জ্বলদর্চি

কবি অমৃতা প্রীতমের দীর্ঘ কবিতা এবং প্রেক্ষাপট : নয়টি স্বপ্ন অনুবাদ ও উপস্থাপনা : দেবলীনা চক্রবর্তী

কবি অমৃতা প্রীতমের 
দীর্ঘ কবিতা এবং প্রেক্ষাপট : নয়টি স্বপ্ন
 

অনুবাদ ও উপস্থাপনা : দেবলীনা চক্রবর্তী


কবি পরিচিতি : অমৃতা প্রীতম ৩১সে আগস্ট ,১৯১৯ সালে অবিভক্ত ভারতে এক পাঞ্জাবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  
পাঞ্জাবি, হিন্দি ও উর্দুতে তিনি লিখেছেন প্রচুর লেখা কবিতা, উপন্যাস ও গল্প। ভারতীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে অমৃতা প্রীতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিংশ শতাব্দীতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উভয় দিকেই তিনি জনপ্রিয় ও সমাদৃত। জন্মশতবর্ষ পার করে আজও তার লেখা আমাদের প্রেরণা দেয় ,উজ্জীবিত করে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম।


প্রেক্ষাপট : 

নিম্নলিখিত ' নয়টি স্বপ্ন ' কবিতাটিতে উল্লিখিত নায়িকা হলেন মাতা তৃপ্তা যিনি শিখ ধর্মের সংস্থাপক শ্রী গুরু নানক জি ' র মা। বর্তমান পাকিস্থানের তালবন্ডী গ্রামে গুরু নানক তাঁর মাতা তৃপ্তা ও পিতা মেহেতা কালুর সন্তান রূপে ১৪৬৯ সালের কার্তিক মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
কবি অমৃতা প্রীতম তাঁর অসাধারণ লেখনী গুনে, কল্পনায় জারিত হয়ে নানক জি 'র জন্মের সময় গর্ভাবস্থায় তাঁর মাতা তৃপ্তার এক অলৌকিক অনুভব, গর্ভের প্রতিটি ধাপ যেভাবে পূর্ণতা পায়, সেই সময়ের মায়ের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং নারীর জীবনের দৈনন্দিন ঘটনার পরম্পরাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবৃতির মাধ্যমে গভীর অর্থ ও রহস্যময়তায় উপস্থাপন করেছেন। চন্দ্র সূর্য্য তারা , নদী ঝিল , বৃক্ষ জঙ্গল ইত্যাদিকে রূপকের দ্বারা এক অপূর্ব কাব্যিক সৌন্দর্য্যে প্রকাশ করেছেন এই দীর্ঘ কবিতা " নৌ স্বপ্নে " মাধ্যমে। এবং কিছু শব্দ ও তার অন্তর্নিহিত অর্থ যেন কবির নিজের মনে অনুরণিত হয়ে আরো গভীর অর্থের সংকেত দিয়েছে। 
এই অপূর্ব কবিতাটির মধ্যে দিয়ে কবি অমৃতা প্রীতমের এক অনন্য অনুভূতিই প্রকাশ পেয়েছে। 


অনূদিত কবিতা : নয়টি স্বপ্ন 


  • প্রথম ভাগ 

  তৃপ্তা চমকে জেগে উঠে 
  গায়ের অবিন্যস্ত চাদর সামলে 
  লজ্জায় রাঙা হয়ে লাল আঁচল 
  নিলো কাঁধে জড়িয়ে 
 স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলো
  তারপর সাদা বিছানার অসংখ্য
    ভাঁজে চোখ রেখে শঙ্কিত হলো 
আর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো ...
আজ মাঘের রাতে 
আমি এক নদীতে পা রাখলাম 

ভীষণ ঠাণ্ডা এই রাতে -
সে নদী ছিলো ঈশদুষ্ণ 

এ কথা অসম্ভব যে ,
যেই জলে পা রাখলাম
সে নদী হয়ে গেল দুধেল

এ ছিল নদীর এক যাদুবিদ্যা 
আমি দুধজলে শরীর ভেজালাম 

এই তালবন্ডীতে এ কেমন নদী 
এ কেমন স্বপ্ন ? 

সেই নদী জলে চাঁদ ভেসে যাচ্ছে 
আমি দু'হাতে জোছনা নিয়ে,আকন্ঠ পান করলাম 

  নদীর জল ক্রমশ
 আমার রক্তে মিশে যেতে থাকলো 
 আর সেই উজ্জ্বল প্রকাশ 
 আমার গর্ভে অকস্মাৎ নড়ে উঠলো।
 


• দ্বিতীয় ভাগ


 সাত রং মেশাই ফাল্গুনী আধারে
 মুখে কিছুই না বলে ... নিশ্চুপে
এই মাটির দেহ তখনই সার্থক হয়ে ওঠে
কেউ নিদ্রাতুর হয় যখন গর্ভফুলে 

এ কেমন জপ কেমন তপ?

যে মায়ের ঈশ্বর অনুভূত হয় 
তার নিজেরই গর্ভে ......


• তৃতীয় ভাগ 

কাঁচা গর্ভের গা-বমি ভাব 
বড়ই ক্লান্তিকর

ভাবতে বসে মনে হলো এক তাল মাখন নড়ে উঠলো
আর কলসে হাত ডোবালাম তো 
আগুনের বলয় হাতে ঠেকলো

এ কেমন ভোগ ছিলো ?
কেমনই বা সংযোগ ?

আর চড়া চৈত্রের দিনে 
এ কেমন স্বপ্ন ? 



• চতুর্থ ভাগ 


আমার থেকে আমার গর্ভ পর্যন্ত
মাত্র একটা স্বপ্নের দুরত্ব 

আমার হৃদয় উল্লাসিত হলো আর মন ভীত 
বৈশাখে কাটা হবে 
সে এমন কি সোনার ফসল
যা ছাচ তৈরির জন্য ফেলা হলো 
আর ঝাঁক তারায় তারায় ভরে উঠলো।



• পঞ্চম ভাগ  

আজ অন্ধকার রাত্রিবেলা 
আর জৈষ্ঠ্যের মাস
এটা কেমন আওয়াজ ছিল ?

 জল-স্থল থেকে 
 উঠে আসা এক নাদ 
 সে কোন মোহ আর মায়ার গান
 না কোন ঐশ্বরিক কায়ার সুর ?
কোন অপ্সরার দেহজ সুগন্ধ 
নাকি আমার ভ্রূণের ম্যাহেক ?
আমি চমকে চমকে উঠি আর ভয় পাই
আর এই শব্দের ঘোরে 
বনের গভীরে ঢুকে পড়ি ....

এ কেমন আওয়াজ 
কেমন স্বপ্ন ?
কতটা অন্যের,
বা কতটা আমার ? 

আমি যেন এক হরিণী
শুধুই উতলা হই 
আর নিজের গর্ভগৃহে 
নিজেই কান পেতে বসি।



• ষষ্ঠ ভাগ 


এখন আষাঢ় মাস 
স্বাভাবিকতায় তৃপ্তার ঘুম ভাঙলো 
যেভাবে ফুল ফোটে,
দিন পার হয়

"এই আমার জীবন 
যেন কোন এক সরোবরের জল 
যেখানে এখন এক হংস 
বসে আছে 

এ কেমন স্বপ্ন ?
 জেগে উঠেও
 মনে হয় , আমার গর্ভে
 ওই হংসের পাখা নড়ে উঠছে "
 
 

• সপ্তম ভাগ 

আমার আশেপাশে কোন গাছ বা মানুষ নেই 
তবু আমার কোলে 
কারা এত নারকোল রেখে গেলো?

আমি খোলস ভাঙতে থাকলাম 
আর লোক তা নিতে এলো
কাঁচা নারকোল এর জল 
আমি বাটিতে ভরলাম

কোন প্রথা বা পরম্পরা না 
না কোন দাওয়াত
দ্বারে এসে দাঁড়ালো অসংখ্য মানুষ 
কিন্তু তবুও এ ভান্ডার
ফুরোলো না 

এ কেমন খোলস ?
এ কেমন স্বপ্ন?
আর এই স্বপ্নের ধাগা কত লম্বা ?

আর আমার স্তনে শ্রাবণ
আমি আমার বুকে হাত রাখলাম
সে যেন নারকোলের জলের মতো- 
দুধের ধারায় বইতে লাগলো।



• অষ্টম ভাগ 


এ কেমন ভাদ্র ? 
এ কেমন জাদু ? 

সবই ভবিতব্য
এই গর্ভের সন্তানের জন্য 
কে চোলা বানাবে ?

এ কেমন কুণ্ডলী?
কেমন আবর্তন
আমি কাল রাতভর
ওই আলোক রশ্মিগুলো দেখেছি...

এখন আশ্বিন মাস
তৃপ্তা জাগলো আর হয়ে উঠলো যেন যোগিনী

হায় আমার জীবন 
তুই কার জন্য বেঁধেছিস এই মায়ার জাল

মোহ'র চাদরে আকাশ ঢাকা যায় না
সূর্যকে বাঁধা যায় না
এক সত্যি জিনিসের 
চোলা সেলাই করা যায় না।

তৃপ্তা মাথা নিচু করে 
গর্ভের দিকে
আর আমি স্বপ্নের মর্ম বুঝতে পারি
এ না আমার না অপরের

কোন এক অঞ্চলের যোগী
আসে মৌজ করে
ক্ষণিক বসে আর গর্ভের উত্তাপ সেঁকে যায়

 হায় আমার জীবন !
 তুই কার জন্য বেঁধেছিস এই মায়ার জাল....




• নবম ভাগ  


আমার কার্তিক ধর্মী
আমার জীবনের সুকর্মী
আমার গর্ভের প্রদীপ
ছেঁড়ো এই মায়ার জাল..

দীপ দেহ জ্বলে ওঠো
ক্ষীণ আলোকে ছুঁয়ে 
ডাকো সেই ধরিত্রীর ধাত্রীকে
হে আমার প্রথম তপস্যা ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments