জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন- ১৫/মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব- ১৫ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)


মলয় সরকার


আমরা সামনেই হোটেলে এসে ব্রেকফাস্ট করে বেরোলাম গাইড , ইউসুফের সঙ্গে। ও এসে বসেছিল।ছেলেটি বেশ শান্ত, মাথায় চুল একেবারেই ছোট করে  ছাঁটা , মাঝারি উচ্চতার ছিপছিপে চেহারার  এবং বেশ ফর্সা। মুখে স্মিত হাসিটি যেন নীল আকাশের গায়ে সাদা মেঘের মত আটকে আছে সবসময়। 

ওর সঙ্গে প্রথমে আমরা গেলাম , আমাদের হোটেলের সামনেই এক মাটির তলায় অবস্থিত, বিশাল জলের ট্যাঙ্ক দেখতে, যার নাম Yerebatan Sarayi or Yerebatan Sarnici or Basilica Cistern যা ছিল সারা শহরে এবং রাজপ্রাসাদে জল সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র।শোনা যায় খ্রীঃ ৩য়-৪র্থ শতাব্দীতে এখানে একটি ব্যাসিলিকা ছিল। সেটির জায়গায় এটি নির্মিত হয়েছিল সম্ভবতঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তাই একে ব্যাসিলিকা সিস্টার্ণ বলে। তারপর সাম্প্রতিক কালে এর বেশ কয়েকবার সংস্কার কার্য করা হয়। । এটি তৈরী করতে নাকি ৭০০০ ক্রীতদাসকে কাজে লাগানো হয়েছিল। ১৪৫৩ খ্রীঃ তে অটোমান সাম্রাজ্য শুরু হলে, কাছেই তোপকাপি প্রাসাদে এখান থেকেই জল যেত।

এটি প্রায় ৯৮০০ বর্গমিটার নিয়ে তৈরী এবং তার ক্ষমতাও কম নয় , ৮০০০০ ঘনমিটার জল ধারণের ক্ষমতা রাখত। এটিতে প্রবেশ করতে রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা নেমে যেতে হয় সিঁড়ি দিয়ে। ভিতরটা বেশ অন্ধকার মত, যদিও বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা আছে।এর ভিতরে ৩৩৬টি স্তম্ভ আছে যা এর ছাদটিকে ধরে রেখেছে। এই স্তম্ভগুলির মধ্যে অনেকগুলিই অন্য জায়গা  থেকে আনা হয়েছে।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,মেডুসার উলটানো মাথাওয়ালা স্তম্ভ।আশা করি, পাখা ওয়ালা গ্রীক ডাইনী মেডুসার গল্প সবার জানা আছে ,যার মাথার চুলগুলো ছিল জ্যান্ত সাপের আর যে তার চোখের দিকে  তাকাবে সে হয়ে যাবে পাথর। (সেই জন্যে লোকে এর  কাটা মাথাটি ব্যবহার করত এই উদ্দেশ্যে যে , যে কোন ভাল জিনিসের দিকে যাতে কারোর কুনজর না লাগে , তার রক্ষাকবচ  হিসাবে)। এখানে স্তম্ভগুলো খুবই কারুকার্য করা।

এই জলাধারে নামার জায়গায় সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হয়। ভেতরটা বেশ আলো আঁধারী তবে আলোর থেকে আঁধারটাই বেশি। কারণটা কি ঠিক জানি না, কোন বৈজ্ঞানিক কারণ, না, ইচ্ছা করেই এরকম রহস্যময় করে রাখা জানি না।এখানে আগে নাকি ছোট নৌকা চলত দেখার বা দেখানোর জন্য , এতটাই বড় এই ভুগর্ভের জলাধার । এখন চারধার ঘিরে হাঁটার মত প্ল্যাটফর্ম করা আছে, নীচে রয়েছে জল, যে জল আসছে দূরের বেলগ্রেড ফরেস্ট থেকে, যেটা তুরস্কের একটা ঘন জঙ্গল।এখানের স্তম্ভগুলো , আগেই বলেছি খুবই কারুকার্য করা , তবে একটা মজার ব্যাপার আছে , তা হল এগুলোর অনেক গুলোই এসেছে সারা রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে। ফলে এই স্তম্ভগুলির কারুকার্যের গল্প, মোটিফ, ধরণ, পাথরের ধরণ কিছুই এক ধরণের নয়। তবে তা হলেও বেশ দর্শনীয় । 

এখানে একটা কথা বলা হয় নি। আমাদের আজ যাত্রার শুরুতে আমাদের গাইড ইউসুফ জানাল, আজ আপনাদের সঙ্গী হবেন কিছুক্ষণের জন্য, আপনার দেশের লোক। জিজ্ঞাসা করলাম কে? বলল, চলুন , আলাপ করবেন। দেখি ও একটি দোকানের সামনে এক মুসলমান দম্পতিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। দেখা হতে পরিচয় করানোর পর ওঁরা বললেন, ওঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।ভদ্রলোকের বয়স প্রায় আমার মতই হবে। ভদ্রলোক, দাড়ি টুপিতে সাধারণ মুসলমান ভদ্রলোকের মত আর ভদ্রমহিলা বোরখায় ঢাকা, শুধু চোখ মুখ খোলা। জানালেন, ছেলে বোধ হয় দোহা না কোথায় থাকে। ছেলের কাছে এসেছিলেন। তার ইচ্ছাতেই অল্প সময়ের জন্য , একবেলা ইস্তাম্বুলে এসেছেন। যাই হোক অনেকদিন পর বিদেশে বাঙালী দেখে আর কথা বলে ভাল লাগল। তখন মনেই থাকল না যে, ওনারা বাংলাদেশের মুসলিম আর আমরা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু। এই ব্যাপারটা আমরাই বেশি করি দেশে। এখানে মনে হল, বেশ কিছুদিন পর মাতৃভাষায় কথা বলতে পেরে এত আনন্দ হল, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।আমি এই ব্যাপারটা অন্য জায়গাতেও দেখেছি।বিদেশে কোথাও নিজের দেশের কাউকে পেলে ভীষণ আনন্দ হয়, আর নিজের ভাষার ভাষাভাষী হলে তো আর কথাই নেই। আমার গিন্নী চললেন ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর সাথে গল্প করতে করতে।ফলে তাঁরা দুজনে কেবলই পিছিয়ে পড়ছিলেন।এদিকে ভদ্রলোক মিতভাষী কিন্তু স্মিতহাস।আমরা চললাম এগিয়ে।বিদেশের মাটিতে এসে ধর্ম আর দেশের কাঁটাতারের বেড়াজাল কোথায় ছিঁড়ে পড়ল তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
 
 গাইড সঙ্গে নিলে আমি সব সময়েই গাইডের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করি। নাহলে অনেক কথাই শোনা হয়  না, অনেক কথাই জানা হয় না। 

 এখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পাশেই হিপোড্রোমে। সবই পাশাপাশি, আগেই বলেছি এস্প্ল্যানেডের মতই। সব ঐতিহাসিক জিনিসগুলো কাছাকাছি। কেউ না বুঝিয়ে দিলে এর গুরুত্ব বোঝা যায় না। সামনে দিয়ে চলেছে ট্রাম, পাশে প্রধান রাস্তা। পাশেই রয়েছে খাবার দোকান, ঘড়ি, ইলেক্ট্রনিক্স, শাড়ী, কার্পেট সব কিছুর দোকান। এছাড়া ফেরিওয়ালা, পাগল, ভবঘুরে, পথিক, পর্যটক সব আছে। এর মধ্যেই অনেকে বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে দিনটা কাটানোর জন্য। সব মিলিয়ে জমজমাট চারপাশ।

আমরা ঢুকলাম এক প্রশস্ত ফাঁকা জায়গায়। মাঝে রয়েছে একটি স্তম্ভ, বেশ উঁচু। চৌকো সাদাটে পাথরের কারুকার্য এবং অনেক মূর্তি খোদিত স্তম্ভ। এটিকে বলে  Obelisk.  এটি একটি মাত্র পাথরে তৈরী। এত উঁচু বড় একটি পাথরে কারুকাজ করে, তাকে এনে বসানো খুব সহজ কথা ছিল না। এটি আসলে সম্রাট তৃতীয়  থুটমোসের সময় ১৪৯০ খ্রীঃ পূঃ তে তৈরী হয় ইজিপ্টে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এটি তৈরী হয়েছে। ভাবতেই আশ্চর্য লাগে ।সেটিকে এনে এখানে সম্রাট থিওডোসিয়াস, দ্য গ্রেট এর সময় ৩৯০ খ্রীঃ তে বসানো হয়। আসল ওবেলিস্ককে কেটে তিনটি টুকরো করা হয় আনার সুবিধার জন্য। তাও এখন যেটি আছে সেটি তার উপরের অংশটুকু মাত্র।এর গায়ে উপর থেকে নীচে পর্যন্ত রয়েছে মিশরীয় ভাষায় লিপি।এর নীচের অংশে চারদিকেই রয়েছে রোমান যুগের রিলিফের কাজ। এছাড়া কিছু রোমান ও ল্যাটিন হরফের লিপি।

এখানেই হত সেই রোমান যুগে বিখ্যাত রথের রেস যা আমরা দেখেছি “বেন হুর” চলচ্চিত্রে। “বেন হুর” বা “ রোমান হলিডে” ছবিগুলোর সঙ্গে একটু পুরানো দিনের শিক্ষিত বাঙ্গালীর যেন কেমন একটা নস্ট্যালজিয়া জড়িয়ে রয়েছে।সেই যুগে, সিনেমাতে ঐ ধরণের রথের রেসের ছবি কি করে তোলা হয়েছিল, সে সম্বন্ধে আজও বিস্ময়বোধ জাগে। 


 এ ছাড়াও নানান ধরণের খেলা ও সমাবেশের বিভিন্ন কাজেই  জায়গাটিও যে বেশ বড় ছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তথ্য জানাচ্ছে  , এটি, দৈর্ঘ্যে ৪৫০ মি ও প্রস্থে ১৩০ মি ছিল। এটি প্রথম তৈরী হয় ২০৩ খ্রীঃতে। পরে সম্রাট কন্সটান্টিনোপল এটি ৩২৪ খ্রীঃ তে আরও সংস্কার করেন।এখানে প্রায় এক লক্ষ দর্শক এই সমস্ত খেলা উপভোগ করতে পারত। তোপকাপি প্রাসাদ থেকে সম্রাট বা রাজপরিবারের লোকেরা যাতে সোজাসুজি এখানে এসে উপস্থিত হতে পারেন, তার জন্য আলাদা রাস্তা ছিল।যে জায়গায় এক লক্ষ মানুষ খেলা দেখতে পারবে, সে জায়গাটা কতবড় হতে পারে বা তার ব্যবস্থা কেমন হতে পারে, আন্দাজ করাই যেতে পারে।

এ ছাড়া রয়েছে Serpent column বা সর্প স্তম্ভ। এটি খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীকরা পারসীকদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে তৈরী করেছিল।সেটিকে সম্রাট থিওডোসিয়াস তুলে এনে হিপোড্রোমের মাঝে বসান। এর মাথার কিছু অংশ আছে গতকাল যে মিউজিয়ামটি দেখলাম ,সেখানে।এই স্তম্ভটি ব্রোঞ্জ বা এই ধরণের কোন ধাতুর, আপাততঃ বেশ সবুজ বর্ণের। এটি একটি গোলাকার ঘেরা জায়গার মধ্যে একটু নীচুতে খাড়া ভাবে রাখা আছে।

এ ছাড়া রয়েছে একেবারে সীমানার দিকে আরও একটি ওবেলিস্ক, তাকে বলা হয়, Walled Obelisk. এটি খ্রীঃ ১০ম শতাব্দীতে সম্রাট  Constantine Porphyrogenitus তৈরী করেন। এটিও চৌকো এবং বেশ উঁচু, প্রায় ১০৫ ফুট।তবে এটি একটি পাথরের তৈরী নয়, অনেক পাথরের টুকরোকে ইঁটের মত গেঁথে তৈরী। তবে এটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।

এখান থেকে বেরিয়ে এলাম উলটো দিকে , সেটি আবার আয়া সোফিয়ারও মুখোমুখি , বিশাল এক মসজিদ, ব্লু মস্ক এ । এটিকেই দেখেছিলাম আয়া সোফিয়ার গ্যালারীর জানালা থেকে । এটি এখনও চালু মসজিদ এবং মসজিদের সমস্ত রকম কাজকর্মও হয়। প্রচুর দর্শনার্থী রোজ এখানে ভিড় করেন। এর সামনে এবং পিছনে বেশ বড় না হলেও , কিছু গাছপালা আছে বাগানের মত।এর দেওয়ালে প্রচুর হাতে আঁকা নীল টালির কারুকাজের জন্যই একে বলা হয় ব্লু মস্ক। এছাড়াও অবশ্য আরও একটি তথ্য আছে এই নামের পিছনে।যে সমস্ত নাবিকরা বসফরাস দিয়ে ভেসে যান, তাঁরা সমুদ্রের জলের রঙয়ের প্রতিফলন এই মসজিদের দেওয়ালে দেখতে পান । তা নীল রঙের হওয়ায়, এটির নাম ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ।

এটিও বেশ উঁচু । এর ডোমটি ৪৩ মি ও পাশের মিনারেট গুলি ৬৪ মি উঁচু। সুলতান আহমেদ ১৬০৯-১৬১৬ সালের মধ্যে এটি তৈরী করেন। এটি জনগণের টাকায় তৈরী হয় বলে মুসলমান মৌলবীরা খুব ক্ষুব্ধ হন। এর ফলে রাজকোষেও টান পড়ে ।এটিও যথেষ্ট বড় । এই সুলতান আহমেদের নামেই এই মসজিদ।পাশের জায়গাটির নামও এনার নামেই সুলতানআহমেদ স্কোয়ার বা ( Sultanahmet square)।

এখানে একটি ব্যবস্থা দেখেছিলাম। ঢোকার মুখে দর্শনার্থীকে একটি প্যাকেট দেওয়া হয়, যার মধ্যে জুতো ঢেকে নিতে হয় এবং বেরিয়ে এসে ওই প্যাকেট ফেরত দিতে হয়। মাথাটিও কিছু দিয়ে ঢেকে নিতে হয়। বহু মানুষ একসঙ্গে এখানে প্রার্থনা করেন।

এখানে প্রায় ২০ হাজার হাতে আঁকা টালি আছে। রঙীন কাঁচের প্রচুর জানালা আছে। ভিতরের সৌন্দর্যও অসাধারণ। ডোমের উপর পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রচুর কাঁচের জানালা আছে, চারধারে গোল করে ঘিরে।আয়া সোফিয়ার মত এরও ভিতরটা ঝাড় লণ্ঠন ও উচ্চতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়।আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার ফলে এখানেই বেশি মানুষ প্রার্থনা বা ধর্মীয় কাজে আসতেন। এখন তো আবার আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়, কাজেই এখন কি অবস্থা জানি না। এখানের রঙীন কাঁচের জানালাগুলি নাকি ভেনিসের সুলতান উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। এখানে, ভিতরে ইমামের যে দাঁড়াবার জায়গাটি, যেখানে উনি প্রার্থনার সময় দাঁড়ান, সেটি ভীষণ ও সুদৃশ্য।এখানে ভিতরে যত মানুষই প্রার্থনার সময় জমায়েত হোক , প্রার্থনার সময় ইমামের কথা সবাই শুনতে পান , এমনই এখানকার ব্যবস্থা।এটিও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যা পেয়েছে।  


এর পর আমরা যাব ইস্তাম্বুলের প্রধান দর্শনীয়র মধ্যে একটি, সেই তোপকাপি প্রাসাদে। সঙ্গে থাকুন আপনারা–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments