জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা-১৪/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 
সুরশ্রী ঘোষ সাহা

চতুর্দশ পর্ব : আতিথেয়তা


গ্রামের কথা লিখতে বসে টুকরো টুকরো কত কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে। আজ লিখতে ইচ্ছে করছে, গ্রামের অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে। শহরের মানুষ কিন্তু অতিথি আগমন পছন্দ করলেও দীর্ঘদিন থেকে যাওয়া বিশেষ কিছু পছন্দ করে না। আজকাল সেল্ফি-যুগে একজন কারুর বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসা কিংবা বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে গেট-টুগেদার করা হয় শুধুমাত্র ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার লোভে। কিন্তু বেশি কিছু সময় থেকে গেলেই মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট হয়। মনে মনে তখন গৃহ কর্তা কী কর্তৃ বলতে থাকে, অতিথি তুম কব যায়োগে। মানুষের এই মানসিকতা নিয়ে হিন্দিতে একটি সিনেমাও তৈরি হয়ে গিয়েছে।

 অথচ গ্রাম এই ব্যাপারে আজও একই আছে। বাড়িতে অতিথি আসলে এবং মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কাটিয়ে গেলেও তারা খুশি হয়। আতিথেয়তার ত্রুটি রাখে না। অতিথিকে একটা নির্দিষ্ট ঘরও ছেড়ে দেওয়া হয়। আর তার সুবিধা-অসুবিধা সব দিকে নজর রাখা হয়। 

 আমার জেঠুর বাড়ির কথাই এই প্রসঙ্গে সবার আগে মনে পড়ে। যখনই যাই, দেখতে পাই, একজন না একজন অতিথি ঠিক বাড়িতে টানা রয়েছে। সম্পর্ক খুঁজে বের করতেও অনেক হিসেব কষতে হয়। যেমন ধরা যাক, অতিথি হল গিয়ে বাড়ির বড় ছেলের ভায়রাভাইয়ের শ্বশুর মশাই। কিংবা সেজ বৌমার জামাইবাবুর ভাই। অথবা, ছোট ছেলের বড় শ্যালিকার কাকি-শাশুড়ি.... এবং এঁরা এমন ভাবেই থাকেন, যেন তাঁরা এই বাড়িরই সদস্য। রান্নায় কোন কোন পদ হবে থেকে শুরু করে, ছোট নাতনিটা আজকাল পড়ায় খুব ফাঁকি দিচ্ছে এমন সকল বিষয়ে তাঁদের মতামতকে গুরুত্বও দেওয়া হয়।

 বারবার ঐ জেঠুর বাড়ি, জেঠিমার বাড়ি করছি বলে ভাববেন না যেন, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। অর্থাৎ আমার গ্রাম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ঐ জেঠুর বাড়ির গন্ডি পর্যন্ত। এমনটা ঠিকই, ছোট থেকে ওখানে প্রচুর থাকার জন্য ঐ গ্রাম - ঐ পরিবেশ বেশি করে লেখায় উঠে আসছে। কিন্তু গ্রাম আমি আরো দেখেছি। যেমন, বোলপুরের সিউড়ির এক গন্ড গ্রামে যাওয়ার এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।

 আমি গিয়েছিলাম আমার এক দাদার বাড়ি। আর সেখান থেকে আমার দাদা নিয়ে গিয়েছিল, সেখানকার এক আঞ্চলিক কবির বাড়ি। যাঁর ঘরদোর ও জীবন-যাপন দেখে ঐ অল্প বয়সেই চমকে উঠেছিলাম আমি। বুঝতে পেরেছিলাম, 'সকলেই কবি নন; কেউ কেউ কবি।' কথাটা কতখানি সত্যি সেদিন সেই মানুষটাকে না দেখলে জানা হত না। গ্রামটাকে আগেই গন্ডগ্রাম বলেছি, কেন তা এবার ভেঙে বলি...

 খুব ক্ষীণ বক্রেশ্বর নদীর পার ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা। তখন আশ্বিন মাস। নদীর এক ধারে শ্মশান। 'বল হরি হরি বোল' বলতে বলতে মৃতদেহ নিয়ে এল কিছু লোক। আরো দুটো মৃতদেহ আগে থেকেই চুপিচুপি পুড়ছিল। সরু ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল। শ্মশান মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত নিরিবিলি এক জায়গা। আর আমার দেখা বক্রেশ্বর নদীর পারের ঐ গ্রাম্য শ্মশান আরো ভীষণ শান্ত এক স্থান বলে মনে হয়েছিল। ঐ জায়গায় পৌঁছে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম, যে, চারিদিকে দুর্গা পুজো চলছে। সেখানে ছিল শুধু শরৎ প্রকৃতির রূপ-লীলা। কাশে ভরে ছিল নদীর চড়া। আর ধারে ধারে হয়ে থাকা ছাতিম গাছগুলো ফুলে ভরে উঠে তার চড়া গন্ধে মোহিত করে তুলছিল চারপাশ। নদীর অপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বিরাট ঘন জঙ্গল উঠে গেছে। আমরা এপার ধরে হেঁটে চলেছিলাম। একসময় নদী অন্য পথ ধরল। আর আমরা অন্য পথ। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে ঘন গহীন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি খেয়াল করিনি। আশেপাশে শাল, সেগুন, পিয়াল, শিরিষ, তেঁতুল গাছেরা একে অপরকে ছুঁয়ে উপরে উঠে গেছে আকাশ ছোঁবার ইচ্ছায়। নিচে ছোট ছোট কাঁটা-ঝোপ জঙ্গল ও বড় বড় ঘাস। কমলা, সাদা, হলুদ কত ধরনের বুনো ফুল ফুটে আছে চারিদিকে। তারই মাঝের খুব সরু মেঠো পথ ধরেছি আমরা। এক জায়গায় দূর থেকে দেখতে পেলাম মাটি থেকে অনেক উপরে মাচা মতন করে একটা কাঠের ঘর বানানো রয়েছে। বাঁশ কাঠ দিয়ে উঁচু করে তোলা হয়েছে সেই ঘর। যেমনটা পাহাড়ি অঞ্চলে বন্য শ্বাপদ জন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য বানানো হয়। সেই ঘরে ওঠার জন্য রয়েছে কাঠের মইয়ের সিঁড়ি। আমরা সেই মাচার কাঠের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর সেই সিঁড়ি ধরেই একে একে উপরে উঠতে শুরু করলাম। উপরের কাঠের ঘর থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এল, কে? 

 বুঝলাম, কাঠের সিঁড়ির মচ-মচ শব্দ উপরে পৌঁছেছে। আমার দাদা সাড়া দিল, আমি সঞ্জয়। 

 আরে, এসো এসো। দরজা ঠেলে ঢুকে এসো। ভিতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল। 

 দাদা ঢুকল। আমি সিঁড়ির মাঝের এক ধাপে দাঁড়িয়ে তখনো চারপাশটা দেখছি। পিছনে একটা জংলা দীঘি। তাতে কোথাও বেগুনী কচুরিপানা ফুল মাথা উঁচু করে আছে, তো কোথাও গোলাপী শালুক ফুল। কাঠের ঘরের দরজার সামনে এক ফালি বারান্দা। যাতে খাঁচায় পোষা রয়েছে, টানা টানা হলুদ চোখের কালো ময়না। 

 দাদা ভিতর থেকে আমাকে ডাকল, কী রে, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আয়?

 আমি ঘরে ঢুকে মাটির মেঝেতে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম শীর্ণ চেহারার এক প্রবীণ মানুষ সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ধূসর ছাপা লুঙ্গি পরে ছোট্ট একটা চৌকিতে বসে আছেন। মাথাভরা উস্কো খুস্কো সাদা চুল। তাঁর চারিপাশে দেশ-বিদেশের নানা বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। চৌকির নিচে মেঝেতে হরেক রকমের কৌটো, বাটি-গ্লাস ছড়িয়ে আছে। আর খানিক দূরে রয়েছে একটা স্টোভ। বুঝলাম, এটা ঐ একলা মানুষটির জগৎ-সংসার....

 কবি দাদার সাথে লেখালেখি নিয়ে কত ধরনের আলোচনায় হারিয়ে গেলেন। হঠাৎ তারই ফাঁকে তিনি বলে উঠলেন, আরে, বোনকে নিয়ে প্রথম এসেছ, কী খাবে বলো? আমরা দুজনেই একসাথে না.. না, কিচ্ছু না, বলে উঠলাম। কিন্তু আমাদের কোন আপত্তিই তাঁর কাছে টিঁকলো না। উনি উঠে পড়লেন। তারপর চৌকির তলায় দাঁড়িয়ে-শুয়ে থাকা একটা একটা করে কৌটো খুলে খানিক চিঁড়ে, কিছু সাদা বাতাসা, তিলের নাড়ু রাখলেন একটা অ্যালুমিনিয়ামের কানাউঁচু থালায়। ঘরের কোণে দাঁড় করানো কুঁজোটাকে কাত করে দুটো ছোট কাঁসার গ্লাসে ঠান্ডা জল ঢাললেন মুখ ভর্তি করে।

 আমাদের সামনে রেখে বললেন, এটা এখনকার জন্য। এবার আমি খিচুড়ি চাপাব। দুপুরে খেয়ে তারপর যাবে তোমরা।

 ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখালেন, নিচে এক টুকরো জমিতে উনি নিজের হাতে চাষ করেছেন। হাসতে হাসতে বললেন, যখন কবিতা আসে না, তখন চাষ করি। তারপর ঐ জমি থেকে তুলে আনা ফসল দেখি এক-একটা কবিতা হয়ে উঠেছে। সকালে তুলে আনা ছোট ছোট আধপাকা সবজে-লাল টমেটো, গোল আলু, সবুজ মরিচ ও দু-মুঠো খুদ ধুয়ে কড়াইয়ে ঢেলে চাপিয়ে দিলেন স্টোভে।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই কবির কাঠের ঘরটা খিচুড়ির গরম ধোঁয়া ওঠা সুগন্ধে ভরে উঠল। 

 কবি মগ্ন হয়ে গেলেন কবিতা পাঠে - 

'মাচান থিকে লাউটো পাড়লাম
বনিয়ে নিয়ে জমিয়ে রাঁধ
রা কাড়িস না কেনে রে বৌ
চক্ষে কেনে জলের বাঁধ।'

 মনে হল যেন দেখলাম, কবি নিজের চোখের জল বাঁধ দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। জানি না, সেদিন ঠিক দেখেছিলাম, নাকি সবটাই আমার মনের ভুল!
                                                                    (ক্রমশ...) 
ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. অপূর্ব লেখাটা, আমি এতোদিন এই লেখাটা দেখিনি কেন? খুব আফশোষ হচ্ছে।

    ReplyDelete