জ্বলদর্চি

রোমান্সের সন্ধানে--রবীন্দ্রনাথ ও শেলী /ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত


রোমান্সের সন্ধানে – রবীন্দ্রনাথ ও শেলী 

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

The fountains mingle with the river
   And the rivers with the ocean,
The winds of heaven mix for ever
   With a sweet emotion;
উপরের সুন্দর পঙক্তিগুলো এমন একজনের লেখা, যার নামের আগে লেখা হয় ‘রোমান্টিক কবি’। উপরের পঙক্তিগুলো রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করে লিখেছিলেন, -
নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে
          তটিনী মিশেছে সাগর-'পরে,
পবনের সাথে মিশিছে পবন
          চির-সুমধুর প্রণয়-ভরে!
রোমান্টিক যুগের অন্যান্য সব কবিদের মত শেলিও মানবপ্রেমিক ছিলেন। মানুষের সুন্দর ভাবনা সম্পর্কে শেলি যথেষ্ঠ আশাবাদী ছিলেন। শেলির রোমান্টিকতা ছিল একান্ত আদর্শায়িত রোমান্টিকতা। আর শেলির কবিতায় রবীন্দ্রনাথ পেতেন এক উচ্চস্তরের রোমান্টিক স্বাদ। তাই হয়ত রবীন্দ্রনাথ নিজেই কাব্য করে বলেছেন, -
“আমারে বলে যে ওরা রোম্যাণ্টিক।
              সে কথা মানিয়া লই
                   রসতীর্থ-পথের পথিক”।
এমনকি শান্তিনিকেতনে কবি যখন স্কাইলার্ক পড়াতেন তা এমন সুন্দরভাবে ছাত্রদের বুঝিয়ে বলতেন, ছাত্রদের কখনও মনে হত না কোনও বিদেশী কবির কবিতা পড়ছেন। লীলা মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, তখন বর্ষা শেষ হয়ে আসছে। উদয়নের সামনের বারান্দায় ক্লাস। মাথার ওপর নীল আকাশ, ছেঁড়া মেঘ। কবি শেলির স্কাইলার্ক পড়াচ্ছেন। মূল কবিতাটি ইংরেজিতে পড়ার পর তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলায়। ‘আর কাউকে এমন কবিতা পড়াতে শুনিনি।’ 
“Hail to thee, blithe Spirit!
Bird thou never wert,
That from Heaven, or near it,
শেলির স্কাইলার্ক কবিতার প্রতিধ্বনি যেন রবীন্দ্রনাথের ‘বকুলবনের পাখি’ কবিতায় পাওয়া যায়।
“শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,
দেখো তো, আমায় চিনিতে পারিবে না কি।
নই আমি কবি, নই জ্ঞান-অভিমানী,
মান-অপমান কী পেয়েছি নাহি জানি”,
শেলী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাদেবীকে লেখেন, “শেলিকে অন্যান্য অনেক বড়োলোকের চেয়ে বিশেষরূপে কেন ভালো লাগে জানিস? ওর চরিত্রে কোনোরকম দ্বিধা ছিল না, ও কখনো আপনাকে কিম্বা আর কাউকে বিশ্লেষণ করে দেখে নি–ওর একরকম অখণ্ড প্রকৃতি। … শেলির স্বভাবের যে সৌন্দর্য তার মধ্যে তর্ক বিতর্ক আলোচনার লেশ নেই। সে যা হয়েছে, সে কেবল নিজের ভিতরকার এ অনিবার্য সৃজনশক্তির প্রভাবেই হয়েছে”। 
বিদেশী কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের উপরে শেলীর প্রভাব গভীরতম। অনেকের ধারণা সন্ধ্যাসংগীত থেকে শেলির প্রভাবের যুগ – আসলে সেটা নয়। কবিকাহিনী ও বনফুল-এও শেলির প্রভাব অবিরল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
“তখনকার দিনে আমাদের লেখকদের একটা করিয়া বিলাতি ডাকনাম ছিল, কেহ ছিলেন বাংলার বায়রন, কেহ এমার্সন, কেহ আর-কিছু; আমাকে তখন কেহ কেহ শেলি বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন”— 
রবীন্দ্রনাথ এবং শেলী এই দুই কবিকেই কল্পনার প্রথম প্রেমিক বলতে পারি। কল্পনাবিদ্ধ কবিজীবন কী রকম হতে পারে শেলী তার নমুনা দিয়েছেন “Prometheus Unbound” নামক কাব্যনাট্যে। কবি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সূর্যকর প্রতিবিম্বিত জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকবেন, কুঞ্জবিতানে চেয়ে চেয়ে দেখবেন মৌমাছিক্রীড়া। কিন্তু এদেরই ভিতর থেকে তিনি সৃষ্টি করে নেবেন জীবন্ত মানুষের থেকে অধিক জীবন্ত এমন এক অবয়ব যাকে বলা হয় অমরত্বের জাতক। কল্পনার অভিসারে সেই ভাসমান আত্মার অনন্ত বিস্তার পাচ্ছি “Prometheus Unbound” –এ এশিয়ার গীত-ঝংকারময় সংলাপ বাক্যে,
“My soul is an enchanted boat
Which like a sleeping swan, doth float
Upon the silver waves of they sweet singing”
আমার আত্মা এক বিমোহিত তরণী, রাজহংসের মত ভাসমান তোমার গানের রূপোর ঢেউয়ে। প্রাথমিক রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছত্রে ছত্রে কল্পনার প্রতি উচ্ছ্বসিত আসক্তির অবিকল এক প্রতিরূপ পাচ্ছি। মনে পড়ে যাচ্ছে সন্ধ্যাসঙ্গীতের সেই অসাধারণ উচ্চারণ,
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার”! (গান আরম্ভ)
রবীন্দ্রনাথের অল্পবয়সে লেখা ‘কবিকাহিনী’, যাকে বলা হয় কবির গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম পুস্তক, সেখানে রোমান্টিক কল্পনার সঙ্গে কবিহৃদয়ের ভাববিনিময়ের কাহিনী আছে। কল্পনা এই শব্দটি ‘কবি কাহিনী’-তে একাধিকবার খুব সচেতন ভাবে ব্যাবহৃত। কাব্যের প্রথম চরণেই কল্পনাবালা এই শব্দটি পাচ্ছি।
“শুন কলপনা বালা, ছিল কোন কবি
বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে
তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া।
রবীন্দ্রনাথের যেমন ছিল ‘কবি কাহিনী’ তেমনই শেলীর আছে “Alastor”। এই দীর্ঘ কবিতাটির পুর্ণতর নাম “Alastor or The Spirit of Solitude”। কবিতাটির “Thou hast unveiled thy inmost sanctuary” ইত্যাদি পঙক্তিতে কবি কল্পনার দিব্য আলোকে বসুন্ধরার আত্মপ্রকাশের বিবরণী আছে।
“Thou hast unveiled thy inmost sanctuary,
Enough from incommunicable dream,
And twilight phantasms and deep noonday thought,                  
Has shone within me, that serenely now”
প্রমথনাথ বিশী তাঁর ‘রবীন্দ্রকাব্য প্রবাহ’ গ্রন্থে শেলী ও রবীন্দ্রনাথের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন দুজন কবিই ধাবমান জলস্রোত খুব ভালোবাসতেন। শেলী নৌকা করে চলে যেতেন নদী থেকে সাগরে। আর রবীন্দ্রনাথ ভেসে যেতেন পদ্মার বুকে হাউসবোটে করে। ছিন্নপত্রাবলী পাঠে জানা যায় একদিন ঝড়ে পড়ে তাঁর প্রায় ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। এখান থেকে একটা বিষয় বোঝা যায় রোমান্টিক কবিরা জল এবং নদী ভালোবাসেন। শেলীর কল্পনা নদীবুকে নৌকায় যাপিত জীবনকে যে পরম অর্ঘ্য দিয়েছিল তার প্রমাণ হিসাবে উপস্থিত করছি, “The boat on the serchio” কবিতার অবিস্মরণীয় পঙক্তিগুলি, গীতিমাধুরী সেখানে সম্বিতের দুই-তীরে নীলিমাপ্রশস্থ ডানা বিস্তার করেছে,
“Our boat is asleep on Serchio's stream,
Its sails are folded like thoughts in a dream,..
এই নদীপ্রতীক নৌকাপ্রতীক এই জলচিত্রকল্প স্বপ্নচিত্রকল্প রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম পর্বে বার বার দেখা দিয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক ‘সোনার তরী’ কবিতা থেকে,
“গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে”।…
রোমান্টিক কল্পনার একদিকে রয়েছে বিদ্রোহ অন্যদিকে রয়েছে বিষাদ। শেলী অতএব ঝড়কে উদ্দেশ্য করে অনায়াসেই উচ্চারণ করতে পারেন এই অমর পঙক্তিগুলি,
“Oh, lift me as a wave, a leaf, a cloud!
I fall upon the thorns of life! I bleed”!
রোমান্টিক কল্পনার অবিকল একই ধাঁচের বর্ণাঢ্য, শোভাযাত্রা পাচ্ছি রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যে বর্ষশেষ কবিতায়। বিদ্রোহের সঙ্গে কল্পনার প্রিয়যোগ এখানেও দেখতে পাচ্ছি, 
“ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে
বাধাবন্ধহারা
গ্রামান্তরে বেণুকুঞ্জে নীলাঞ্জনছায়া সঞ্চারিয়া
হানি দীর্ঘধারা।
তীব্রতম দুঃখের ভিতর থেকেই জন্মায় আমাদের মধুরতম সঙ্গীত। অশ্রুসিক্ত বেদনা এভাবে অনেক সময়েই শুধু হাসির চেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য মানসী (১৮৯০) কাব্য রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স প্রায় তিরিশ এবং শেলীর অকালমৃত্যু ঘটেছিল প্রায় এই বয়সেই। রাবীন্দ্রীয় কাব্য জীবনের এই প্রথম পর্বে রোমান্টিক বিষাদের প্রাধান্য। কখনো শোনা যায় হৃদয়ের আকুলতার সংবাদ, (কে? ছবি ও গান)
“আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো”।
রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি সমান্তরালে শেলীর জগৎকে স্থাপন করি। নষ্ট আত্মাকে বেঁধেছে এক শিকল (Early Poems);
“The chains that bind this ruined soul
Had cankered then—but crushed it not”
তেমনি কবিরও মনে হয়ছিল তাঁর আশা নেই, স্বাস্থ নেই, শান্তি নেই, নেই তাঁর যশ ও শক্তি, প্রেম ও বিশ্রাম। অথচ কতজনাই তো আছে যারা সবকিছুই পায়। তবু ইতালির নীল আকাশের নীচে উষ্ণ সাগরের সান্নিধ্যে এসে নিরালা কিছু মৃদু হল; মনে হল এক ক্লান্ত শিশুর মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে এই দুঃখ আহত জীবনের সব ভার হালকা করে তোলা যাবে, -
“কিন্তু নিরাশাও শান্ত হয়েছে এমন
যেমন বাতাস এই, সলিল যেমন
মনে হয় মাথা থুয়ে
এইখানে থাকি শুয়ে
অতিশয় শ্রান্তকায় শিশুটির মতো”। (বিদেশী ফুলের গুচ্ছ / শেলী – ১)
তবু রবীন্দ্রনাথকে মহাযুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর মানুষকে শোনাতে হয়েছিল শান্তির ললিতবাণী, বলতে হয়েছিল “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” (সভ্যতার সংকট)। রোম্যাণ্টিক কল্পনার ভিতরে ভিতরে রয়েছে তীব্রআগ্রানুভূতি – বাইরে তার প্রকাশ শব্দ ছন্দের লিরিকের মায়াবী ধ্বনির উচ্ছ্বসিত ঝর্ণাধারা রয়েছে শেলীতে, মনে পড়ে যায় “The Indian Serenade” – এর কোনও কোনও পঙক্তি, 
“Oh lift me from the grass!
I die! I faint! I fail”!
সেই লিরিকের ঝর্ণাধারা রয়েছে রবীন্দ্রনাথে – 
“তাই মনে হয় আমি পরম সুন্দর,
আমি অমৃতনির্ঝর।
সুখসিক্ত নেত্র মম
শিশিরিত পুষ্পসম,
ওষ্ঠে হাসি নিরুপম
মাধুরীমন্থর”। (উৎসব। চিত্রা)
শেলির সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘শেলি সর্বাংশে…কবি ছিলেন…তাঁর ব্যবহার, তার যা কিছু আশা আকাঙ্খা, তার সমস্তই এক কবিত্বের ছাঁচে ঢেলে তৈরি করেছিলেন–এ কথা বেশ উপলব্ধি করা যায়”। তাই প্রেমের বেদনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনূদিত কবিতায় (শেলি - ‘বিদেশি ফুলের গুচ্ছ’) লিখছেন, -
“নাই যশ, নাই প্রেম, নাই অবসর--
পূর্ণ করে আছে এরা সকলেরি ঘর।
         সুখে তারা হাসে খেলে,
         সুখের জীবন বলে--
আমার কপালে বিধি লিখিয়াছে আরেক অক্ষর”।

ঋণ: রবীন্দ্ররচনাবলী – ১ম – ৩য় খন্ড, Shelly – Poetical Works, The Romantic Imagination – C.M.Bowra, রবীন্দ্রজীবনী – ১ম খন্ড প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments