জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন--১৩/ মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 
মলয় সরকার
পর্ব- ১৩ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এই সেতুর উপর দিয়ে যখন ফিরে ছিলাম, তখন এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম। ব্রীজের উপর থেকে সমুদ্রের জলে ছিপে মাছ ধরা। সেতুর এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ধারের রেলিঙে ভর দিয়ে চোখ নীচের জলের দিকে। আর প্রত্যেকের সামনে একটা নয়, বেশ কয়েকটা করে ছিপ । অনেক নীচে সমুদ্রের অত আলোড়িত জলে মাছ ধরার কায়দাটা কি, তা আর জানা হয় নি। তবে এত লোকের এক জায়গায় মাছ ধরার দৃশ্য আমি আগে কোথাও দেখি নি বলে ব্যাপারটা তুচ্ছ হলেও মাথায় গেঁথে আছে। ব্রীজ পার হয়ে ওপারে গিয়ে দেখলাম, স্থাপত্য বা মানুষের হাবভাবেও যেন কিছুটা তফাত রয়েছে, সেটা যেন মনে হল এশিয়া আর ইউরোপের তফাতের ফল।আবার কিছুটা আমার নিজের মনের ধারণা কি না জানি না, যেমন অনেকেই কন্যাকুমারিকার নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভৌগোলিক সীমারেখার জন্য তিনটে সমুদ্রের তফাত নাকি বুঝতে পারেন।( যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই) 

আমরা পৌঁছালাম একটি জাহাজ ঘাটায়। আসলে জাহাজ নয়, বড় লঞ্চ বা ক্রুজের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমরা ,অনেক যাত্রীর সঙ্গেই অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখানেও বেশ কিছু মানুষ ছিপ ফেলে মাছ ধরছেন, দেখলাম বেশ বড় বড় মাছ উঠছেও।ক্রুজ আসতে দেরী ছিল বলে আমরা পাশেই একটি বড় চা দোকানে কিছু চা আর স্ন্যাকস নিলাম।রোদ ঝকঝক করছে। সামনে নীল জল। মন ভরে যাচ্ছে তার থেকে বড় কথা, আমার বহুদিনের স্বপ্নই বসফরাসের উপর ক্রুজে ঘোরা।ঘুরেছি বহু জায়গায়, আমাদের গঙ্গায় বা প্যারিসে সিন নদীতে কিংবা আমস্টারডামে। কিন্তু এর ব্যাপারটাই আলাদা।স্বপ্ন যে এভাবে সত্যি হবে ভাবি নি।
কিছুক্ষণ বাদে আমাদের গঙ্গার বড় লঞ্চের মত এল দোতলা এক লঞ্চ। বহু মানুষ আগে থেকেই এখানে রয়েছেন।। বুঝলাম, এর কাজই হচ্ছে বিভিন্ন জেটি থেকে পর্যটক জোগাড় করে তাদের এই ক্রুজে ঘোরানো। আর ওদিকে জাহাজের মধ্যে মাইক্রোফোনে এক জন বুঝিয়ে যাচ্ছেন, এই প্রণালীর আশেপাশে সমস্ত দ্রষ্টব্য জায়গা বা প্রাসাদ, কি বিভিন্ন লোকের বাড়ির ইতিহাস। জাহাজ দুলছে প্রচণ্ড, চলছে ধীর গতিতে, জলের ছিটে এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে একেবারে। চারধারে গাঢ় নীল জলের মধ্যে এই ভ্রমণ এক স্বর্গীয় অনুভূতি দিচ্ছিল।জলে প্রচণ্ড আলোড়ন।

বসফরাসের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছি রাজহংসের মত, এর আনন্দই আলাদা। আর ভাবছি, এ পথ যদি না শেষ হয়। আমাদের যাত্রাপথ ‘গোল্ডেন হর্ণ’ পর্যন্ত, সেটা আগেই বলে দেওয়া হল। গোল্ডেন হর্ণ হল, যেখানে এই বসফরাস প্রণালী গিয়ে মিশেছে মারমারা সাগরের সঙ্গে, সেই মোহানা পর্যন্ত। এখানে যে সমস্ত বন্দরগুলো রয়েছে তা হাজার হাজার বছর ধরে গ্রীক, রোমান, বাইজানটাইন ও অটোমান সম্রাটদের বাণিজ্যে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ছিল।

বাঁদিক ঘেসে চলল, আমাদের ক্রুজ। প্রথমেই পড়ল, নীল জলের ধারে শ্বেত পদ্মের মত ডোলমাবেস প্রাসাদ, যেখানে জীবনের শেষ দিকে থাকতেন মোস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, এবং শেষ নিঃশ্বাসও এখানেই ফেলেন। এর কথায় পরে আসছি।দারুণ সুন্দর দেখতে লাগছে। গাইড সব জিনিষেরই অল্প অল্প বর্ণনা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পেরিয়ে এলাম বসফরাসের উপর দ্বিতীয় ব্রীজ। এটিও দেখতে প্রায় আগের মতই, সাসপেনশন ব্রীজ। এর প[শেই পাহাড়ের পাশে রয়েছে একটি দুর্গ, যেটি ব্যবহৃত হত মধ্যযুগে পঞ্চদশ শতকে(১৪৫২ খ্রীঃ) অটোমান সম্রাটদের সময়ে।এর নাম রুমেলী দুর্গ। এটি আপাততঃ একটি মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। 
ইউরোপের দিকটাতে বেশ পাহাড়ী পাহাড়ী ভাব বসফরাসের ধারে অনেক সুদৃশ্য প্রাসাদও যেমন রয়েছে, বেশ উঁচু উঁচু পাহাড়ও অনেক আছে। তবে সেই সমস্ত পাহাড় ফাঁকা নয়, তার উপরে প্রচুর বড় বড় হর্ম্যরাজি রয়েছে।

দূরে দেখা গেল গালাতা টাওয়ার, যা অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ে।এটি নয় তলা এবং এর উপর থেকে সারা ইস্তাম্বুলকে দেখা যায় ৩৬০ ডিগ্রীতে।এটি প্যারিসের আইফেল টাওয়ার বা অন্যান্য শহরের উঁচু টাওয়ার গুলির মত , যেখানে উঠে মানুষ নানা সৌন্দর্য উপভোগ করে। এছাড়া এক এক করে দেখলাম তোপকাপি প্যালেস,সুলেইমানিয়া মসজিদ, আয়া সোফিয়া মসজিদ, মেডেন টাওয়ার নামে এক সুউচ্চ টাওয়ার , তার মাথায় ফ্ল্যাগ পোষ্টে উড়ছে তুরস্কের জাতীয় পতাকা।

গোল্ডেন হর্ণের কাছে গিয়ে দূর থেকে দেখাল, ওই দেখুন সামনে মারমারা সাগর। এখান থেকেই ফিরল আমাদের ক্রুজ। এবার ফিরছে ডান দিক ঘেঁসে, যে দিকটাতে আছে তোপকাপি প্যালেস বা আয়া সোফিয়া। এই তোপকাপি প্যালেস হল ইস্তাম্বুলের বৃহত্তম প্রাসাদ, যেটি ৪০০ বছর ধরে অটোমান সম্রাটরা ভোগ করেছেন।এটিকে ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ , হেরিটেজ প্রাসাদ বলে আখ্যা দিয়েছে।
এছাড়া আরও কত যে প্রাসাদ দেখাল গাইড, সব মনে রাখতেও পারলাম না। তবে মনে গেঁথে রইল তার সৌন্দর্য।

ধীরে ধীরে আমাদের মন খারাপ করে প্রায় শেষ হয়ে এল বসফরাস ভ্রমণ। আমাদের নামিয়ে দিল, যেখান থেকে আমরা উঠেছিলাম সেখানে।তখন সূর্য উঠেছে একটু উঁচুতে। আমাদের গাড়ি এখান থেকে তুলে নিয়ে গেল ইউরোপিয়ান ইস্তাম্বুলের দিকে। রাস্তা এখানে বেশ উঁচুনীচু। একটা উঁচু পাহাড়ের উপরে একটা হোটেলে খাওয়াদাওয়া হল।এখানকার বাড়িঘরগুলোও একটু অন্য রকম ও গাছ ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো লাগছিল।
খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের ছেড়ে দিল ডোলমাবেস প্রসাদের সামনে। সঙ্গে নামল একজন গাইড।

ডোলমাবেস প্রাসাদ পর্ব

ঢোকার আগেই দেখি একটি বেশ উঁচু চারতলা সাদা ধবধবে ঘড়িঘর। মাথায় রয়েছে, সেই পুরানো দিনের একটি বিশাল ঘড়ি , তবে সঠিক সময় দিচ্ছে। এই ঘড়ি মিনারটিও বেশ কারুকার্য করাএটি ১৮ ৯০ থেকে ১৮৯৫সালের মধ্যে তৈরী হয়।এটির সামনেই হচ্ছে রাজকীয় বা প্রধান দরজা।

এখান থেকে দরজা দিয়ে ঢুকে বিশাল আয়তনের ও  সুন্দর বাগান। মধ্যে দিয়ে সুন্দর পথ।বেশ কিছুটা এগিয়ে তবে প্রাসাদে ওঠার সিঁড়ি। এর পর আর আমাদের গাইড যাবে না । এখান থেকে প্রাসাদের অন্য গাইড দেখাবে।

তবে ঢোকার মুখ থেকেই সামনে প্রাসাদ দেখা যাচ্ছিল দাঁড়িয়ে আছে একেবারে শ্বেত পরীর মত। পাথর গুলো ঠিক সাদা নয়, হাল্কা হলুদের আভা।সিঁড়ির দুপাশ দিয়ে দড়ি বেঁধে দুটি লাইন করে ঢোকানো হচ্ছিল।প্রাসাদের চারপাশ ঘিরে আছে পরিষ্কার রাস্তা।সামনে একটো গোলাকার ছোট জলাশয়ের মধ্যে একটি সুন্দর পাথরের  কারুকার্য করা ফোয়ারা। তার পাশে মখমল সবুজের ঘাসের চাদর, সঙ্গে নানা রঙের বাহারী ফুলের সমাবেশ। চারদিকে বেশ কয়েকটি দরজা আছে তবে আমরা যেটি দিয়ে ঢুকলাম, সেটি ছাড়া সব বন্ধ দেখলাম।এটি ইস্তাম্বুলের ইউরোপিয়ান দিকটাতে পড়ছে। স্থাপত্যেও ইউরোপীয়ান ছাপ। অবশ্য আমার মনে হল, কিছু মিশ্র ছাপ, যদিও আমি এসব ব্যাপারে খুব বিশেষজ্ঞ নই।এর একটা দিক সম্পূর্ণ বসফরাসের পাশে-অর্থাৎ পিছন দিকে বাগানের ধারে একটি দরজাও আছে বসফরাসের পারে। রাজা বা রাজপরিবা্রের মানুষেরা নৌভ্রমণে যাওয়ার জন্য এই দরজাটি ব্যবহার করতেন।

এবারে আসি এর সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য তথ্যে, যা,  কিছু পড়াশোনা আর কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ।

এটি ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে তৈরী হয়। এর আগে সম্রাটরা বসফরাসের অপর দিকে তোপকাপি প্রাসাদে থাকতেন।কিন্তু সেটি একটু পুরানো ধরণের হওয়ায় এবং সেখানে নতুন যুগের নানা সুযোগ সুবিধা না থাকায়, তাছাড়া ইউরোপীয়ান রাজাদের প্রাসাদের তুলনায় সেটি খাটো মনে হওয়ায় সম্রাটের সেখানে থাকা মনঃপূত হয় নি। তাই এখানে সরে আসার সিদ্ধান্ত অটোমান সাম্রাজ্যের ৩১ তম সুলতানের।এটি নির্মাণে যে কি পরিমাণ অর্থ ও সোনা লেগেছিল, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়।এটি প্রায় ৩৫ টন সোনার দামে(১.৯ বিলিয়ন ডলারে) তৈরী হয়। শুধু এতে নানা কারুকার্য করার জন্য ১৪ টন সোনা ব্যবহার হয়েছে নানা ফুল পাতা নক্সায়।এটি তৈরী করতে দেশ একেবারে দেনায় ডুবে গিয়েছিল, যার ফলে আর্থিক মন্দা দেখা দেয় ।১৮৫৬ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত এখানে ৬ জন সম্রাট বাস করেছেন।তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট , মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক তাঁদের হাত থেকে তুরস্কের দখল নিয়ে, তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁরা এর উপর প্রভুত্ব করে গেছেন। জীবনের শেষের দিকে আতাতুর্ক এর একটি কক্ষে বাস করতেন। ১৯৩৮ সালের ১০ই নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস উনি এখানেই ত্যাগ করেন। উনি যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে উনি যেমন করে রেখেছিলেন, সেই ভাবেই তা রাখা রয়েছে, এমন কি ঘড়িটা যে সময় দিচ্ছিল, তাকে সেই সময়েই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে শেষ নিঃশ্বাসের সময় সকাল ৯.০৫ এ। আগে সব ঘড়িগুলোই তাই ছিল। পরবর্তী সময়ে কেবলমাত্র ঐ ঘরের ঘড়িটি বাদে অন্য ঘড়িগুলোর ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিল করে স্থানীয় সময় করে দেওয়া হয়েছে। এমনটাই দেখেছিলাম মেক্সিকোয় রাশিয়ান নেতা ট্রটস্কীর বাড়িতে, যেখানে যা ছিল, এমন কি বাথরুমের মধ্যেও, সব তেমনই আছে।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, এখানে সারা ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্ককে ওরা দেবতার মত মান্য করে আজও। ওনার নাম করলে ওখানকার মানুষের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। বুঝেছিলাম, ওখানে তিনি কি শ্রদ্ধার জায়গায় অধিষ্ঠিত আজও। সেটা থেকেই ওনার গুরুত্ব ও মহানুভবতা, কার্যপদ্ধতির কিছুটা আঁচ করা যায়।

প্রায় ১১০০০০ (একলক্ষ দশ হাজার ) বর্গমিটার জায়গার উপরে এই বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ‘ডোলমাবেস’ কথাটির অর্থ সুন্দর বাগান ঘেরা । এটি নাকি আগে  অটোমান সুলতানদের রাজকীয় বাগান ছিল।এই প্রাসাদটি সারা তুরস্কের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাসাদ । এর শুধু প্রাসাদটি ৪৫০০০ বর্গমিটার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।এর ভিতরে আছে ২৮৫ টি সুসজ্জিত  ঘর ৪৬ টি হলঘর, ৬ টি স্নানাগার ও ৬৮টি শৌচাগার।এখানে একটি ঝাড়বাতি আছে , কেউ কেউ বলে , এটি নাকি ব্রিটেনের রাণী উপহার দিয়েছিলেন,। এর মধ্যে বাতি আছে ৭৫০টি এবং এর ওজন ৪.৫ টন। এখানে গোটা মেঝে এবং সিঁড়ি কার্পেটে মোড়া। এখানকার কার্পেটগুলোও নানা দেশ থেকে আনা এবং খুব দামী।এটি যে পাথর গুলো দিয়ে তৈরী, সেগুলি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করা। সারা প্রাসাদ গ্যাসে আলোকিত হত সেই সময়।
আর একটি মজার কথা শোনালো গাইড।

থাক, সেটি শোনাবো পরের পর্বে। সামনের সপ্তাহের জন্য একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করতে হবে—

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments