জ্বলদর্চি

দশরথের সাইকেল /শ্রীজিৎ জানা

দশরথের সাইকেল

শ্রীজিৎ জানা


দশরথের রথ বোলতে তার দ্বিচক্র যান সাইকেল। গৌরা বাজার থেকে তার বিয়ের বছরই কিনে আনে। এটলাস্ কোম্পানির সাইকেল। পেছনে লোহার কেরিয়ার বাড়তি টাকা দিয়ে লাগিয়ে নেয় সে। তখন তার যুবক বয়স। রসিকতার ছলে দশরথ বলে,
--প্যাডেলে পা রাখলেই হাওয়ায় উড়ে যেত আমার রথ। রাবনের পুষ্পকরথ যেমন, তেমনটি। তবে তাতে করে সীতা হরণে যাইনি। খোকার মাকে পেছনে বসিয়ে বাঁইবাঁই করে ঘুরে বেড়িয়েছি। আজকার ছেলেছোকরা হলে হাঁপিয়ে হাঁ হোয়ে যেত।
অল্প কথায় থেমে যাবার পাত্র নয় দশরথ মন্ডল।স্ত্রী তার গত হয়েছে বহুদিন হোলো। ছেলে-বৌমার সংসারে থাকলেও,বেশিরভাগ সময় কাটায় গাঁযের আশ্রমে। যোগাশ্রম। গৃহীদের অবাধ যাতায়াত। আশ্রম পরিচালন কমিটির অন্যতম একজন বল্লে ভুল বল হবে না। তারচেয়েও বড় আত্মশ্লাঘা বোধ করে দশরথ বাবাজী তাকে সারথি  ডাকে। স্বামী গীতানন্দের ছায়াসঙ্গী হোলো দশরথ। আশ্রমিকরা তাকে ওই নামেই ডাক দ্যায় । আশ্রমের দুয়ারে কাঠের চেয়ারে বসে যেই না হাঁক দেবেন গীতানন্দ,
---কই গেলি রে দশরথ
অম্নি বিদ্যুৎবেগে হাজির হোয়ে মাথা নত করে জানাবে,
---কিছু বলবেন বাবা।
বয়স ষাটের গন্ডি ডিঙিয়ে সত্তরের দিকে হাঁটা দিয়ে পাঁচধাপ এগিয়েছে কদিন হোলো। তবে চেহারা দেখলে বোঝা মুশকিল। গাঁট্টাগোট্টা তামাটে ফর্সা শরীর। গোঁফদাড়ি কামানো মুখ।গলায় তিন ফের তুলসীমালা।  সাইকেলের পেছনে নিত্যদিন যেমন কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে,তেমনি রোজ বন্ধ ঘরে নিয়ম করে চলে তারা প্রাণায়াম,সাথে এক অধ্যায় করে গীতাপাঠ।শরীর খারাপ তার সচরাচর হয় না। হলেও ডাক্তারখানার মুখ সহজে দেখে না।নিজস্ব জড়িবুটি মোতায়েন রাখা আছে তার মাথা গোড়ায়। মাঝেমধ্যে দশরথের  শিবাম্বু পান করা চাই।

কাকভোরে দশরথ বিছানা ছাড়ে। তামার ঘটিতে রাখা জল পান করে বাসিমুখেই। তার কথায়,
---ভোরে ঊষাপান আর গায়ে বীরবাতাস না লাগালে শরীর বুড়া হয় শিগগির। 
প্রাতকৃত্য সেরেই ক্ষেত জমির আলপথ ধরে হাঁটা দেবে কয়েক চক্কর।  ফিরেই ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো আর পোড়া মবিলের ডিবা নিয়ে চলে সাইকেলের যত্নআত্তি। একবিন্দু ধুলো লেগে থাকতে দেবেনা তার গায়ে। প্যাডেলে চেনে গিয়ারে ব্রেকে সর্বত্র মবিল  দেওয়া চাই। আগে তো খেজুরপাতায় মবিল ঢেলে দিত।এখন মবিল দেওয়া পিচকারির মতন ডিবা নিয়ে এসেছে বাজার থেকে।
সাইকেল নিয়ে তার রকমসকম দেখে অনেকেই ঠাট্টাতামাসা করতে ছাড়ে না। আরতি তাকে উঠতে বসতে ঠেস মেরে বোলতো,
---যত্ত সোহাগ দেখি ওই একটা সাইক্যাল লিয়ে।বৌ-ব্যাটাদের দিকে অমন লজর দিলে ঢের কিছু হোতো।
দশরথ এক কান দিয়ে শোনে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দ্যায় এসব কথা। সকাল -বিকেল কখনো সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে কি পাড়ার কেউ না কেউ রসিকতা মিশিয়ে বলবে,
--কী গো দশরথ খুড়া পক্ষীরাজ চড়ে কুথা বেরিছ?
বিনিময়ে মুখে মৃদু হাসি টেনে দশরথ এক টুকরো উত্তর দেবে মিহি গলায়,
--অই সামনে যাব আরকি..

এত সহজে রাগার পাত্র সে নয়। কথায় কথায় সে বলে,
--ক্রোধের আগুন ভয়ঙ্কর। রাগতে নাই সহজে। রাগলে তো সব গেল।দুজ্জোধন তো রাগেই কুরু বংশটাকে ধ্বংস কল্লে।
কিন্তু দশরথের রাগ হয়, যখন তার সাইকেল নিয়ে কেউ হাসিমস্করা করে। সাইকেলের বয়েস কম নয়। যন্ত্রের তো ক্ষয়বয় থাকে। অনেক জোড়াতালি দিয়ে, যত্ন-খাতিরে তার পেয়ারের বাহনকে টিকিয়ে রেখেছে সে। ছেলেছোকরা যদি মুখ ফসকে বলে দ্যায়,
--দাদু ভাঙড়বালাকে ডেকে এবার তমার রথের সদগতি করে দাওনা। মরার বয়েস তো কবেই পেরিছে।
শোনা মাত্রই থমকে দাঁড়ায় দশরথ। মুখটা তার রাগে লাল হোয়ে যায়। ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
--তরা কি বুঝবি।মানুষকেই ভালবাসতে শিখল নি। আর ইত যন্তর।
---তা বোলে তুমি যেটা কর, লোকে পেটের ছ্যানার জন্যেও অমনটা করেনি।
---ছ্যানারা  যবে মোরবো তবে ঘাড়ে করবে আর ই ছ্যানা সেই কবে থিকে মোকে ঘাড়ে করে বইছে। টান  একটু হবেনি!
আর কেউ যদি তার সাইকেলের একটু গুণগান করে দ্যায়,অম্নি দশরথের চোখেমুখে রোদ চকচক করে। ঠোঁটের ডগায় কথা উপচে পড়ে,
--এই সাইকেলের সঙ্গে মোর মায়া জড়ি গ্যাছে। কত দুর দুরান্ত এতে চড়ে চলে গেছি। হাটের আনাজপাতি বয়েছি। আরতিকে লিয়ে রাতে যাত্রা শুনতে গেছি। তখন সাইকেলের আগে হেডলাইট লাগিছিলম। পিছনের চাকার গায়ে থাকত মটর। চাকার সাথে মটরের ঘষা লাগলেই লাইট জোলত। এখন সেসবের পাট চুকে গ্যাছে।

কিন্তু বিগত ক'মাস ধরেই তার ছেলে-বৌমার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না কিছুতেই। সংসারে এই অশান্তির মূল কারন দশরথের সাইকেল। বৌমাতো মুখের উপরে বলে দিল সেদিন,
--অমন লজ্ঝড় মার্কা আদ্যিকালের সাইকেলকে এঘরে আর তুলতে দেব না।
বিকাশ কোন কথা না বলে দাঁড়িয়ে থাকে। দশরথ বুঝতে পারে বৌমার কথায় তার ছেলেরও সায় আছে।ইদানীং সাইকেল করে তেমন কোথাও যায় না দশরথ। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই বেশি বেশি করে আশ্রমকে আঁকড়ে ধরে সে। আশ্রমের নিত্য নৈমিত্তিক কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। গীতানন্দের পাশে বসে কতরকম তত্ত্বকথা শোনে। সংসারের মায়া কাটিয়ে পরমাত্মার চরণে নিজেকে সঁপে দেবার কথা বলেন তার গুরুদেব গীতানন্দ। দশরথ মনে করে সংসারের টান সে ছিন্ন করতে পারলেও,সামান্য ওই একটা লৌহযান তাকে কোন এক অমোঘ জাদুতে বশ করে রেখেছে বুঝতে পারে না!
ক্লাস ফোরে পড়া নাতি একবার তার সাইকেল নিয়ে ঘরের সামনে চালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ফেলে দ্যায়। দৌড়ে আসে দশরথ। সন্তানকে মাটি থেকে যত্নে তোলার মতো তুলে ধুলো ঝাড়তে থাকে কাঁধের গামছা দিয়ে। খুঁটিয়ে দেখতে থাকে কোথাও চোট পেয়েছে কিনা! এই দৃশ্য তার বৌমার চোখ এড়ায় না। সন্ধের সময় আশ্রম থেকে দশরথ ফিরতেই ছেলে রাগত স্বরেই বলে উঠে,
--নাতির চেয়েও তোমার ওই সাইকেলটা বড় হোলো। ছোট্ট ছেলেটা কোথাও চোট পেল কিনা তা না দেখে সাইকেলকে নিয়ে ব্যাস্ত হোয়ে পড়লে? তোমার কি মাথা খারাপ হোয়ে গেল বাবা?
দশরথ নিরুত্তাপ। কোন প্রত্যুত্তর করে না। আরতি চলে যাবার পর থেকে ক্যামন যেন দেহের বল হারিয়ে ফেলেছে সে।  বাইরের কাঠামো মজবুত দেখালেও ভেতরে জোর একেবারে নেই। তারপর যখন তার আরাধ্য গুরুদেব গীতানন্দ দেহ রাখলেন। মনে হোলো চারিদিকের শূন্যতা তাকে গিলে খেতে আসছে।দশরথ জানে দেহের মৃত্য ঘটে কিন্তু আত্মা অমর। তথাপি তা মতো সাধারণ একজন গৃহীর পক্ষে নিজেকে সামলানো কঠিন জেনেই বলে উঠে,
---অত উপর মনের অবস্থায় যেতে পারিনি এখনো।আমরা হোলম জ্ঞানপাপী।
তবে সংসারকে সে কোনোদিন সেভাবে আঁকড়ে ধরেনি। সময়স্রোত যেভাবে তাকে নিয়ে গ্যাছে সেভাবেই চলেছে। গীতানন্দ তাকে বুঝিয়েছেন,
--সাইকেলে ব্রেক থাকে বিপদ এড়ানোর জন্য। জীবনেও ব্রেক দরকার। ষড়ঋপুর পায়ে ব্রেক মেরে থামাতে হয়। আর ওই যে ক্রিংক্রিং করে ঘন্টা মানে বেল বাজাস,ওটা অন্যকে সতর্ক করার জন্য। তুইও বাঁচলি অপরকেও বাঁচালি। এর নামই তো প্রকৃত বেঁচে থাকা।
দশরথ একা বাঁচতে শিখেনি কখনো। পাড়া গাঁয়ের যেকোনো বিপদআপদে সে সবার আগে হাজির হয়। যতদূর যেতে হোক তার সাইকেল ছুটবে হাওয়ার বেগে।কতবার কত ডাক্তারকে সে তড়িঘড়ি তার সাইকেলে চাপিয়ে এনে বিপদ উদ্ধার করেছে। এসব কথা গাঁয়ের বয়স্করা জানে। তার ছেলেও জানে সেসব। কিন্তু নতুন বাড়ি করেছে সে। মেঝেতে পাথর বসানো। দেয়ালের রঙে মুখ দেখা যায়। সেই পালিশকরা হালআমলের ঘরে তার রথ বড় বেমানান। তাছাড়া তার সাইকেল রাখার জন্য একচিলতে জায়গা নেই বাড়ির কোথাও। পুরোনো বাড়ি ভেঙে এই নতুন বাড়ি। নামী ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে প্ল্যান করা।  দশরথের কানে আসে গাঁয়ের সবাই বলে,
---অজলা চাকরীর পয়সা বলে কথা,অমন হবেনি!
দশরথের তাতে কোন হেলদোল নেই। অতবড় ঘরে অনেকসময় নিজেকেই তার অপাঙক্তেয় মনে হয়। তাহলে তার সাইকেলের শেষগতি কোথায় হবে ভেবে কুল কিনারা পায় না! ক্রমেই তার সাইকেলের উপর ছেলে-বৌমার বিরক্তি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।
---এই ঘরে কোনভাবেই ওই সাইকেল রাখা যাবে না, বাবা। তুমি কাল-ই লোক ডেকে ওটাকে বিদায় করো।
ছেলের মুখের উপর ফুঁসে উঠতে চায় দশরথ। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। দশরথ জেনে গ্যাছে,যা পুরানো আসলে তা বাতিলের দলে। অকেজোদের কোনো ঠাঁই নেই কেজোদের সংসারে।না মানুষের মনে, আর না ঘরের এককোণে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস তার বুক ছাপিয়ে উঠে আসতে চায়।

অনেকরাত অব্দি ঘুমোতে পারে না দশরথ। কতরকম ভাবনা তার মাথায় ভিড় করে।  সাইকেলটা সে বিক্রি করতেই পারতো।  কিন্তু এই সাইকেলে ঘিরে তার কত স্মৃতি!কত আবেগ ও শ্রদ্ধা!   সবার উপরে সাইকেল তার গুরুদেবের রথ আর সে হোলো সারথি এই পরিচয়েই তো তাকে চিনেছে সবাই। সামান্য কটা টাকার জন্য গুরুদেবের সঙ্গে জুড়ে থাকা তার রথযানকে সে বেচতে পারবে না কোনোদিন। একটা লোহার যন্ত্র বেচতে গিয়ে নিজেকে প্রাণহীন যন্ত্রে পরিণত করতে পারবে না সে।অভ্যাস মতো কাকভোরে বিছানা ছাড়ে দশরথ। আগেকার মতো ততটা ক্ষিপ্রতা নেই তার শরীরে। তবে এখনো সে পরাশ্রয়ী নয়। কাউকে কিছু না বলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দশরথ। গতকাল বহুদিন পর বিকেলে অনেক্ষণ ধরে সাইকেলটাকে পরিষ্কার করেছিল যত্নভরে। প্যাডেলে পায়ের  অল্প চাপ দিতেই গতি পায় তার রথ। কোথায় যাবে কোন ঠিক ঠিকানা নেই তার। তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে তার রথযান। ঘোরের মধ্যে প্যাডেল করে চলেছে সে। অনুভব করছে যেন পেছনের ক্যারিয়ারে বসে আছে আরতি। তার ডান হাতটা পেঁচিয়ে তার কোমরে জড়ানো। আর বলছে,
--কেন অত ফোর্সে চালাচ্ছো বলো দেখি। পড়লে বাঁচবো
---তোকে কে ফেলাচ্ছে? বোস্ দেখিনি চুপ মেরে

বিড়বিড় করে বলে আর প্যাডেল ঘোরায় দশরথ।অদ্ভূত একটা জোর যেন  এসেছে তার শরীরে,মনে।  কিছুক্ষণ পরেই ভাবে  এবার যেন সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে আছেন তার গুরুদেব গীতানন্দ। প্রতিবারের মতো এবারো তার শিষ্যের সঙ্গে চলেছে বার্তালাপ, 
--বল দেখি দশরথের সারথি কে ছিলো?
--সুমন্ত্র
---আর আমার সারথি হলি তুই।
দশরথ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে  কথাগুলো শেষ করেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হেসে উঠছেন তার গুরুদেব। ভোরের আবছায়া ভেদ করে তার সাইকেল যেন হাওয়ায় ভেসে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে জোরে আরো জোরে। 
পিছনে ফেলে যাচ্ছে সে  তার  আত্মজ, ঘরদোর, ভিটেমাটি,  গ্রাম, স্থাবর-অস্থাবর সমস্তকিছু।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments