জ্বলদর্চি

ছুটনি মাহাতো: এ কালের বীরাঙ্গনা/ সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ১৫
সূর্যকান্ত মাহাতো

ছুটনি মাহাতো: এ কালের বীরাঙ্গনা

সরু একটি নালা। মহিলার শ্বশুরবাড়ি থেকে অনতিদূরেই ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে। মহিলাটি নিত্য দিনের মতোই সেখানে স্নান করছিলেন। ওদিকে ঝোপের আড়ালে বসে আছে কিছু কামার্ত পুরুষ। তাদের কামনা ভরা শিকারি চোখগুলো স্থির হয়ে আছে স্নানরতা মহিলার উপর। উদ্দেশ্য মহিলার নারী শরীরকে ভোগ করা। কেন জানি না, সেদিন মহিলাটির কেবলই মনে হচ্ছিল, অন্য কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তাই ভালো করে এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল নারী লোলুপ দৃষ্টি গুলোর উপর। কোনও রকমে শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন।

না। অপরাধীরা সেদিন কিছু করার দুঃসাহস পায়নি। সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে গেছিল। তবে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল একটা প্রতিশোধ স্পৃহা। ওরা ছিল মহিলাটির জ্ঞাতি ও প্রতিবেশী। মহিলার শারীরিক সৌন্দর্য ও তাদের স্বচ্ছল জীবন যাপনে ওরা ছিল প্রবল ভাবে ঈর্ষান্বিত। কামতাড়িত। মহিলাটি তার সন্তানদের শিক্ষা দিতে স্কুলমুখী করে গড়ে তুলছিলেন। ওরা সেটা মেনে নিতে পারেনি। এটাও ছিল অন্যতম একটা কারণ। সর্বোপরি মহিলাটির জমি জায়গা আত্মসাৎ করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।


 একদিন এক প্রতিবেশী অনূঢ়া কন্যা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। বারবার সে বমি করছিল। মহিলাটি ছিলেন স্পষ্টবাদী। তিনি বলেছিলেন, "মেয়েটি গর্ভবতীও হয়ে থাকতে পারে।" তার এমন অলুক্ষণে কথাটা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল।

জীবনযাত্রায় অসচ্ছল প্রতিবেশীদের থেকে মহিলাটি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিলেন বলে প্রতিবেশীরা ঈর্ষান্বিত তো ছিলই। তার ওপর সেদিনের নালার ঘটনাটাই আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। পরে এধরনের কথা শুনে তো তারা একরকম আটঘাট বেঁধেই নেমে পড়ল। মহিলাকে হেনস্থা করার চক্রান্তে সকলেই শামিল হল। অসুস্থ মেয়েটির চিকিৎসায় ডাক্তার ডাকা হল না। ডাকা হল, ওঝা বা গুনীন। ওই ওঝাই নিদান দিলেন অসুস্থ কন্যাটির উপর 'ডাইনি'-র কুদৃষ্টি পড়েছে। তাই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমনকি ডাইনি হিসেবে ওই মহিলাকেই ইঙ্গিত করছেন।

প্রতিবেশী মেয়েরাও চক্রান্তে শামিল হয়ে উঠেছিল। ওঝার কথা শোনানোর জন্য মেয়েটিকে তারা ডাকতে লাগল, "আই লো, আই! কি বলছে শুনে যা!" 


অবশেষে মহিলাটিকে 'ডাইনি' বলে দেগে দেওয়া হল। তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। চলল মারধর, লাথি। বসল সালিশি সভা। জারি হল জরিমানা। তাতেও রোষ মিটল না। অর্ধ উলঙ্গ করা হল। প্রস্রাব খাওয়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হল। অবশেষে হত্যা করার উদ্দেশ্যে কুড়ুল দিয়ে আঘাত করা হল। মারা গেল না। তবে কপালের বাম পাশের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির ক্ষত চিহ্ন আজও বহন করে চলেছে।
এমন নিষ্ঠুর অপবাদে, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় মহিলাটির শরীর ও মন চুর চুর করে ভেঙ্গে পড়েছিল। একটা মানসিক কষ্ট যেন বুক ও গলার ভিতর দলা পাকিয়ে বসে আছে। এক সময় গ্রামের এক শুভাকাঙ্ক্ষী ভগান মাঝি তার সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। সেই মুহূর্তে তাকে পালিয়ে যেতে বলেন। না হলে তাকে যে হত্যা করা হবে সে কথাও জানালেন।

 মহিলা ভাবলেন তাকে পালাতেই হবে। না হলে এরা মেরে ফেলবে। কিন্তু কীভাবে? রাত্রির অপেক্ষা করতে লাগলেন। তখন মধ্যরাত্রি। ঘড়ির কাঁটা রাত্রি ১২টা ছুঁয়েছে। ঘুমন্ত চোখের ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়েই সোজা বেরিয়ে পড়েছিলেন। কালো মেঘে ঢেকে ফেলেছে আকাশ। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি মাথায় করে কয়েকটা কাপড় আর সন্তানদের আঁকড়ে দ্রুত পা ফেলে চলেছে। ছোট ছেলেটির বয়স তখন ২ বছর। সারা রাত্রি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মাঠের মধ্য দিয়ে একরকম দৌড়তে দৌড়তে হাঁটছিলেন। সকাল সকাল পৌঁছে গেলেন তার ভাই সুনীল মাহাতোর বাড়িতে। ভাই তো  সব শুনে প্রচন্ড রেগে গেলেন। প্রতিকারের আশায় বোনকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন থানায়। কিন্তু সামান্য আশ্বাসটুকু ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।

প্রতিজ্ঞা করলেন কখনও হার মানবেন না। প্রয়োজনে গাছের তলায় বাস করবেন। তবুও এই অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখবেন। ভাইয়ের বাড়িতে নয়। আশ্রয় নিলেন গাছের তলায়। ফলমূল আর অন্যের সহযোগিতায় চলল  বেঁচে থাকার লড়াই। অন্যের দয়ায় ছিন্ন কাপড়ে লজ্জা নিবারণ করতে হত। গাছের নিচেই কোনও রকমে রান্না, খাওয়া আর শোওয়া। এভাবেই দীর্ঘ ৮ মাস গাছের নিচে ছিলেন। তারপর ভাইয়ের দান করা জায়গায় কোনও মতে একটি চার দেওয়ালের বাড়ি বানায়।

স্বামী প্রথম প্রথম কিছুদিন সাথ দিয়েছিলেন। দু'বছর পর পরিবারের কথা শুনে তিনিও তাকে ছেড়ে চলে যান।

মহিলাটির নতুন করে হারানোর কিছু  ছিল না। তাই এখান থেকেই তার ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। নিরক্ষর এক মহিলা। জীবন থেকে উপলব্ধি করলেন ডাইনি বলে কোনও কিছু নেই। সবটাই এক এক রকমের চক্রান্ত।

ডাইনি। ভয়ানক এই শব্দটার মানে আজ তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। এটা কোন অলৌকিক শক্তি নয়। কোন কালা জাদু নয়। নয় কোনো তুকতাক। নজর দোষ। বরং অনেক বেশি করে কিছু দুষ্ট মানুষের চক্রান্ত। অভিসন্ধি। পরশ্রীকাতরতা। ব্যক্তিগত আক্রোশ। এবং ঈর্ষান্বিত মনোভাব থেকেই এর জন্ম।

এমন নিষ্ঠুর অপবাদ একজন মহিলার কাছে কী পরিমাণ অভিশাপ হয়ে ওঠে, সেটা তিনি দারুণভাবে উপলব্ধি করেছেন। তাই অন্য কারও জীবনে এমন ঘটনা যেন কখনও না ঘটে তার জন্য লড়াই শুরু করলেন। শুরু হল এই কু- প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর জীবনপণ লড়াই। তার একাকী সেই লড়াইয়ে একটু একটু করে দু-একজনকে পাশে পেতে লাগলেন। লড়াই আরও শক্ত হল। এভাবেই গড়ে তুললেন "আশা" বলে এক সংস্থা। যার মূল কাজই হল, ডাইনি অপবাদে হেনস্থা ও ঘরছাড়া মহিলাদের থাকা ও খাওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা করা। ২০০০- ২০২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে এই লড়াইয়ে প্রায় ১২৫ জন মহিলাকে এই কুপ্রথার শিকার থেকে মুক্ত করেছেন। এমন মানবতাবাদী লড়াই প্রচারের আলোয় আসতে ১৫ বছর লেগেছিল। 

অবশেষে মিলল কুড়ি বছরের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল। ভারত সরকারের কাছ থেকে পেলেন পদ্মশ্রী খেতাব।  সমাজের এই অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই প্রথম পদ্মশ্রী খেতাব জয় করলেন কোনও এক মহিলা। যিনি আবার খোদ ওই অন্ধ বিশ্বাসেরই শিকার।

ঠিক ধরেছেন মহিলার নাম ছুটনি মাহাতো। জন্ম - ১৯৫৯ সালে। গ্রাম- ভোলাডি। জেলা- সরাইকেলা খরসওয়ান। রাজ্য- ঝাড়খন্ড ।  আগে বিজ্ঞানবাদী সংগঠনগুলো এই অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কেবল লেখালেখি আর সচেতনতার বার্তাই দিয়েছে। কিছু কিছু সচেতনমূলক অনুষ্ঠান করেছে কেবল। প্রশাসনও এ ব্যাপারে খুব বেশি সরব নন। সেখানে একটি মেয়ে হয়ে ছুটনি দেবী দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে টানা লড়াই করে চলেছেন এই অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। তিনি একাই যেন একটি প্রতিষ্ঠান। তার নেই কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা। বিজ্ঞান সম্পর্কে নেই কোনও ধারণা। আছে কেবল যুক্তি, বুদ্ধি, অদম্য জেদ আর অসীম সাহস। এর জোরেই প্রশাসন ও সংগঠনগুলো যতটা না কাজ করছে, তার থেকে বেশি কিছু উনি করে চলেছেন।

'ডাইনি' বলে কি আদৌ কোনও কিছু আছে? এক সাক্ষাৎকারে ছুটনি দেবী প্রশ্নটা শুনেই হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, "না। ডাইনি বলে কোনও কিছু নেই। এটা অন্যকে হেনস্থা করার চক্রান্ত কিংবা ব্যক্তি আক্রমন ছাড়া আর কোন কিছুই নয়। এর পিছনে এক বা একাধিক জনের যোগসাজশ থাকে। তাদের একটা মোটিভ থাকে। এর বেশি কিছু নয়।"

ডাইনি নিয়ে অনেক বড় বড় তাত্ত্বিক মত উঠে এসেছে। অনেক যুক্তি, অনেক বিশ্লেষণ, অনেক গবেষণা উঠে এসেছে। সকলেই একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। কোনও অলৌকিক শক্তি নয়। এর পিছনে থাকে ওঝা বা জানগুরু সহ প্রতিবেশীদের একটা ষড়যন্ত্র। ছুটনি দেবীর জীবন অভিজ্ঞতা সেটাই প্রমান করে। যাদেরকে ডাইনি সাব্যস্ত করা হয় তারা নিজেরাও জানে না তারা কেন ডাইনি। কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের ডাইনি বলা হয়। উত্তর তো একটাই, ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতা।


বাচ্চাগুলো হঠাৎ করেই কেঁদে ওঠে। হঠাৎ করে কোনও মহিলা বা পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন গ্রামের কেউ  কোনও রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে পারছেন না। গাভীর দুধ হঠাৎ শুকিয়ে গেলে কিংবা ফসল নষ্ট হলেও ডাইনির কুনজর পড়েছে বলে মনে করা হয়। এরকম একাধিক নজর দোষ বা ডাইনিদের কুদৃষ্টির মতো অলীক বিশ্বাস জঙ্গলমহলে আজও সমানে প্রচলিত রয়েছে।

জঙ্গলমহলের মাহাতো, আদিবাসী সহ নিচু জাতের গ্রামগুলোতে আজও 'ডাইনি', 'ডান' বা 'ডাইন' অপবাদ নিয়ে অনেকেই জীবন কাটাচ্ছেন। হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। একঘরে হয়ে আছেন।সমাজ ও আত্মীয় স্বজনের থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন। নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছেন। ভাবা যায়! এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও এমনটা ঘটছে।

গ্রামের এক বয়স্ক মহিলা। সকলেই ওকে 'ডাইন' বলে জানে। সে কথা উনি নিজেও জানেন। আমাকে খুব স্নেহ করেন। সেদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, "তুমি কোনও বাচ্চার দিকে তাকালে বাচ্চাটি নাকি কেঁদে ওঠে?"

বয়স্ক মহিলা জোর গলায় বললেন, "কে বলেছে? রাস্তায় তো দু - দশটা বাচ্চা রোজ দেখি। কই তারা তো কাঁদে না?" তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এমন অপবাদে তার যে কি পরিমান কষ্ট হয় তা অন্য কেউ বুঝবে না। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সকলেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। দৌড়ে বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। অথচ তারও দুটো কথা বলতে ইচ্ছে করে। সকলের সঙ্গে হাসিখুশি ঠাট্টায় সময় কাটাতে ইচ্ছা করে। শিশুদের ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।

আমি সান্ত্বনা দিলাম। ভালোভাবে বুঝিয়ে বললাম ছুটনি মাহাতোর লড়াইয়ের কথা। ছুটনি মাহাতোর কথা শুনে যেন বুকে একটু বল পেলেন। তবে বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। তাই মোবাইলটা বের করে ছুটনি মাহাতোর ছবি দেখালাম। শেষে বললেন, "আসলে কি জানো, কোনও বাচ্চা কী কারণে কাঁদে বা কোন মানুষ কেন অসুস্থ হয় সেটা আমি নিজেই জানিনা। আমি কখনও চাইনি আমার কারনে কারও কিছু ক্ষতি হোক। তাছাড়া আমার ছোট্ট নাতিও তো মাঝে মাঝেই কেঁদে ওঠেন। তার মানে কি, আমি আমার ছোট্ট নাতিটার ক্ষতি করছি? না, ক্ষতি করতে চাই? আমি তো তার সর্বক্ষণ ভালোটাই চাই। তারপরেও কাঁদে কেন? কারণ বাচ্চারা নানা কারণেই কেঁদে উঠতে পারে। অকারণে হাসি-কান্না তাদের স্বভাব।

"লোকের মুখে একটা মিথ্যা কথা শুনতে শুনতে একবার নিজের মধ্যেই বিশ্বাস জন্মেছিল, হয় তো বা আমার নজরটাই খারাপ। এক বাচ্চার উপর আমি সেই কুনজরের পরীক্ষা করলাম। কিন্তু না, কোন কিছুই ঘটেনি। সেদিনই বুঝে গেলাম কুনজর বা কুদৃষ্টি ফালতু কথা। আর বিশ্বাস করি না ওসবে। এর থেকেই তো প্রমাণিত হয় ডাইনি হল সব থেকে বড় মিথ্যা।। তবে এটা জানি আমার প্রতিবেশী শত্রুরাই যে আমাকে হেনস্থা ও ছোট করতে এমন অপবাদ  দিয়েছেন, সেটা সত্যি।

"লোকে বলে আমি নাকি অপদেবতার পূজা করি। কারা এই অপদেবতা আজও সেটাই জানলাম না।" একটানা কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমিও তার এমন যুক্তিতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে ভাবলাম প্রতি গ্রামেই একটা করে ছুটনি মাহাতোর জন্ম হোক। তবেই মিলবে মুক্তি।

ডাইনি কী? কী তার স্বরূপ? কীভাবে তার উৎস? ছুটনি মাহাতোই তার উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। খোদ ডাইনি অপবাদের শিকার হয়ে তার যন্ত্রণার কথা যেভাবে ব্যক্ত করেছেন, এর থেকে বড় ব্যাখ্যা আর কেউ দিতে পারবে না। সে যত বড়ই গবেষক হোন।

সুস্থ মাথায় কতকগুলো প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন---

১) ডাইনিদের কুদৃষ্টি বা কু- নজরে আমরা অসুস্থ হয়। কিন্তু সুস্থ মাথায় একবার ভেবে দেখুন তো কেবলমাত্র কু- দৃষ্টিতে কি কখনও শরীর অসুস্থ হওয়া সম্ভব? চিকিৎসা বিজ্ঞান কি সেকথা বলে?

২) যদি সম্ভব, তাহলে এই বিদ্যা ইউক্রেন বাসীরা শিখে ফেলে রাশিয়ার সৈনিকদের উপর প্রয়োগ করছে না কেন? তাহলে তো সহজেই রাশিয়ান সৈনিকরা অসুস্থ হয়ে পড়তেন কিংবা মারা যেতেন। এমনকি সেটা বিনা যুদ্ধে। কোনও ক্ষয় ক্ষতি হত না। কিংবা কাশ্মীরের জঙ্গিদের উপর প্রয়োগ করলেই তো হয়। সেনাবাহিনীর পিছনে এত টাকা খরচ করতে হবে না।

৩) ডাইনি কেবল গ্রামের দিকেই কেন? এর যদি কোন শক্তির অস্তিত্ব থাকত, তাহলে তা বড় বড় শহরেও থাকা উচিত ছিল। কিন্তু নেই কেন? শিক্ষিত ও সচেতন মানুষকে কি ডাইনি ভয় পায়? এমন স্ববিরোধ কেন?  শহরেও তো মানুষ থাকে।

৪) সব সময় ডাইনিরা অশিক্ষিত, সহজ সরল আর ওঝা বা জানগুরুরা চালাক-চতুর হয় কেন? সহজেই বিশ্বাস করানো, ভুল বোঝানো, ঠকানো কিংবা প্রতারিত করা যাবে বলে?

৫) কেবলমাত্র বিড়বিড় করে "ফুঁ" দিলেই কি শারীরিক রোগ নিরাময় সম্ভব?

৬) ওঝা বা জান গুরুরাই ডাইনি চিহ্নিত করেন। কোন ক্ষমতা বলে? তারা কি আদৌ রোগ সারাতে পারে? যদি পারে, তাহলে তারা নিজেদের শরীর খারাপ হলে ডাক্তারের কাছে ছুটে যায় কেন?নিজেদের বেলায় এমন ব্যতিক্রম কেন? ডাইনি চিহ্নিত করলেই কি রোগ সারে?

৭) ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা থাকলে সেই শক্তি তারা মার খাওয়ার সময় কিংবা হেনস্থা হওয়ার সময় প্রয়োগ করতে পারে না কেন? শত্রুকে পরাস্ত করতে পারে না কেন? কারণ তেমন কোনও শক্তি বলে তো আদৌ কিছু নেই। আর নেই বলেই তাদের ধর্ষিত, মুন্ডিত ও পুড়ে মরতে হয়।

৮) আমাদের মন ও শরীর খুব জটিল। দুটোর বিশৃঙ্খল আচরণ আরো বেশি জটিল। সেই শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে দিনদিন গবেষণা চলছে। কত কিছু নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কৃত হচ্ছে। কত কিছুর ব্যাখ্যা এখনও আমাদের অজানা। সেইসব জানার চেষ্টাও চলছে। তাই কোনও কিছু আমাদের নিজেদের ব্যাখ্যাতীত মানেই সেটা যে অলৌকিক, এমনটা সব সময় ধরে নেব কেন?

ভারতবর্ষের কয়েকটা রাজ্যে ডাইনি বিরোধী আইন চালু হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গেও দ্রুত ডাইনি বিরোধী আইন প্রণয়ন করা উচিত বলে মনে করি। সেই সঙ্গে পৃথক পৃথক রাজ্যে আইন তৈরি না করে কেন্দ্র থেকেও একটা নির্দিষ্ট আইন তৈরি করা উচিত, যাতে সমস্ত রাজ্যে তা কার্যকর করা যায়। ছুটনি মাহাতোর পদ্মশ্রী খেতাব পাওয়ার পর বিষয়টি আরো বেশি করে কেন্দ্র সরকারের মাথায় রাখা উচিত।

তথ্যসূত্র: বিহার তক, এ বি পি নিউজ, ইন্ডিয়া নিউজ, NMF নিউজ, NBT নব ভারত টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, দি ফলোআপ প্রভৃতি নিউজ চ্যানেলের সাক্ষাৎকার।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. এরকমই আরো একটি বিষয় হলো 'ভর' আসা বা 'ভর' হওয়া। অস্বাভাবিক আচরণকারীর মুখ দিয়ে দেব -দেবীরা কথা বলেন। গ্রাম এবং শহরের ও কিছু শিক্ষাহীন বা অল্প শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এটি দেখা যায়। এ বছরই আমাদের বাড়ির কাজে সাহা্য্যকারী পিসি এসে বললেন কালি পুজোর দিন রাতে অমুকের বৌকে 'ভর' হলো। সবাই তার পা ধরছে। আর যাকে দয়া হচ্ছে তাকে অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।
    এই সময়ে এসেও এইসব খুব হাস্যকর ও অবাক লাগে। বুঝি শিক্ষা, সচেতনতার কতটা অভাব এখনো।

    ReplyDelete