জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০২/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫৭


প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০২

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
মেঘের কোলে রোদ উঠেছে ...


'দেখো বাবু, আমার নাতনির পড়াশুনা যেন ভালো হয়'― লেখাপড়া-জানা-ঠাকুরমার সাবধানী বাক্য। বর্ধমানের এক সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়ে ঠাকুরমা শরৎকুমারী দেবী। তাঁর গানের গলাটিও বেশ মধুর। নাতনির পড়াশোনার বিষয়ে দারুণ সচেতন।
'হ্যাঁ'―সম্মতিতে অহেতুক-অপ্রস্তুতে-পড়া পল্লীগ্রামের প্রধানশিক্ষকের মাথাখানি উপর-নিচে সামান্য নাড়িয়ে ভাবলেসহীন তাৎক্ষণিক উত্তর।
'আর দেখো―তালপাতার লেখাগুলো আমি না-দেখা পর্যন্ত কেউ যেন মুছে না-ফেলে'―ঠাকুরমার কড়া হুকুম।

গ্রামের পাঠশালা। খানিকটা আগেকার গ্রাম্য-টোলের মতো। গোপীনাথপুর গ্রামের অদূরে বাড়ি থেকে এ হেন পাঠশালাটি প্রায় আধ ক্রোশ দূরে। একজন মাত্র প্রধান শিক্ষক। নির্জন পরিবেশে পাখির কিচিরমিচির আর অল্প সংখ্যক কচিকাঁচার ভীড়। তাদের মিলিত কলরবে গমগম করছে পাঠশালাটি। তারস্বরে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর পাঠ রপ্ত করার কৌশলটি বেশ অভিনব! আনন্দদায়কও। বছর ছয়েকের নাতনিকে সে-পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন শরৎকুমারী দেবী। পাঠশালায় ভর্তি করলেও ঠাকুরমার তীক্ষ্ম নজর নাতনির লেখাপড়ার উপর সদা ন্যস্ত। পড়াশুনায় একফোঁটা ফাঁকিবাজি তাঁর চোখ এড়ানো কঠিন। তাছাড়া লেখাপড়ায় ঢিলেমি একদম বরদাস্ত করেন না তিনি। বেশ রাশভারী গোছের মহিলা। অক্ষরে অক্ষরে তাঁর সব হুকুম মেনে চলা চাই। ওদিকে গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে খেলে-পড়ে-মজা করে দিন কাটে ছোট্ট অসীমা'র। পাঠশালায় সমবয়সী মেয়েগুলোর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল অল্প ক'দিনে। এ হেন গ্রামের পাঠশালাতেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি ছ'বছর বয়সে। 

তার আগে পর্যন্ত ছোট্ট অসীমা'র প্রায়শই শরীর খারাপ হত। জ্বর-জাড়ি হামেশাই লেগে থাকে। বাবা-মায়ের একরাশ দুশ্চিন্তা। পার্মানেন্ট সেরে ওঠার লক্ষণ নেই। শেষমেশ শিক্ষক-ডাক্তার বাবার সব ডাক্তার বন্ধুর একযোগে পরামর্শ― আবহাওয়ার পরিবর্তনে রোগ সারলেও সারতে পারে। অগত্যা দেশের বাড়ি গোপীনাথপুরে মেয়েকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা; নিদেনপক্ষে ছয় মাসের জন্য হলেও! মেয়ের হয়েছে যত জ্বালা! মা-বাবা কলকাতায়। বাবা-মাকে ছেড়ে আগে কখনও বাড়ির বাইরে দিন কাটেনি মেয়েটির। কীভাবে দিন কাটবে, কে জানে! অল্প সময়ের মধ্যে অবশ্য গ্রাম্য পরিবেশে অত্যন্ত সাবলীল হয়ে ওঠে সে। মানিয়ে নেয় গ্রামের জলকাদায়। গ্রামের বাড়িতে ঠাকুরমা-পিসিমা'র যত্নে সুন্দর দিন কাটে ছোট্ট অসীমা'র।
     

নাতনির দেখভালের যাবতীয় দায়িত্ব সচেতন ঠাকুরমার ঘাড়ে। কী পড়াশুনা, কী লেখাপড়া― সবেতেই তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টি। নিজে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ভোরের আলো জ্বলার আগে তাঁর দারুণ ব্যস্ততা। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। নাতনিকে ঘুম থেকে তোলা, মুখ-হাত ধুইয়ে রেডি করা, লেখার কালি তৈরি, লেখার জন্য পরিস্কার তালপাতা প্রস্তুত করে রাখা, বইপত্র গুছিয়ে সকাল সকাল পাঠশালায় পৌঁছানোর বন্দোবস্ত― সব কাজে নিঁখুত তিনি। এই প্রসঙ্গে সেদিনের সেই ছোট্ট নাতনি বড় হয়ে নিজের স্মৃতিচারণে লেখে―
'ঠাকুরমা রাত্রি চারটায় উঠতেন। আমার লেখার কালি তৈরি করে দিয়ে তালপাতা এবং বই ঠিক করে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে সকাল ৬টায় পাঠিয়ে দিতেন। ঠাকুরমার নির্দেশ ছিল যতক্ষণ না ঠাকুরমা দেখছেন আমি তালপাতায় কী লিখছি ততক্ষণ পর্যন্ত তালপাতার লেখা জল দিয়ে না ধুয়ে ফেলি। ঠিক সকাল দশটায় পাঠশালার ছুটির সময় ঠাকুরমা আমাকে আনতে গিয়ে সব লেখা দেখতেন তারপর নিজেই তালপাতাগুলি জল দিয়ে ধুয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি আসতেন। জলখাবার ছিল মুড়ি এবং গুড়, আবার আমের সময় আম। আমাদের অনেক আমবাগান ছিল।'

পাঠশালা ছুটির সময় সকাল দশটা। তারপর পায়ে হেঁটে, মাঠের আলপথ ধরে ঠাকুরমার সঙ্গে সোজা ঘরে ফিরে আসা। ফিরে আসার সময় পথের দুপাশে গাছগাছড়ার উপর মেয়েটির সজাগ কৌতূহলী দৃষ্টি। মনে পড়ে যায় বাবা বলত―অমুক গাছের উপকারীতা কী, তমুক গাছ কী কী কাজে লাগে, অমুক গাছ থেকে কী কী ওষুধ হয় ইত্যাদি। সপ্তাহান্তে প্রতি শনিবার বাবা ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় হুগলি জেলায় গ্রামের বাড়ি গোপীনাথপুরে আসেন। বাবার অত্যন্ত আদরের রাজকন্যার সেদিন খুব আনন্দের দিন। বাঁধনহারা খুশি। গ্রামে আসার সময় শহর থেকে নানান রকম মিষ্টদ্রব্য, মরসুমী ফল আর তরিতরকারি কিনে আনেন বাবা। 

গ্রামের জল-মাটি-বাতাসে যেন জাদু আছে। অতি সহজে আপন করে নেয়। আদরে-ভালোবাসায় ভরিয়ে তোলে নিমেষে। ছয় মাস কাটল। মেয়েটা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ঠাকুরমা-পিসিমার যত্নআত্তি আর দেশের বাড়ির শুভ জলহাওয়ায় দিব্বি সুস্থ সে। সুস্থ হয়ে বাবার সঙ্গে পুনরায় কলকাতার বাড়ি ফিরে আসে সে। হয়তো সেদিন গ্রামের আম-জাম-বকুল-কাঁঠাল গাছ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিল নীরবে! হয়তোবা একটানা অশ্রুতে ভিজে গেছে কাঁঠালচাপার তলা! কোজাগরী চাঁদ হয়তো ঢাকা পড়েছিল ক্লান্তিহীন মেঘে!

(২)
নানা রঙের দিনগুলি...


'মেয়েকে ভালো করে পড়াও'― চিঠিতে মায়ের উদ্দেশ্যে ঠাকুরমার কড়া নির্দেশ। এক্ষেত্রে একলা সময়টার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। সালটা ১৯২৪। যুদ্ধ বিধ্বস্ত হওয়ার পর গোটা বিশ্ব পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকে ধীরে ধীরে। পুনর্গঠনের সে এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণে পুরো পৃথিবী। ভারতের আকাশে-বাতাসে সমাজ বদলের অশান্ত ভাবনা তখন উড়ু-উড়ু। বিশেষত নারীশিক্ষা বিষয়ে সমাজ যে-তিমিরে ছিল, তার অবস্থানের খুব বেশি হেরফের হয়নি। শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত সমাজের ভয়ে নিয়ত অশিক্ষার ভ্রুকুটি নিয়ে বাঁচে। স্কুলশিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষা তাদের কাছে ডুমুরের ফুল মনে হয়। সমাজ সংসারের ভয়ে সেজন্য বেশিরভাগ পরিবার ঘরের বাইরে নারীশিক্ষায় প্রায় উদাসীন। এ হেন প্রতিকূল আবহে মেয়েকে কলকাতার বেথুন স্কুলে ভর্তি করলেন বাবা। ছোট্ট অসীমা'র বয়স তখন সবেমাত্র বছর সাত। একটি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে মেয়েটির জন্ম। ওই ফ্যামিলির একজন প্রগতিশীল বর্ষীয়ান মহিলা তার ঠাকুরমা। তার উত্তোরণের নেপথ্যে ঠাকুরমার এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি দারুণ কাজে লাগে। পড়াশুনার দেখভালে কোনও খামতি থাকে না। এদিকে ঠাকুরমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না মা কমলা দেবী। আদাজল খেয়ে মেয়ের পেছনে পড়ে রইলেন সর্বক্ষণ। লেখাপড়ায় কোনও কমতি যেন না থাকে। জ্যেঠিমা মনোমোহিনী দেবীর গুণের কদর বলে শেষ করা যাবে না। ইংরেজি আর উর্দুতে তুখোড় তিনি। 
         

গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার পর প্রায় ছ'মাস উত্তীর্ণ। কলকাতার রাজপথে তখন দু'ধরনের বাস গাড়ি চলে। এক মোটর বাস। দুই ঘোড়ায় টানা বাস। প্রথমদিকে দুই ঘোড়ার বিরাট বাসে চেপে বেথুন স্কুলে যেত সে। সকাল সাড়ে সাতটার সময় বাস গাড়ি এসে পড়ত বাড়ির গেটে। বাস এসে গেলে মায়ের ব্যস্ততা তখন চরমে। খাতা-বইয়ের ব্যাগটা গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে নিস্তার। মায়ের সঙ্গে বাবাও হাজির থাকত মেয়ের স্কুল যাওয়ার সময়। কখন মেয়ের স্কুলবাস গলির মোড়টা ঘুরে দৃষ্টির অন্তরালে ডুব দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত দুজনে। এ ছিল প্রতিদিনের রুটিন কাজ। বেশ কয়েক বছর পর ঘোড়ার গাড়ি বদলে মোটর বাসের ব্যবস্থা হয়েছিল।

স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যায়; সেই বিকেল সাড়ে চারটা কি পাঁচটা। মেয়ের ফেরা অব্দি মায়ের দম ফেলার ফুরসৎ থাকে না। কলকাতায় তখন বাবা-জ্যাঠার যৌথ সংসার। ফ্যামিলির যাবতীয় কাজ সেরে রাতের বেলায় মেয়ের হোম-ওয়ার্ক নিয়ে বসে পড়তেন মা। অনেক রাত পর্যন্ত চলে ক্লাসের পড়া তৈরির কাজ। সবসময় ওই টুকু কম সময়ের ভিতরে সব বিষয়ের পড়াশোনা শেষ হয় না। বাকি থেকে যায়। অবশিষ্ট হোম-ওয়ার্ক তৈরির জন্য খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে পড়তেন মা। রাত তখন তিনটে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিশুতি রাত্রির নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে ঘরের বাইরে। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই! দু-একটি পথকুকুরের বিক্ষিপ্ত ঘেউ ঘেউ ছাড়া। গভীর ঘুম থেকে তোলেন মেয়েকে। সুখের স্বপ্ন-ঘুম ভাঙলেও চোখে তখনও রাজ্যের নিদ্রা জড়িয়ে থাকে মেয়ের। বাকি ঘুমের চোটে চোখ বন্ধ হবার জোগাড়। ঘুম থেকে উঠে চা বসাতেন মা। এক কাপ নিজে খেতেন আর মেয়ে যাতে পুনরায় ঘুমিয়ে না-পড়ে সেজন্য হাত-মুখ-পা ধুইয়ে মেয়েকেও চা খাওয়াতেন। চা-পানের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের পড়া রেডি করার কাজ চলে সমান তালে।
        
পড়তে পড়তে কখন যে ভোর এসে দরজায় কড়া নাড়ে, সে খেয়াল নেই। সকাল সকাল দিনের প্রথম সোনালী আলো নিয়ে হাজির সূয্যিমামা। ঘড়িতে তখন সকাল ৬টা বাজে। মেয়ের স্নানের সময়। স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট। তারপর ঘোড়ার বাসের প্রতীক্ষা। সময় বয়ে চলে নিদ্রাহীন, ক্লান্তিহীন। মা বুঝি সময়কেও হার মানায়! সমান ক্লান্তিহীন। অশেষ প্রাণশক্তির সীমাহীন আধার। সঞ্জীবনী সুধা। (ক্রমশঃ)

তথ্যসূত্র :
●'বারোজন বাঙালি রসায়নবিজ্ঞানী'―ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র
●বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র
●উইকিপিডিয়া, সায়েন্টিফিক ওমেন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments