড়ির একখানি ইট খসলো, এবারে সব যাবে।” কলকাতা মহানগরীর এক অতি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান রিক্ত সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে গেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্ঘের ইতিহাসে যা অবিস্মরণীয়। এই জীবন যত অনুধাবন করা যায় তত বিস্ময়াভিভূত হতে হয়। একটি ঘটনার উল্লেখ করে আলোচনার যবনিকা টানছি। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থটি অনুসরণ করে ঘটনাটি এইরকম-- আলমবাজার মঠে বাসকালে তিনি একদিন ভিক্ষা হইতে ফিরিয়া তাঁহার অভিজ্ঞতা ভঙ্গীসহকারে মঠবাসীদিগের নিকট বলিয়া সকলকে আমোদিত করিয়াছিলেন। তিনি কহিয়াছিলেন,“মাগীটার আছে কি? একখানা খোড়ো ঘর, দুখানা ছেঁড়া কাঁথা, আর একটি তামার ঘটি! হায়রে, বলে কিনা তারই বাড়িতে চুরী করতে গেছি।” বলা বাহুল্য যে, সন্ন্যাসী যোগানন্দ তখন মানাপমানের অতীত হইয়া সহজ আনন্দ সাগরে ভাসিতেছেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments