জ্বলদর্চি

সলমন খানের গার্লফ্রেন্ড /সন্দীপ দত্ত

সলমন খানের গার্লফ্রেন্ড

সন্দীপ দত্ত


ওকে আমরা সবাই সলমন খানের গার্লফ্রেন্ড হিসেবেই চিনতাম। যদিও মায়ের দেওেয়া একটা ভাল নাম ছিল ওর। কিন্তু পাড়ার কেঊই ওকে ও নামে ডাকত না। মধুমিতা নামটা তাই আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে ওর জীবন থেকে। আঠেরো বছরের আগেই ও হয়ে ওঠে সলমন খানের গার্লফ্রেন্ড।
     সলমন খান তখন 'হাম আপকে হ‍্যায় কৌন'ছবি করে সকলের চোখের মণি হয়ে গেছে। 'ম‍্যায়নে প‍্যায়ার কিয়া' আর 'সাজন'দেখে সবাই বুঁদ। বোম্বের বাজারে এক অপ্রতিরোধ‍্য সুপারস্টার। ঝকঝকে রূপ আর সুঠাম দেহে যুবকরা উন্মাদ। যুবতীদের বুকে ধড়কন হয়ে বেঁচে থাকে সলমন।
     আমরা তখন দশ বারোর গন্ডিতে বন্দি। শাসন আর অনুশাসনে জেরবার। বাড়িতে বাবা মা'র ধমক চমক,প্রয়োজনে মার আর স্কুলে স‍্যার ম‍্যাডামদের কাছে বকুনি।
    এরকমই এক ছেলেবেলার শীতের বিকেলে নন্দীকাকুদের  পড়ে থাকা ফাঁকা জমিটাকে মাঠ বানিয়ে জমিয়ে ক্রিকেট খেলছি চোখে সচিন তেন্ডুলকর হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে,হঠাৎ আশিস ঝড়ের গতিতে সাইকেল নিয়ে এসে মাঠের মাঝখানে দাঁড়াল। "খবর শুনেছিস,সলমন খানের গার্লফ্রেন্ডকে পায়ে শিকল পরিয়ে ঘরে আটকে রেখেছে ওর মা। খুব কান্নাকাটি করছে রে মেয়েটা।"
     আশিস আমাদের বন্ধু হয়েও বয়েসে বড় ছিল। তবে আশিসদা বলে ডাকিনি কখনও। আশিস বলেই ডেকেছি। রোজ আসত না ও। আসত মাঝেমধ্যে। আমরা যখন ঘুড়ি ওড়ানোর জন‍্য মাঞ্জাতে কাচের গুঁড়ো মেশাই,তখন ও আসে। বৃষ্টিভেজা বিকেলে ফুটবল খেলতে নেমে গোলকিপার হওয়া নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে তর্কাতর্কি করি এবং করতে করতে একে অপরের জামা ছিঁড়তে যাই,তখন ও আসে। আশিসের দিদির বান্ধবী ছিল মধুমিতাদি। মধুমিতাদির বাজারের আটাকলে কাজ করত বিকেলবেলা। সকালে বাসন মাজত চারটে বাড়িতে। যার মধ্যে একটা বাড়ি আমাদের।মধুমিতাদির বাবা ছিল নিরুদ্দেশ। তাই অভাব ছিল সঙ্গী।
      মধুমিতাদির মা আমার মাকে তখন প্রায়ই কথাটা বলে। "মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না বৌদি। সারাক্ষণ শুধু সলমন খান আর সলমন খান। বলছে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। চলে যাবে বোম্বে। কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে যদি কোনও হঠকারিতা করে বসে!"
     মনে আছে,মধুমিতাদির পায়ে শিকল পরানোর খবরটা যেদিন চাউরহয়,তার দিন কুড়ি পরেই ছিল সরস্বতী পুজো। সে বছর সরস্বতী পুজো আর ভ‍্যালেন্টাইনস্ ডে একই দিনে। তখন অবশ‍্য ভ‍্যালেন্টাইনস ডে'র অর্থ আমরা বুঝতাম না। মেতে থাকি সরস্বতী পুজোকে নিয়ে।
     অন‍্য পাড়া থেকে সাইকেলে দুধভর্তি ক‍্যান চাপিয়ে সকাল বিকেল বাড়ি বাড়ি দুধ দিতে আসত পান্নালালকাকু। রোগাটে শরীর। গায়ের রঙ কালো। লম্বা। তখন খুব বড় মনে হত ওকে। কিন্তু চব্বিশ পঁচিশের বেশি বয়স ছিল না বোধহয়। পাড়ার মেয়ে বউদের দিকে খারাপ চোখে তাকাত ছেলেটা।
      সে বছরই সরস্বতী পুজোর ঠিক দু'দিন আগে ওই পান্নালালকাকু  হঠাৎ করেই রাস্তার মাঝে আমাকে দাঁড় করায়। তারপর বলে,"হলুদ গাঁদাফুল নিবি তোরা? এক ঝুড়ি দেবো। শুধু একটা লাল গোলাপ দিতে হবে আমায়। পারবি?"
     কথাটা সত্যি। সরস্বতী পুজো এলেই হলুদ গাঁদার জন‍্য আমরা তখন পাগল হয়ে যাই। ছটপট করি,কীভাবে জোগাড় হবে? আশেপাশের অনেকের বাগানে চুপিচুপি ঢুকে পড়তাম ভোররাতে। 
     পান্নালালকাকুর এক কথাতেই রাজি হয়ে যাই। আমাদের বাড়িতে গাঁদাগাছ ছিল না। বাবা লাগাত গোলাপ। হরেকরকমের গোলাপ।লাল,হলুদ,কমলা কত যে রঙ! কত যে কুঁড়ি!
     পরের ঘটনাটা ছিল রোমহর্ষক। সরস্বতী পুজোর দিন দুপুরবলা শুনলাম,মধুমিতাদি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। অনেক কান্নাকাটির পর পুজোর দিন সকালবেলা ঘন্টাখানেকের জন‍্য ছেড়েছিল মা। সেই সুযোগেরই পান্নালালকাকু ওক ফুসলিয়ে নিয়ে যায় লাল গোলাপ দিয়ে। সলমন খানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
      তারপর আর কোনও খোঁজ নেই মধুমিতাদির। পান্নালালকাকুও বেপাত্তা হয়ে যায়।
       আজ টিভিতে যখন সলমন খানের মুখ ভেসে ওঠে,মধুমিতাদিকে মনে পড়ে যায়। কোথায় যে চলে গেল মধুমিতাদি! কোথায় যেতে পারে? পান্নালালকাকু কোথায় রেখে এল তাকে?
      মনে আছে,ঘটনাটা নিয়ে পুলিশকেস হয়। তবে সুরাহা হয়নি।
     সরস্বতী পুজো আর ভ‍্যালেন্টাইনস ডে আজও আসে। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। আজকের সলমন খানের শরীরে মেদ,চোখের চাহনিতে বয়েসের ভার। ও কি জানে,শুধুমাত্র ওর জন‍্য মফস্বলের এক মধুমিতা হারিয়ে গেছে?
     এই পর্যন্ত বলে থামল আদি। তারপর একটা সিগারেট ধরালো। আদির মুখোমুখি এখন বসে আছে রিমলি। আদির স্ত্রী। আজ সেই কোন্ সকাল থেকে রিমলি আদির কাছে আব্দার করছিল,ফেলে আসা জীবনের কথা  কিছু বলতে। যার সাথে সরস্বতী পুজো আর ভ‍্যালেন্টাইনস ডে'র মতো নস্টালজিয়া ঘুরেফিরে আসে।
     বাইরে এখন অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ছে। তাই কোনও রেস্টুরেন্টে যেতে পারবে না ওরা। বাড়িতেই বানাবে বিরিয়ানি। তারপর শঙ্খলাগার মতো মিলিত হবে সারারাত।
     আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। ভ‍্যালেন্টাইনস ডে। একটু চুম্বন না করলে হয়?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments