জ্বলদর্চি

চুয়াড় বিদ্রোহ ও ক্রান্তিবীর রঘুনাথ মাহাত /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৯
চুয়াড় বিদ্রোহ ও ক্রান্তিবীর রঘুনাথ মাহাত

সূর্যকান্ত মাহাতো


"আপনা জমিন আপনা রাজ
দুর ভাগাও ইংরেজ রাজ।"

ক্রান্তিবীর রঘুনাথ মাহাতর এই স্লোগানটাই জঙ্গলমহলের মানুষকে উদ্দীপিত ও জাগিয়ে তুলেছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে ইংরেজদের রাতের ঘুমও কেড়ে নিয়েছিলেন আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের এই আদিবাসী মানুষেরাই। সহজ আর সোজা পথে তাদের শাসন আর শোষণে বাধা হয়ে উঠেছিলেন এইসব অবাধ্য মানুষগুলো। কারণ ইংরেজরা এইসব মানুষদেরকে কেবল হাতেই মারেনি, তাদের জমি ছিনিয়ে নিয়ে ভাতেও মেরেছিল। তাই তারা গোরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। আর এর ফল কী হয়েছিল? তাদেরকেই চুয়াড় বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল। 

'চুয়াড়' শব্দের অর্থ কী! অসভ্য, বর্বর, গোঁয়ার ইত্যাদি(সবগুলোই হীন বা গালাগাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়)। জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা সত্যিই কী চুয়াড়? কই, জঙ্গলমহলে তো চুয়াড় বলে কোনও জাতি নেই! তাহলে? তবে কি ইংরেজরা শাসনে বাধা পাচ্ছিলেন বলেই অবাধ্য এই মানুষগুলোকে চুয়াড় বলে দেগে দিয়েছিলেন? কী জানি! বাড়তি মুনাফালোভী, অন্যের জীবন অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা এবং সেই আতঙ্কে অবাধ্য হয়ে সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন মানুষগুলোকে যদি চুয়াড় বলতেই হয়, তা হলে তো তারা অবশ্যই চুয়াড়! অন্যের কাছে এই শব্দটা হীন মনে হলেও সংগ্রামী মানুষগুলোর কাছে সেটা অসম্মান নয়। সেটা বরং তাদের কাছে অনেক বেশি গর্বের। কারণ তারা ইংরেজদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে যায়নি। উল্টে ইংরেজরাই তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে এসেছিলেন। 

কীভাবে সেটা ইংরেজরা সম্ভব করেছিলেন, চলুন সেটাই দেখা যাক।

জঙ্গলমহলে ব্রিটিশদের লোলুপ দৃষ্টি কীভাবে পড়েছিল, তা ব্যাখ্যা করতে হলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। ১৭৫৭-র পলাশী যুদ্ধের সময়কাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে এগোনো যাক।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ। পলাশীর প্রান্তর দেখেছিল বিশ্বাসঘাতকতার এক চরম নিদর্শন। এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নবাবের শাসনের   বদল ঘটে গেল। জায়গা করে নিল কোম্পানির শাসন। সেইসঙ্গে এই যুদ্ধ দেখিয়ে দিল, বাংলার রাজা কে হবেন এবার সেটা নির্ধারণ করবে ইংরেজ বণিকরাই।

১৭৬০খ্রিস্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর মীরকাশিম নবাব হয়ে, মেদিনীপুর, বর্ধমান ও চট্টগ্রামের জমিদারি স্বত্ব ইংরেজদের হাতে প্রদান করেন। জমিদারি লাভ করে ইংরেজ কোম্পানি তিনটি প্রধান সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়েছিলেন।

১)  জমির মালিক কে হবেন? কীভাবে তার কাছ থেকে জমির খাজনা আদায় হবে? 
২)  সার্বভৌম জমিদার, সরকার এবং উৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক কীভাবে নির্ণয় করা হবে? 
৩)  কীভাবে ইংরেজ সরকার জমির উৎপাদক শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে?
এই তিন সমস্যাকে নিয়ে ইংরেজরা কয়েকটি স্তরে আলোচনাও শুরু করেছিলেন, কিন্তু একাধিক মত উঠে আসায় প্রকৃত সমাধান আর হল না। তাই ১৭৬০ সালে জমির মালিকানা কী হবে, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং খাজনা আদায়ের উপরেই বেশি জোর দিলেন। সেইমতো জনস্টোনকে(Johnstone) মেদিনীপুরের রেসিডেন্ট করে পাঠানো হল। এরপর ১৭৬২- তে বারডেটকে(Burdett) পাঠানো হয় জনস্টোনের পরিবর্তে। ১৭৬৩ সালে আবার আ্যনসেম বিউমাউন্ট(Anselm Beaumount)- কে পাঠানো হয় বারডেট এর জায়গায়। হিউজ ওয়াটস(Huge Watts) আসেন এরপর বিউমাউন্ট এর বদলে। ১৭৬৪ সালে আসেন থমাস গ্রাহাম(Thomas Graham)। এরপর১৭৬৭ সালে আসেন জন গ্রাহাম(John Graham), এবং ওই বছরেই মার্চ মাসে আসেন ভ্যানিস্টার্ট(Vanistart)।

১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২শে অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে মীরকাশিম পরাজিত হলেন। এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দ্বিতীয় শাহ আলম এর কাছ থেকে দেওয়ানী লাভ করে আরও বেশি ক্ষমতা ও মর্যাদা লাভ করে। এবং বাংলা বিহার ও উড়িষ্যায় তাদের অধিকার আইনানুগভাবে স্বীকৃত হল।

দেওয়ানি লাভ করে ইংরেজ কোম্পানি প্রথমে মহম্মদ রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে নায়েব সুবা করে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জন্য। তারা বাংলার জঙ্গলমহলেও অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতেন। এবং রাতারাতি জঙ্গলমহলের দ্রব্য বিনিময় প্রথাকেও পাল্টে দিয়েছিলেন। অতিরিক্ত খাজনা হিসাবে তারা উৎপাদিত দ্রব্য নয়, নয় স্থানীয় মুদ্রা, একমাত্র শহুরে মুদ্রা "আল্লাসিকা"- কেই খাজনা হিসাবে গ্রহণ করা হবে বলে তারা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষ কিংবা রাজা ও জমিদারেরা কোথায় পাবেন এই শহুরে আল্লাসিকা মুদ্রা? স্মরণাপন্ন হলেন শহুরে মহাজনদের কাছে। তারা অতিরিক্ত বাট্টার বিনিময়ে সেই মুদ্রা দিতেন। সেটাও বড় একটা সমস্যা। তখন জমিদার সহ অনেকেই অতিরিক্ত হারে রাজস্ব দান করতে অস্বীকার করলেন।

জঙ্গলমহলের একাধিক রাজা ও জমিদারও অতিরিক্ত হারে খাজনা দিতে অস্বীকার করলেন। তখন তাদের দমন করতেই এনসাইন ফার্গুসন ১৭৬৭ সালের জানুয়ারী মাসে কার্তিক রাম ও  চন্দন ঘোষ নামে দুজন গোমস্তা ও চার কোম্পানি সৈন্য নিয়ে জঙ্গলমহল জুড়ে সেনা অভিযান শুরু করলেন।

জঙ্গলমহলে আগে সেনাবাহিনীর কাজ করতো পাইকরা। স্থানীয় কুড়মি, সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, ভুমিজরাই পাইকের কাজ করতেন। এর বিনিময়ে তারা নিষ্কর জমি ভোগ করতেন। ইংরেজরা এই পাইকদেরকে পরাজিত করে তাদের কর্মচ্যুত করেন এবং তাদের জমি কেড়ে নিতে শুরু করলেন। এমনকি নিষ্কর জমিতেও অতিরিক্ত খাজনা আদায় শুরু করলেন। হাজার হাজার পাইক সৈন্যরা কাজ হারিয়ে, জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লেন। তাই শেষমেষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে তারাও একসময় বিদ্রোহের রাস্তাই বেছে নিয়েছিলেন।

এদিকে রাজা ও জমিদাররাও উচ্চ হারে খাজনা দিতে ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন শহুরে মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে একরকম বাধ্য হয়ে পড়েছিলেন। সময়মত সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মহাজনদেরকেই জমির মালিকানা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতে লাগলেন। এভাবেই মহাজনরাও জঙ্গলমহলে জমির নতুন করে মালিক হয়ে উঠতে লাগলেন। তারা প্রজাদের আরও বেশি শোষণ করে, বাড়তি মুনাফার ওপর বেশি করে জোর দিতে লাগলেন।

১৭৬৯- ৭০ সালে জঙ্গলমহলে অনুপ্রবেশের সময় ইংরেজেদের আক্রমণে হাজার হাজার মানুষ ঘর-বাড়ি, চাষ-বাস ছেড়ে দিয়ে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে লাগল। এবং তাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ অনাহারে মারাও গিয়েছিল। "দি অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল" গ্রন্থে হান্টার উল্লেখ করেছেন, ১৭৯৮-১৮০৫ সালে বনে- জঙ্গলে বাস করে অনেকেই অনাহারে মারা গিয়েছিলেন।

এভাবেই সাধারণ মানুষ জল-জমি- জঙ্গল সবকিছুই ইংরেজদের কাছে হারাতে বসলেন। অবশেষে তাই তারাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ও প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে পড়লেন।

ইংরেজদের ভূমি রাজস্ব নীতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নতুন নিয়ম, অতিরিক্ত হারে রাজস্ব আদায়ের কৌশল, পাইকান জমিগুলোকে কেড়ে নেওয়া, নির্বিচারে শাসন আর শোষণকে জঙ্গলমহলের মানুষ সহজভাবে মেনে নিল না বলেই অশান্ত জঙ্গলমহলে বিদ্রোহ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। স্লোগান উঠতে লাগল---
 "আপনা জমিন আপনা রাজ 
দুর ভাগাও ইংরেজ রাজ।"

জঙ্গলমহল জুড়ে গড়ে ওঠা এই বিদ্রোহকে বলা হল "চুয়াড় বিদ্রোহ"। জে সি প্রাইস এই বিদ্রোহকে Great Chuar Rebellion বলে উল্লেখ করেছেন, তার গ্রন্থে। চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে "The Chuar Rebellion of 1799" গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন ----

"1799 is marked in the Midnapore annals as the year of great chuar rebellion, ghostly with its tales of horror and massacre; when all the evil passions of the infuriated of their Jagir lands on the Government if not to compel it to order a complete restoration of them. All the lawless tribes of the Jungle Mahals made common cause with the paiks and carried slaughter and flame to the very doors of the Magistrate's Cutchery."

১৭৬৯-১৮০৫ পর্যন্ত এই দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ধরে চলা চুয়াড় বিদ্রোহের দুটি পর্যায় ছিল। প্রথম পর্যায়ে রামগড়, লালগড়, ঝাড়গ্রাম, জামবনি ও শিলদার  রাজা ও একাধিক জমিদার সবাই বাড়তি রাজস্বদানে ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ধলভূমের রাজা তখনও ইংরেজদের বৈশ্যতা স্বীকার করেননি। বরং তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

তবে প্রথম পর্যায়ে চুয়াড় বিদ্রোহের মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন ক্রান্তিবীর রঘুনাথ মাহাত। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই ক্রান্তিবীরকে ইতিহাস চিরকাল উপেক্ষা করে গেছে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একটি দারুণ কথা বলেছেন---
"We talk of Gandhi And Jawaharlal
of Matilal, Tilak and the rest
But never of these men;
Who bared their breast
To bullets brave, necks the swinging rope..."

সত্যিই তো আমরা সবাই গান্ধী, নেহেরু, তিলকদের মতো দেশপ্রেমিকদের সম্পর্কেই বেশি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহান লড়াইয়ে আরও যে কত বীরপুরুষ আত্ম বলিদান দিয়েছেন তাদের কথা ইতিহাসও মনে রাখেনি। আবার আমরাও স্মরণ করিনি। এমনকি ইতিহাসের পাতাতে তাদের স্থানও দিইনি। 

এই যেমন ক্রান্তিবীর রঘুনাথ মাহাত। চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার আহ্বান, স্বাধীনতার সুখ ও অধিকার সম্পর্কে অন্যদের সচেতন করে, ধীরে ধীরে সংগঠন গড়ে তুলে, নির্যাতিত মানুষগুলোকে সংঘবদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ডাক তো তিনিই দিয়েছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও আন্দোলন তো তিনিই গড়ে তুলেছিলেন ১৯৬৯ সালে।

এই ক্রান্তিবীরের নাম রঘুনাথ মাহাত। জন্ম  ১৭৩৮ সালের ২১শে মার্চ। পিতার নাম কাশীনাথ মাহাত এবং মাতা- করমি মাহাত। গ্রামের নাম তৎকালীন বিহারের অন্তর্গত ঘুঁটিয়াডি। পোস্ট অফিস- মধুপুর। থানা- নিমডি। জেলার নাম- সরাইকেল্লা খারসাওয়া ( ঝাড়খন্ড)। রঘুনাথ মাহাতরা  তিন ভাই ও এক বোন ছিলেন। অন্য দুই ভাই এর নাম হল, তুকারাম মাহাত ও বাবুরাম মাহাত। একমাত্র বোনের নাম তনু মাহাত। এই নামে একটু ডুংরিও আছে। নাম 'তনু ডুংরি'। রঘুনাথ মাহাত যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করতেন তখন এইসব ডুংরি বা পাহাড়ে আত্মগোপন করে থাকতেন। তিনি ঠিক কোথায় থাকতেন সেই খবর একমাত্র বোন তনু মাহাতই জানতেন। তিনিই রঘুনাথ মাহাতকে খাবার ও অস্ত্র সরবরাহ করতেন। সেই থেকেও ডুংরিটার নাম তনু ডুংরি হয়ে থাকতে পারে।

বোলতার মতো তীর-ধনুক নিয়ে ধাঁ করে ইংরেজদের আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ করে হঠাৎ করেই নিমেষে লুকিয়ে পড়তে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর।আত্মগোপন করতে পারার এই অসাধারণ কৌশল তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির কোলে মানুষ হতে হতে রপ্ত করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই রঘুনাথ ছিলেন ক্রান্তিকারী স্বভাবের এবং বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন। একবার এক তশিলদার রঘুনাথের বাবাকে অপমান করেছিলেন বলে রঘুনাথ সেই তশিলদারকে মারতে মারতে গ্রামছাড়া করেছিলেন।

ইংরেজদের হাতে জমি হারানোর যন্ত্রণা যে কতটা কষ্টের ও দুঃখের সেই কথা ক্রান্তিবীর রঘুনাথ মাহাতো গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বলতে লাগলেন। এবং কীভাবে ফিরে পাওয়া যাবে সেই কথা বলে বলে সংগঠনকে বাড়াতে লাগলেন। অবশেষে ১৭৬৯ সালে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন ঝগড়ু মাহাত, বুলি মাহাত, পুলকা মাঝি, শংকর মাঝি, ডমন ভূমিজদের সঙ্গে নিয়ে লাঠি, তীর-ধনুক, ফারসার মত দেশীয় অস্ত্র নিয়েই ইংরেজদের 'নিমুধল' কেল্লা উড়িয়ে দেন। ইংরেজ সৈন্যরা নরসিংহ গড়ে পালিয়ে গেলেও পরে ১৭৭৪ সালে  বিদ্রোহীরা কিংচুক পরগনায় পুলিশের হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করেন এবং ইংরেজদের হত্যা করেন। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছিল যে ব্রিটিশ সরকার ছোটনাগপুরকে বিহারের পাটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একরকম বাধ্য হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান ছিলেন সিডনি ডিমথ। তিনি বিদ্রোহ দমনে অভিযান করলে বিদ্রোহ আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

এভাবেই সিল্লীর লোটাকিতা গ্রামে রঘুনাথ মাহাতো বিপ্লবীদের নিয়ে রামগড় পুলিশের ছাউনি আক্রমণের একটি নীল নকশা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ১৭৭৮ সালের ৫ই এপ্রিল ইংরেজরা রঘুনাথ মাহাতোকে ঘিরে ফেলে অতর্কিতে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। রঘুনাথ গুলিবিদ্ধ হন। মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি সহযোদ্ধাদের বলে গেলেন---

"হামর মরাক পরেও লঢ়াই চালাই যাবে হে, মনি রাখিস শিখ- শিখর- নাগপুর আধাআধি খড়্গপুর, ইটাই হামর ছোটনাগপুর, ইটাই হামার মাঈভুঁই।"

বর্তমান সরকার, লালগড়ে কংসবতী নদীর ওপর যে সেতু নির্মিত হয়েছে তার নামকরণ করেন এই বীর মহানায়কের নামে। সেতুর নাম রাখা হয় "বিপ্লবী রঘুনাথ মাহাতো সেতু"। আগামী ২১শে মার্চ (২০২২) তাঁর জন্মদিনে লালগড়েরই তেমাথানি মোড়ে তাঁর একটি পূর্ণ অবয়ব মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে। ইতিহাসের পাতায় নাই বা স্থান হল,জঙ্গলমহলের মানুষের হৃদয়ে তো তিনি চিরকাল মহানায়ক হিসাবে জায়গা করে নিয়েছেন এটাই বা কম কিসের!

দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ  ছিল সব থেকে বেশি ভয়ংকর। স্থানীয় সামন্তরা, জমিদার, পাইক, সাধারণ প্রজা সকলেই তখন একজোট হয়ে উঠেন। ১৭৯২ এ পাতকুম অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৯৪ এ ঝালদা তোমার ও রামগড়েও বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৭৯৮ এ রায়পুরের কাছারি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় ১৫০০ পাইক। গোবর্ধন দিকপতি(বাগদি সর্দার) ১৭৯৮ এ চন্দ্রকোনা আক্ৰমণ করেন।  শিলদার দুটি গ্রাম ওই বছরেই পুড়িয়ে দেওয়া হলে বিদ্রোহের আগুন দাবানল হয়ে উঠে। ১৭৯৯ সালে মেদিনীপুর শহরের উপকণ্ঠেই কয়েকটি গ্রাম লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে স্থানে স্থানে বিদ্রোহীরা জমায়েত হয়ে একের পর এক আক্ৰমণ করতে শুরু করেছিলেন।

বিদ্রোহীদের ধরাও এত সহজ ছিল না। কারণ স্থানীয় নারী- পুরুষেরাই গানের সুরে সাবধান করে দিত বিদ্রোহীদের এই বলে---

"লক আসছে লুকাও রে--- আও
আগু দিগেও ভালবে রে, পিছু দিগেও ভালবে রে
লক আসছে লুকাও রে--- আও"

ঝাড়খন্ড রাজ্যের পটমদা থানার বড়াম এর কাছে রূপসান ডুংরির নিচে ১লা মাঘ পূজা দেওয়ার সময় আদিবাসী ভুমিজরা এখনও সংগ্রামীদের সাবধান করতে এই গান করেন।

১৭৯৯ সালের ১৬ই মার্চ বিদ্রোহীরা আনন্দপুর আক্ৰমণ করলে, ১৭ ই মার্চ মেদিনীপুরের কালেক্টর কর্নেল ডানকে এক চিঠিতে লিখলেন, মেদিনীপুর শহর বিদ্রোহীরা আক্ৰমণ করতে পারে এমনটাই নাকি তার কাছে খবর আছে। তাই তোষাখানার অর্থ বুরুজখানায় রাখতে চান। এতেই বোঝা যায় কী পরিমান আতঙ্ক তৈরি করেছিলেন সেসময় বিদ্রোহীরা।

অবশেষে বিদ্রোহকে প্রবল প্রতিরোধে দমন করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে অনেক কিছু দাবিও  মেনে নেওয়া হয়েছিল। যেমন---

১) সমস্ত service tenureগুলি পূর্বতন ঘাটোয়ালদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
২) জমিগুলো তারা পুরুষানুক্রমে ভোগ দখল করতে পারবে। তার জন্য নতুন regulation তৈরি হয়।
৩) জমিগুলো সার্ভে করে ঘাটোয়ালদের নামে নথিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যোদয়ের আইনে নীলাম বিক্রি বন্ধ করা হয়।
৫) ইংরেজদের পুলিশ বাহিনী প্রত্যাহার করে সামন্তদের হাতেই পুলিশের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৬) নতুন করে প্রজাস্বত্ব আইন গঠিত হয়।
৭) ১৮০৫ সালে বীরভূম ও মেদিনীপুরের ২৩ টি পরগণাকে নিয়ে একটি নতুন জেলা "জঙ্গলমহাল" গঠন করা হয়। যার প্রশাসন কেন্দ্র বাঁকুড়া।

এরপরেও বিদ্রোহ একেবারেই শেষ হয়নি। ধিকিধিকি করে আরও কিছুদিন চলেছিল। এবং অন্যান্য বিদ্রোহ যেমন খেরওয়াল, সাঁওতাল,মুন্ডা বিদ্রোহের মতো বিদ্রোহগুলোর রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল এই বিদ্রোহ। এটাই ছিল এই বিদ্রোহের মূল সার্থকতা।

তথ্যসূত্র:
১)ঝাড়খণ্ড: সমাজ ও বিদ্রোহ-আন্দোলন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাত ও সজল বসু
২) জঙ্গলমহাল ও মেদিনীপুরের গণ বিক্ষোভ/ ডঃ বিনোদ শঙ্কর দাস
৩) মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু
৪) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি/ মধুপ দে
৫)পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি দ্বিতীয় খণ্ড/ বিনয় ঘোষ
৬) চুয়াড় বিদ্রোহ: নকুল মাহাতো(আহল্যাভূমি পুরুলিয়া /দেবপ্রসাদ জানা ১ম খণ্ড)
৭)জঙ্গলমহল থেকে পুরুলিয়া এক রক্তাক্ত অধ্যায়: জলধর কর্মকার(অহল্যাভূমি পুরুলিয়া/দেবপ্রসাদ জানা)
৮) ক্রান্তীবীর রঘুনাথ মাহাত ও স্বাধীনতার আলোকে ইতিহাস: সঞ্জীব মাহাত(ধানশিস ১ম সংখ্যা)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments