জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-(৪৬)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-(৪৬)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


আকবরই প্রথম সম্রাট, যিনি ভয়ঙ্কর যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এই কুপ্রথার কারণে কত সংসারের কত গরিব মা-বাবা নিঃস্ব হয়ে গেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেও মেয়ের বিয়ের যৌতুকের ব্যবস্থা করেছেন। দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই কুপ্রথার প্রচলন ছিল, যা আজও বর্তমান রয়েছে। যদিও এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে আইনগত বিধি-নিষেধ বর্তমান। নিচু জাতিদের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন থাকলেও উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে তার বিলোপ ঘটে। আকবর, যৌনজীবনে স্বামী সান্নিধ্যে শারীরিক তৃপ্তি না ঘটলে সেই নারীকে নির্যাতন না করে বিপত্নীক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া উচিত- এই সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী ছিলেন। 

হিন্দু ও মুসলমান- উভয় শ্রেণীর উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মধ্যে পর্দা প্রথা প্রচলন মধ্যযুগে বর্তমান ছিল। হিন্দুদের ভক্তি আন্দোলন ও ধর্মগুরুগণ এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে সতীদাহ প্রথার মত বহুল প্রচলিত কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন মহম্মদ বিন তুঘলক। আকবর সর্বতোভাবে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন না, কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন নারীর সতী হওয়ার ঘটনায় কোনো প্রকার অনুমোদন ছিল না এবং তিনি এই বিষয়ে ফরমান জারি করেছিলেন। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়টি তদারকি করতেন। এমনকি যদি কোন মহিলা স্ব-ইচ্ছায় সতী হওয়ার সংকল্প গ্রহণ করতেন, অথচ তার একাধিক সন্তান বর্তমান থাকতো, তার পক্ষে সতী হওয়ার উপায় ছিল না। সম্রাট শাহজাহানও এই আইনের ধারা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। ১৬৬৪ খ্রিঃ সম্রাট ঔরঙ্গজেব তার শাসনকালে সতীদাহ প্রথা বিলোপ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালে বজায় থাকেনি। 

মদ-গাঁজা প্রভৃতি মাদকদ্রব্য কোরান মতে বর্জনীয় হলেও মুসলমানদের মধ্যে এই সব মাদকদ্রব্য গ্রহণের খুবই প্রচলন ছিল; এমনকি মহিলাদের মধ্যেও এই মাদকদ্রব্যের ব্যবহার গোপনে চলত। আলাউদ্দিন খিলজী ফরমান জারি করে এই সব কুঅভ্যাস থেকে নর-নারীদের মুক্ত করেন ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দানের ব্যবস্থা করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর সামান্য পরিমাণ মদ্যপানকে আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মান্যতা দিয়েছিলেন। যদিও প্রজাদের মধ্যে এই মাদক গ্রহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল। 

১৬০৫ খ্রিঃ পর্তুগীজদের মাধ্যমে আসা তামাক সেবনের ব্যাপক বিস্তার, সম্রাট জাহাঙ্গীরকে তামাক বর্জনের জন্যে আইন প্রয়োগে বাধ্য করেছিল। জুয়াখেলার বিরুদ্ধেও আলাউদ্দিন  আকবর আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধেও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছিলেন এবং অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তিদান করা হতো। সম্রাট জাহাঙ্গীর হিজড়াদের বিক্রি করার যে প্রথা বর্তমান ছিল ও হিজড়া করণের যে কু-প্রথা প্রচলিত ছিল তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। বাংলার সিলেট অঞ্চলে এই কূ-প্রথা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যেত। যারা এই কাজে লিপ্ত ছিলেন, সম্রাট জাহাঙ্গীর তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। 
সতীদাহ জাতিভেদসহ কুসংস্কার ও কু-প্রথা, যা তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র রাজারাই রুখে দাঁড়াননি, সাধুসন্তগণও তাদের প্রভাব খাটিয়ে এই সমস্ত কুসংস্কার কুপ্রথার বিনাশ ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই সাধুসন্তদের মধ্যে স্মরণযোগ্য হলেন- মাধব, রামানন্দ, কবীর, বীরভান, রবিদাস, নানক, তুকারাম, পুরন্দর দাস, শ্রীচৈতন্য, বল্লব, গোবিন্দ সিং, শংকরদেব ও দাদু। এই মহান্তজনদের লোকশিক্ষা দুর্বল চিত্ত মানুষদের জীবনচর্চার ক্ষেত্রগুলিতে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল- এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। তবু এই একবিংশ শতাব্দীতেও ওই কুসংস্কারগুলির নিরসন যে ঘটেনি- একথা বলা বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ যে মহামানবের আহ্বান জানালেন; শ্রী অরবিন্দ যে মহাশক্তিশালী মানব জাতি মহাবিশ্বজীবনের অনন্য অধিকারী হবে বলে ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করলেন; বিবেকানন্দ বিশ্বজীবনের আনন্দযজ্ঞে মানুষেরই মহাজাগৃতি চেয়ে মানুষের মধ্যেই যে পূর্ণের নিত্যস্থিতি, তার প্রস্ফুটনের জন্য সদাসর্বদা মানুষকে ঈশ্বরমুখী হয়ে সেবাধর্মের মধ্যে দিয়ে আত্মমুক্তির পথ প্রশস্ত করতে বললেন, তার একটি উপকরণকেই সকল দেশের সকল মনীষী অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছিলেন- তা হল, শিক্ষা। মানব সভ্যতার বিকাশে এখনো পর্যন্ত যতগুলি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সারা পৃথিবীতে তার পর্যালোচনা করে দেখলে এই প্রত্যয়ে আসা যায় যে, পৃথিবীতে বস্তুসম্পদের ব্যবহার থেকে মানুষ প্রভূত ফল লাভ করেছে; নৈতিক ও বৌদ্ধিক স্তরে মানুষ তার জীবনকে যে ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে পারে, তারও ব্যাপক অনুশীলন করেছে; কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যে আধ্যাত্মিক জীবন তাকে সব দিক দিয়ে সুখী ও আনন্দময় জীবনের অধিকারী করে তুলতে পারে, তার চর্চার ক্ষেত্রটিকে সে সেইভাবে আয়ত্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়নি। এ ব্যাপারে গৃহী, সন্ন্যাসী ও বিজ্ঞানী নিজ নিজ সাধনার ক্ষেত্রে যে যেমনভাবে অবস্থান করছেন, সেখানে কোনভাবেই সমন্বয় ঘটেনি, ঘটছে না এবং ভবিষ্যতে ঘটবে এমনও আশা করা যাচ্ছে না। 

প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে মানুষের চৈতন্যশক্তির প্রকাশ বিশ্বসংসারে তার ক্ষণস্থায়ী বা নশ্বর জীবনের ভূমিকাটি কিভাবে সূচিত হবে বা হওয়া উচিত, এ বিষয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জগতের মানুষদের মধ্যে বাহ্যিক দ্বন্দ্ব বর্তমান এবং এই দ্বন্দ্বের কারণ, সাধনা বা জীবনচর্চার দিক দিয়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ স্ব স্ব ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কারণেই পৃথক থাকতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই বৈষম্য ও দ্বন্দ্বকে স্বীকার করেও মানবিক ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন যে বাস্তবিক ভাবে সম্ভব, তার সর্বজনগ্রাহ্য বা স্বীকৃত উপাদানগুলির নিরিখে মানুষ সেইভাবে ক্রিয়াশীল হয়নি, যাতে সকল দেশের মানবজীবন এবং জাগতিক প্রাণী জীবনে বস্তু জীবনে আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ প্রকাশের দ্বারা নিত্য স্নাত হয়। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments