জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—এশিয়া (লাওস) /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—এশিয়া (লাওস) 
চিন্ময় দাশ 

খরগোশের চাতুরি 
 
শীতের দুপুর। এক খরগোশ রোদ পোয়াচ্ছিল বসে বসে। তখনই এক হাতি চলেছে সামনে দিয়ে। হাতির তো নাদুস-নুদুস চেহারা। থপ-থপ করে চলেছে। মাটি পর্যন্ত লম্বা ইয়াব্বড় একখানা নাক, থুড়ি, হাতির শুঁড়টা, দুলছে একেবারে সামনে। 
হাতির এই বেখাপ্পা নাক বা শুঁড়টা দেখলেই, পেটের ভিতরটা একেবারে গুড়গুড় করে ওঠে খরগোশের। সে হাসি চাপতে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয় তখন। দুনিয়ার আর কোন জীবের এমনটা নাই। কেবল হাতির নাকটাই যে কেন এমন বেখাপ্পা, বিধাতাই জানেন।
খরগোশের মাথাটা দুনিয়ার যত বদবুদ্ধিতে ঠাসা। হাতিকে দেখেই একটু মজা করবার ভাবনা এসে গেল তার। হাঁক দিয়ে বলল—চললেন কোথায়, ঠাকুর মশাই? 
কুতকুতে চোখ হাতির। তাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খরগোশকে দেখতে পেল। বলল—যাবো আর কোথায়? ডেরায় ফিরছি এখন। 
--তা, বলি, আছেন কেমন? ভালো তো? 
--মন্দ নয়। ঠিকই আছি। 
এইবারে আসল কথায় এল খরগোশ। বলল—তাহলে একবার জোরাজুরি হয়ে যাক। 
কথাটা ঠিক সমঝে উঠতে পারল না হাতি। বলল—মানে? কী বলছিস?  
--বলছি, একটু দড়ি টানাটানি হয়ে যাক দুজনের। দেখি, কে জেতে? 
হাতি হা-হা করে হেসে উঠল। 
--এখনই হেসো না, ঠাকুর। আগে টানাটানি হোক। তুমি জেতো। তারপর, যত প্রাণ চায়, তখন হেসো বরং। 
হাতি অবাক হয়ে বলল—বলিস কীরে? বিধাতার একটা পুঁচকে জীব! তুই লড়বি আমার সাথে।
--সে কথাই তো বলছি, ঠাকুর। আমার বহুদিনের মনের সাধ, তোমার সাথে লড়াই করি। ছোট বলে তূমি তো গ্রাহ্যই করো না আমাকে। একদিন একটু যাচাই হয়ে যাক, কার গায়ে কত জোর।
শুনে হাতির বেশ মজাই লাগল। কৌতুক কার না ভালো লাগে? বলল—ঠিক আছে, তাহলে হয়ে যাক পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষাটা হবে কীভাবে? 
খরগোশ তো মহা খুশি। এতদিনে একটা মওকা পাওয়া গেছে হাতিকে বোকা বানানোর। সে বলল—আজ এখন ভরা পেট তোমার। বাড়ি ফিরে বিশ্রাম করো গিয়ে। কাল সকাল সকাল চলে এসো এখানে। আমিও যাই, একটা দড়ি জোগাড় করি কোথাও থেকে। দুজনে দড়িটার দুদিকে ধরে টানব, তাতেই বোঝা যাবে, কার কতো মুরোদ।
হাতিকে বিদায় করে, খরগোশ ছুটল নদীর দিকে। সেখানে থাকে বাঘা-মাগুর। বিশাল ক্ষমতা তার। তাই  নিয়ে ভারি গুমোরও মাছটার। খুব বড়াই করে নিজের শক্তি নিয়ে। 
নদীর ধারে পৌঁছে একটু চোখ চালাতেই, মাগুরের দেখা পেয়ে গেল। নদীর কিনারে গা এলিয়ে রোদ পোয়াচ্ছে মাছটা। খরগোশ বলল—কী খুড়োমশাই, খবর কী? আছো কেমন? 
--খারাপ কিসের? ভালোই আছি। তা তুই হঠাৎ আমার খোঁজ নিতে এলি যে বড়? মতলবটা কী? 
খরগোশ বেশি চালাকি করল না মাগুরের সাথে। বলল—না, খুড়ো। কোন মতলব নয়। শীতের দিন তো, গা ম্যাজম্যাজ করছে। একটু ব্যায়াম করব ভাবছিলাম।
মাগুর বলল—ব্যায়াম করবি? সে তো বেশ ভালো কথা। বারণ করছে কে তোকে?
--না, মানে, একটু দড়ি টানাটানি করব ভাবছিলাম। কিন্তু ঝামেলা হয়েছে, কেউ আমার সাথে লড়তে রাজি নয়। 
--কেন রে? তোর মতো বীরের সাথে লড়তে ভয় পাছে বুঝি? মাগুর যে তাকে ব্যাঙ্গ করছে, বেশ বুঝতে পারছে খরগোশ। গায়ে না মেখে, সে বলল—একদম ঠিক বলেছ? তাই তো তোমার কাছে এলাম। তোমার মতো বীর কে আছে আর এই এলাকায়? কোন কিছুতেই তুমি যে ভয় পাও না, জলে বলো বা ডাঙ্গায়, সবাই জানে সেকথা। 
মাগুর অবাক হয়ে বলল—তুই আমার সাথে লড়তে এসেছিস? সাহস তো কম নয় তোর?
--ব্যাপারটা সাহসের নয় গো, খুড়ো। শক্তিতে কে কম কে বেশি, পরীক্ষা হয়ে যাক সেটারই। ছোট বলে তুচ্ছ কোর না। 
কথাগুলো ভারি আঁতে লাগল মাগুরের। কথা না বাড়িয়ে বলল—কীভাবে হবে পরীক্ষা? 
--একটা দড়ি নিয়ে আসব সকালে। তুমি একধারে কামড়ে ধরবে। আমি অন্যধারে। টানাটানিতে যে জিতবে, তাকেই শক্তিমান মেনে নেব আমরা। 
বন্দোবস্ত পাকা করে, নিজের ডেরায় ফিরে গেল খরগোশ। সকাল না হতেই একটা লম্বা দড়ি নিয়ে তৈরি। 
হাতি এসে পৌঁছালে, তাকে দড়ির এক দিক ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল কচ্ছপ। বলে গেল-- আমি ওদিকে যাচ্ছি। যেই ‘শুরু’ বলে চেঁচাবো, অমনি টানাটানি শুরু হবে দুজনের। দেখা যাবে, কার গায়ে কত জোর। 
নদীর কিনারে গিয়ে, মাগুরকে আর দিক ধরিয়ে দিয়ে একই কথা বলল—তুমি এদিকটা কামড়ে থাকো। আমি ওদিকে গিয়ে ‘শুরু’ বললে, টানতে লেগে যাবে।
মাঝামাঝি যায়গায় গিয়ে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে, খরগোশ হাঁক ছাড়ল—'শুরু’।
হাতি আর মাগুর—দুজনেই জানে, দড়ির অন্যদিকটা ধরে আছে পুঁচকে খরগোশটা। দুজনেই টান লাগাল। কিন্তু অবাক কাণ্ড! একচুলও নড়াতে পারছে না খরগোশকে। দুজনেই গায়ের সব শক্তি লাগিয়ে দড়ি টানতে লাগল। কিন্তু সামান্যও নাড়াতে পারছে না কেউ।
দুজনেই অবাক? ব্যাপারটা কী? একটা খরগোশের গায়ে এত জোর! হতেই পারে না। তাহলে রহস্যটা কি? নিশ্চয়ই কিছু একটা চালাকি আছে হতভাগার। 
দু’দিক থেকে হাতি আর মাগুর দুজনেই মুখ তুলে দুজনকে দেখতে পেল। খরগোশের টিকিরও দেখা নাই। তাহলে, দুজনে তারাই দড়ি টেনেছে এতক্ষণ! ভয়ানক রেগে, দুজনেই এগোতে লাগল স্যামনের দিকে। ব্যাপারটা কী, দেখতেই হবে। 
দুজনেই যখন খানিকটা এগিয়ে এসেছে, খরগোশ দেখতে পেয়ে গেল তাদের। একটু ঘাবড়েই গেল সে।  এমনটা হবে, তার মাথায় ছিল না। কিন্তু এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কী করা যায় এখন। কাছেই একটা ঘোড়ার মাথার খুলি পড়েছিল। টুক করে গিয়ে সেটার মধ্যে ঢুকে পড়ল খরগোশ।
ভেতর থেকেই দেখল, হাতি তখন খুলিটার পাশ দিয়ে চলেছে তারই খোঁজে। গলা পাল্টে খরগোশ বলল—খরগোশের খোঁজে যাচ্ছ, যাও। কিন্তু সাবধান, শেষকালে আমার মত দশা না হয়। 
হাতি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, জিজ্ঞেস করল—কী বলতে চাইছ, মাথায় ঢুকল না কিছু। খোলসা করে বলো, শুনি। 
--এতে বলবার আর আছেটা কী? নিজের বিপদ নিজে ডাকতে যাচ্ছো তুমি। লড়াই করবার আর কাউকে পেলে না? কেন, দেশে কি বাঘ সিংহের আকাল পড়েছে?  তোমার মতো একদিন এই ভুল আমিও করেছিলাম। শেষে প্রাণটাই গেছে খরগোশের হাতে। কোথায় আমার সেই তাগড়াই চেহারা। আজ এই মাঠের মধ্যে কঙ্কাল ছড়িয়ে পড়ে আছি। নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছো। 
বেদম ঘাবড়ে গিয়ে হাতি তোতলাতে লাগল—বলো কীহে?
খুলির ভেতর থেকে আওয়াজ বেরুলো—ছোট্ট ঐটুকুন বলে, তুচ্ছ করতে যেও না। ভয়ঙ্কর জীব এই খরগোশ। নিজের মঙ্গল চাও তো, ভালোয় ভালোয় সরে পড়ো এখান থেকে। এক পা-ও আর এগিয়ো না।
সেই যে উল্টো মুখে ঘুরে দৌড় লাগাল হাতি, সেদিন থেকে আর কখনও খরগোশের নামটাও আনে না মুখে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments