জ্বলদর্চি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ১১


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী 

‘যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো / আমি বিষপান করে মরে যাবো! / বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ / নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ / প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ- / এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি / যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো / আমি বিষপান করে মরে যাবো…’ – কোথা থেকে শুরু করি? বাবার কেনা রেকর্ডে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে আবৃত্তি থেকে? অথবা, সেই আইডিয়াল বুক স্টোরে দাঁড়িয়ে ‘স্মৃতির শহর’ পড়ে বিস্মিত কিশোরীর ভালো-লাগা থেকে নাকি ‘ভালো-বাসা’-তে বসে দীপঙ্কারদার (সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী) কাছ থেকে তাঁর গুরু সুনীলদার কথা শুনতে শুনতে কৌতুহলের উদ্রেক থেকে? অথবা দীপঙ্করদার সঙ্গে এক মহালয়ার সকালে লেখক সুনীলকে দেখতে যাওয়া থেকে? আগে কখনো লিখেছি আমার বেড়ে ওঠার সময়ের অনেকখানি হিন্দুস্থান পার্কে 'ইলাবাস'-এ থেকেছি। সামনেই সুনীলমাধব সেনের বাড়ি... ঢিল ছুঁড়লে 'ভালো-বাসা', নরেন্দ্র দেব রাধারাণী দেবীর বাড়ী, পরবর্তীতে নবনীতা দেব সেনের।
কখনও লিখেওছি নবনীতাদির বাড়ি ভালোবাসা-তে সেই সময়ের অনেকখানিই কাটত আমার। সব সময় যে নবনীতাদির সঙ্গেই গল্প হতো, তা নয়। রাধারাণীদেবীর ঘরে যাওয়া বা দীপঙ্করদার সঙ্গে আড্ডাও চলতো, কখনো টুম্পার (নন্দনা সেন) সঙ্গেও গাল-গপ্পো। নবনীতাদির বাড়িতে থাকতেন সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী, কেন থাকতেন সেসব এই লেখার বিষয় নয়। দীপঙ্করদা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাগজের অফিসে সাংবাদিকতা করেছিলেন, আনন্দবাজার পত্রিকায়ও, তাঁর কর্মজীবন শুরুর আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে গল্প-গুজব হতো। যতক্ষণ কথা বলতেন দীপঙ্করদা, অধিকাংশ সময়ই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে কথা বলতেন। সম্ভবত সেইখান থেকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার প্রতি উৎসাহ জন্মায়। আমি লিখবো কখনো মোটেও ভাবিনি তখন, দীপঙ্করদার সঙ্গে ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ী অবলীলায় যেতে পেরেছিলাম তাই, সে-যাওয়া ছিল লেখকের কাছে পাঠকের যাওয়া, কোনো যশোপ্রার্থীর যাওয়া নয়, কারণ কবি হওয়ার পূর্বকল্পিত কোনো অভীপ্সাই ছিল না আমার। যাইহোক, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়া সত্ত্বেও সুনীল বাড়ি ছিলেন না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মহালয়ার সকালে যে এক ঘন্টা আমরা সুনীলের অপেক্ষায় ছিলাম, স্বাতীদির সঙ্গে কথায় ভরে উঠেছিল সময়টা। আমার নামকরণ থেকে সন্তোষকুমার ঘোষ অবধি সবই ছিল সেই গল্পের বিষয়। একঘন্টা বাদে সুনীল প্রচুর বন্ধুসহযোগে লেকক্লাব থেকে ফিরলেন। ফিরেই আপনি-আজ্ঞে শুরু করলেন। দীপঙ্কারদা বললেন, ঈশিতা অনেক ছোট, ‘আপনি’ করে বলার প্রয়োজন নেই। সুনীলদা বললেন, আরে না না এই বয়সে ‘আপনি’ শুনতে ভালোই লাগে সকলের। 
একে একে সুনীলের কবিতা কন্ঠস্থ হয়ে উঠল – ‘নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ / তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর / ফুসফুস-ভরা হাসি / দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা / এ-সব এখন তোমারই, তোমার হাত ভরে নাও আমার অবেলা / আমার দুঃখবিহীন দুঃখ, ক্রোধ শিহরণ / নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছিল আভরণ / জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানলার পাশে / বালিকার প্রতি বারবার ভুল…’
অথবা 
‘উনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উন্‌তিরিশে এসে / গর্ভবতী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ / কাঁপালো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতারে কুটিল সন্দেহ / সমস্ত শরীরে মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্ত অবশেষে / যন্ত্রণার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক, / এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক…’
অথবা
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাওলো, কেউ কথা রাখেনি / ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল / শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে। / তারপর কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা চলে গেল কিন্তু সেই বোষ্টুমী / আর এলো না / পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি…’
কবিতার পাশাপাশি তাঁর উপন্যাস ছোট গল্পও মনের মধ্যে দাগ কাটতে লাগল। মনে আছে একবার আনন্দ পাবলিশার্স কলেজস্ট্রীটে তাদের দোকানে তাদের পুরনো বই অনেকই কম দামে বিক্রী করেছিল। সেখান থেকে ভয়ানক কম দামে অর্থাৎ ১ টাকা ২ টাকায় আমি কিনেছিলাম কয়েকটি বই। তার মধ্যে সুনীলের কয়েকটি বইও ছিল, একা এবং কয়েকজন, সংসারে এক সন্ন্যাসী, স্বর্গের বারান্দায়। সেই বয়সে ওই বইগুলো পড়ে কী যেন হলো! এমন নয় যে তাঁর বই পড়েই তাঁর কাছে আমি ছুটে গিয়েছিলাম গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে অথবা যশোপ্রার্থী লেখক হয়ে, তাঁর বাড়িতে সকালবেলার আড্ডায়ও আমি কখনো যাইনি। হয়তো সারা জীবনে তাঁর সঙ্গে আমার দশবার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল, কখনো অনিরুদ্ধ আশির অনুষ্ঠানে, কখনো সাহিত্য অকাদেমির অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে, কখনো সই-এর অনুষ্ঠানে, কখনো পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির পুরস্কার-প্রাপ্তির মঞ্চে। আমার যা-কিছু মুগ্ধতা তাঁর লেখাগুলি নিয়েই।
কৃষ্ণ যেমন শত নাম ব্যবহার করতেন, সুনীলও একাধিক নাম ব্যবহার করে লিখতেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীললোহিত, সনাতন পাঠক, নীল উপাধ্যায়। একেক নামের লেখা একেক রকম। নীললোহিতের বয়স সাতাশের বেশি হয় না কখনো। নীললোহিতের ‘তিন সমুদ্র সাতাশ নদী’ পড়ে জানলাম এভাবেও ভ্রমন লেখা যায়, খুব সম্ভবত সেইদিন থেকেই বিদেশ-ভ্রমণের পোকা মাথায় কিলবিল করে উঠেছিল। সেই বইয়ে ছিল নীললোহিত নিজেকে এক ভ্যাগাবন্ডের চরিত্রে এঁকেছিলেন, যে ২০০ ডলার পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিদেশ-ভ্রমণে, সস্তায় রিটার্ন টিকিট পেয়ে পাঁচমাস ধরে ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে আসে। নীললোহিতের সেই লেখায় সুনীলও তাঁর স্ত্রী স্বাতীকে নিয়ে আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন, নীললোহিত কেন্দ্রীয় চরিত্রে দাঁড়িয়ে থেকে সেই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লিখেছিলেন, এখানে সুনীল আলাদা এক চরিত্র হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন। প্লেন যে আবার দোতলা হয়, সেকথাও এই লেখা পড়েই জেনেছিল সেই কিশোরী থেকে যুব্তী হয়ে-ওঠা মেয়েটি। যদিও পরে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের সময় আমাদের কোয়ান্টাস এয়ারলাইন্সের দোতলা প্লেনে ওঠার সুযোগ হয়েছিল।


ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘প্রথম আলো’কে বাদ দিলে ‘সেই সময়’ তর্কাতী্ত ভাবে সুনীলের সেরা কাজ। বাংলায় নবজাগরণের সময়কে, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়কে যেভাবে সুনীল তাঁর ‘সেই সময়’ উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন সেসব অতুলনীয়ই বলা যায়। দেশ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে উপন্যাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে মানুষের মনের অভ্যুত্থান এবং পতনের বিভিন্ন অধ্যায় নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
তারপর সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইটি্র কথা ভাবা যাক। তাঁর পাঁচবারের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা নিয়ে এই বই। সাধারণ ভ্রমণকাহিনীর থেকে এই লেখার স্বাদ একেবারেই ভিন্ন। নিছক বেড়ানো আর দ্রষ্টব্য স্থানের বিবরণকে ছাপিয়ে এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে ফরাসীদেশের আগাগোড়া খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা, শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ঐতিহ্যের মধ্যে ঘোরাফেরা। পল অ্যাঙ্গেলের আমন্ত্রণে আইওয়া ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে গিয়ে যে শিল্প-সাহিত্য-পাগল ফরাসী যুবতী মার্গারেট ম্যাথিউ-এর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল, সেই তার কথাও ছড়িয়ে আছে এই বইয়ে আত্মজীবনীমূলক বৃত্তান্তের মাধ্যমে। এই বইয়ের প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরুতে রয়েছে বিখ্যাত একেকজন ফরাসী কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি, সুনীলেরই অনুবাদে। এই বই পড়ার অনেক পরে আমার ভার্সাই, লুভ্যর দেখার সুযোগ হয়ে থাকলেও আমার প্রথম দর্শন তো এই বই পড়েই হয়েছিল। 
দেশ পত্রিকায় ‘অর্ধেক জীবন’ পড়েছিলাম। আমার মনে হয়েছে এই আত্মজীবনীমূলক লেখাটি তদানীন্তন সময়ের একটি দলিলও বটে। এই লেখাতে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সময়ের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা উঠে এসেছে, সেই পরিবারের কর্তা এক শিক্ষক। এবং সেই পরিবারেরই সন্তান সুনীলের লেখক হয়ে ওঠার গল্প, যেখানে লিখে যাওয়ার অর্থ ও কারণ খুঁজেছেন লেখক। এই বইয়ে তাঁর এবং তাঁর কবি-সাহিত্যিক বন্ধুদের বোহেমিয়ান জীবনের কথা যেমন লিখেছেন, অগ্রজ সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার কথাও লিখেছেন।
গদ্যকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবি সুনীলকে কতখানি ছাপিয়ে গেছেন, সে নিয়ে সমালোচকরা বলবেন। কিন্তু আমি তো বলব তাঁর কবিতাও সমান্তরাল ভাবে চলেছে, আমাদের মতো পাঠকের মনে তো তাঁর কবিতাও সদা বিরাজমান। নীরা নাম্নী এক নারী-চরিত্রের সৃষ্টি করে একের পর এক প্রেমের কবিতা লিখেছেন –
‘বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল / স্বপ্নে বহুক্ষণ / দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন– / বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে / তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের / নীল দুঃসময়ে।…’
অথবা
‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ / আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি? / শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায় / তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো / যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে / নীরার সুষমা / চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু?...’
যাইহোক শুধু তো প্রেমের কবিতা নয়, তাঁর অজস্র কবিতা কিংবদন্তী হয়ে পাঠকের মনে বেঁচে আছে, তাঁর এরকমই একটি কবিতা – ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ / এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ / পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা / আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা / করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে / থাকি - তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে / হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি…’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কতখানি গদ্যকার, কতখানি কবি, বা তাঁর কোন গদ্য কালজয়ী সেসব আলোচকরা বলবেন। আমি শুধু তাঁর লেখা নিয়ে পাঠকের মুগ্ধতাটুকু রাখলাম এখানে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

1 Comments