জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-৪৭/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(৪৭)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম

শ্রী অরবিন্দ মানবজীবনকে যে ভাবে দেখেছেন তার নির্যাস হল: It is a spiritual essential change of consciousness, not the surface manipulation which is the method of mind and reason, that can alone make life other than it now is and rescue it out if it's present distress and ambiguous figure." এই চৈতন্যময় স্তরে উন্নয়ন না ঘটলে তার হাজার চেষ্টা জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্যে অব্যাহত থাকলেও তা অবাস্তব উদ্ভট কাল্পনিক জীবনের স্তরেই থেকে যাবে; বাহ্যিক সম্পদের প্রয়োজন ও ব্যবহার বিষয়ে স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার জীবন এরকমভাবে অতিবাহিত হবে, যা অর্থহীন ও পরিশেষে তা নৈরাশ্যময় বলেই মনে হবে। আধ্যাত্মিক উন্নতি না ঘটলে, মানুষের জীবনে কোনো স্থায়ী উন্নতি ঘটবে না। 
"ভারতীয় মানুষ" বা "মহামানব"- এর আবির্ভাব ঘটার জন্য, যে নূতন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রী অরবিন্দ, তাঁর সাধনপথের অন্যতম অনুসঙ্গিনী মিরা আলফাসা (Mira Alfasa), যিনি 'দ্য মাদার' বলে সুপরিচিত। তিনি  বললেন- "The condition under which man live upon earth are the result of their state of consciousness;to seek to change the conditions without changing the consciousness is a vain chimera"। 

এর জন্যে চাই উপযুক্ত এবং যথার্থ শিক্ষা। এই শিক্ষা বিশ্বজীবনের ঐকতান রচনায় সমগ্র মানবজীবনকে নিরন্তর উদ্ধোধিত করবে এবং মানুষের মনের ঐশ্বর্যকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাড়িয়েই যাবে। এই 'Supermind' বা মহামন থেকেই উদ্ভূত হবে মহাজীবন। শিক্ষার ভিতর দিয়েই এই মহামন বা মহাজীবনের উজ্জীবন ঘটবে। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিরন্তর সম্পর্ক স্থাপনের ভেতর দিয়েই মানুষের মনের শিক্ষা পূর্ণতা পাবে। 

একদিন তপোবনের শিক্ষা এই মনের শিক্ষাকে অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছিল। ভারতবর্ষের এই শিক্ষায় ব্রহ্মচর্য ব্রম্ভজ্ঞান সর্বজীবে দয়া, সর্বভূতে আত্মোপলব্ধির উপকরণগুলি মানুষকে মহাজীবনের সন্ধান দিয়েছিল এবং বিজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের অবদান রেখেছিল। বৈজ্ঞানিক শক্তি মানুষকে বিশ্বায়নের পথ দেখিয়ে এক জায়গায় এনেছে, কিন্তু একত্রিত করতে পেরেছে কি? একত্রিত হবার পর যে মিলন বা সংযোগ দরকার তার জন্যেই শিক্ষাকে বিজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানের সংযোগের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করতে হবে ও মানুষের বাহ্যিক ধন সম্পদের যোগানের সঙ্গে মনন সম্পদ যোগানের দিকটিকেও দেখতে হবে। আত্মমুক্তির সোপান ধরে সাধনার পথ দিয়েই শিক্ষা অর্জন করতে হবে এবং আত্মোন্নয়ন ঘটাতে নিয়মিতভাবে যে প্রার্থনা প্রবল হওয়া চাই তা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়: 

হে বিধাতা 
দাও দাও মোদের গৌরব দাও 
দুঃসাধ্যের নিয়ন্ত্রণে 
দুঃসহ দুঃখের গর্বে। 
টেনে তোলো রসাক্ত ভাবের মোহ হতে। 
সবলে ধিককৃত করো দীনতার ধুলায় লুণ্ঠন। 
দূর করো চিত্তের দাসত্ববন্ধ, 
ভাগ্যের নিয়ত অক্ষমতা, 
দূর করো মূঢ়তায় অযোগ্যের পদে 
মানবমর্যাদাবিসর্জন 
চূর্ণ করো যুগে যুগে স্তূপীকৃত লজ্জারাশি 
নিষ্ঠুর আঘাতে। 
নিঃসংকোচে 
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে, 
উদাত্ত আলোকে, 
মুক্তির বাতাসে। 

ভারতের প্রাচীনতম জীবনের সন্ধান দিয়েছে বেদ-উপনিষদ-শ্রুতি-স্মৃতি শাস্ত্রগুলি। সে যুগের শিক্ষায় মনের প্রশিক্ষণই প্রাধান্য পেয়েছিল। তার দ্বারাই যথার্থ জ্ঞানলাভ সম্ভব- এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল। মহাজাগতিক বিস্ময় যে শক্তিকে ভর করে রয়েছে তা মানুষকে মননের দিকে অভিনিবেশ করার টান সৃষ্টি করে। চিত্তবৃত্তি নিরোধের ভিতর দিয়ে পূর্বের উপলব্ধিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এবং আচার্য ও গুরুই সেই শিক্ষার সঞ্চালক ও প্রবাহশক্তি। প্রাচীন ভারতবর্ষে যে নির্দিষ্ট শিক্ষা বিধি প্রণয়ন করা হয়েছিল, আচার্য ও গুরুজন সেগুলির সম্প্রসারণ দ্বারা পূর্ণ ও পরমসত্তাকে লাভ করবার জন্য নিজেরা সচেষ্ট থাকবেন এবং শিষ্যগণকেও সচেষ্ট রাখতেন। বৌদ্ধযুগেও এই শিক্ষা প্রণালী অব্যাহত ছিল। জাতক কাহিনীগুলি তার প্রমাণ। কলা, সঙ্গীত শিল্প সাহিত্য অর্থ চিকিৎসা- সব বিদ্যারই ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। বৃত্তিশিক্ষা ও যন্ত্রশিক্ষার ক্ষেত্রেও এই গুরুত্ব ছিল। অর্জিত জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ ও অনুশীলন ছাড়া কোনো শিক্ষাই সম্পূর্ণ হত না। গুপ্তযুগ ও পরবর্তীযুগেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। 

সে যুগের ভারতীয় শিক্ষার অনন্য উৎকর্ষের বিবরণ হিউয়েন সাঙ (সপ্তম খ্রিঃ) প্রমূখ পর্যটকগণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন এবং মগধ ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের  বৌদ্ধিক ও নৈতিক শিক্ষার উৎকর্ষ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখ করেছেন। একাদশ শতাব্দে শিক্ষাক্ষেত্রে কাশ্মীরের প্রসিদ্ধি উল্লেখযোগ্য। বাংলার গৌড় থেকে শিক্ষা লাভের জন্য এখানে ছাত্রগণ আসতেন। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে নারীরাও শিক্ষা গ্রহণ করতেন শুধু নয়, কবিতা শিল্পকলা সঙ্গীত- সকল বিষয়েই তাঁরা আত্মবিকাশের সুযোগ পেতেন। শিক্ষা দর্শন ধর্ম- সব বিষয়ের সঙ্গে ভারতীয় জীবনে নৈতিকতা অন্তর্লীন হয়ে আছে এবং লিপ্ত হয়ে আছে অদ্বৈতবাদের মানবসম্পদ ও মানুষের স্বাধীনতাবোধ। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments