জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ-১৪/ শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ
পর্ব- চোদ্দ 
শুভঙ্কর দাস 

"আলো,আমার আলো,ওগো
আলো ভুবনভরা।
আলো,নয়ন ধোওয়া, আমার
আলো হৃদয়হরা..."

এক আলোর সন্ধানে কলকাতায় এসেছে কুমার। একদিন ছাত্রাবাসে নিজের ঘরে জানালার দিকে শুয়ে সহসা কুমারের নিজের গ্রামের দিগন্তবিস্তারী মাঠের কথা,সেই মাঠের মধ্যে আলের ওপর ছায়াময়ী বটগাছের কথা মনে পড়ল।সেই বটগাছের তলায় তাকে একদিন আবদুল ফকির অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল।তাই মনে পড়ল।প্রথমে একটা গান শোনাল,সেটাও অদ্ভুত রকমের 

"একবার জাগ জাগ ভাই
ভারত সন্ততি!
অজ্ঞান-আবৃত,মায়া শয্যাগত
নিদ্রিত দশায়
কত কর স্থিতি"

বুঝলে ভাই,জাগতে হবে, জেগে থাকতে হবে সত্যিকারের!

এতো অদ্ভুত সুন্দর গান,কার লেখা?

কাঙালের লেখা।

কিন্তু আমরা তো জেগেই আছি

না ভায়া,এ জাগা সে জাগা নয়, এ হল মনের ভেতরে জেগে ওঠা।

মানে?

মানে টানে পরে বুঝবে, এখন শুধু এটাই মনে রেখো,শুধু সূজ্জি ওঠায় আলো হয় না,মনের মধ্যে জাগলেও আলো হয়।

মনের মধ্যে জাগলেও আলো হয়, এই কথাটি কুমার ভুলতে পারেনি।এখন সে যেন কথাটির মানে বুঝতে পারছে।একের পর বই পড়ে এবং ভেতর থেকে বুঝতে পেরে আবদুল ফকিরের কথাগুলো জীবন্ত উপলব্ধি করতে পারল।মনে জেগে ওঠাও আলো।আহ্ সুন্দর কথা। আচ্ছা,আবদুল ফকির কতদূর পড়াশোনা করেছে? কী করে এতো সুন্দর সুন্দর কথা বলে? বুঝে উঠতে পারে না কুমার।অথচ গাঁয়ের লোক  আবদুল ফকিরকে মাথাপাগলা লোক বলে।হাসাহাসি করে।কেউ কেউ বলে,একেবারে অকাজের ঢেঁকি,খায় দায় গান গেয়ে বেড়ায়।কোনো কাজকাম কিছুই করে না, না আছে বাড়ি,না আছে বিলাস, না আছে কোনো উদ্দেশ্য! অথচ কুমারের মনে হল,আবদুল ফকিরই আসল কাজ করে বেড়াচ্ছে, তার এই লোকের মনকে জাগিয়ে তোলা তো আসল কাজ।এই কাজ তো কেউ সবাই করতে পারে না,সবাই ভাবতে পারে না,যারা পারে,তাদের সকলকেই কমবেশি পাগল বলে,কী আশ্চর্য! কুমারের মনে হল,সে এই কাজ করবে,তার জীবন এই ধরণের কাজে অতিবাহিত করবে।কিন্তু সে কাজ করবে কী করে? সেটাই সে বুঝতে পারল না!
সহসা ঘরে ঢুকল গঙ্গাধর। সে দারুণ উল্লসিত। আরে বন্ধু, তুমি এখানে,প্রিন্সিপাল ওদিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। চলো, চলো।
কুমার এই আহ্বানে সেভাবে সাড়া দিল না।রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে নর্ম্যাল স্কুলের। অবশ্য সেই রেজাল্ট নিয়ে চিন্তিত নয় কুমার। তার প্রধান চিন্তা, এরপর কী? আবার সেই বাসুদেবপুরে ফিরে যেতে হবে? আবার সেই গরুচরানো! আবার সেই কোনো জমিদারের বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটা! আবার গ্রামের মধ্যে এমন উঁচু স্তরের স্কুল নেই, যেখানে মাস্টারি করে জীবনের জেগে থাকার পথ তৈরি করতে পারে।
কিন্তু সে তো জাগরণের মন্ত্র পেয়ে গেছে,তা হল পড়াশোনা। 
পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেই জেগে থাকবে এবং অন্যকেও জাগিয়ে দিতে পারবে।

কী হল? অভিমান নাকি!  আমাকে হারাতে না পারার খেদ।হেসে বলল,গঙ্গাধর

কুমার একবার মুখ তুলে তাকাল।হাসল।সে মনের মধ্যে যে পথের সন্ধান পেয়েছে, তার কাছে এই রেজাল্ট পৌঁছাবে না!

কী সত্যি বল? আমি সেই প্রথম হলাম এবং কুমারচন্দ্র সেই দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী,গঙ্গাধরকে হারানোর স্বপ্ন পূরণ হল না! আহ্ কী দুঃখ!  তাই একেবারে বধির! বলেই নেচে নেচে গঙ্গাধর গেয়ে উঠল,
"মিছা মণি মুক্তা হেম / স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।
সুধাকরে কত সুধা কত সুধা/ দূর করে তৃষ্ণা ক্ষুধা 
স্বদেশের শুভ সমাচার। 
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে / দেখ দেশবাসিগণে
প্রেম পূর্ণ নয়ন মেলিয়া। 
কতরূপ স্নেহ করি/ দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। "

এটি শোনা মাত্র কুমারও চেঁচিয়ে উঠল,বেশ, বেশ, এটাই ঠিক।একদম ঠিক। 
দেশের কুকুর ধরি/ বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। 
সত্যি, আমার নিজের দেশের কুকুরও ভালো,ঐ বিদেশির ঠাকুরের চেয়ে।বেশ। 

চলো বন্ধু, সেই দেশসেবা শুরু।

মানে? ঈশ্বর গুপ্তের মতো কোনো পত্রিকা বের করবি!

নারে বাবা,আমরা দু'জনেই একটা কাজ পেয়ে গেছি, তাই প্রিন্সিপাল ডেকেছেন, চল তো চল

কুমার মনে মনে উৎফুল্ল হল।

সেই সময় একটা পদ্ধতি ছিল।যারা নর্ম্যাল স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করত,তাদের একটা বিশেষ স্থান ছিল হাইস্কুল ও মাইনর স্কুলগুলিতে।নর্ম্যাল পাশ ছাত্ররা বাংলা ও অঙ্ক বিষয়ে এমন পারদর্শী হয়ে উঠত যে তারা হাই ইংরেজি স্কুলের দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবাধে ও দক্ষতার সঙ্গে পড়াতে পারতেন।
১৯১৪ সালে কুমারচন্দ্র কলকাতার বালীগঞ্জ স্টেশনের কাছে প্রতিষ্ঠিত সুবিখ্যাত বিদ্যালয় জগবন্ধু ইনস্টিটিউটে বাংলা শিক্ষকের পদ পেলেন।এই ধরণের সুযোগ একটা প্রত্যন্ত গাঁয়ের অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তানের ক্ষেত্রে বিরাট জয়।
যখন কুমার গ্রামে মাকে দেখতে এলো,তখন মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই লক্ষ্মীদেবী প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন,কী বাবা,এবার কচুরিপানা একটু একটু সরে যাচ্ছে তো?
কুমার মৃদু হেসে বলে উঠল,হ্যাঁ,মা, কোনোদিন সেই পুকুরের জল পরিষ্কার করার কথা ভুলব না।

তা তুই তো কলকাতায় চাকুরি করবি,থাকবি কোথায়? 

তা তো ঠিক হয়নি

তাহলে?

পাশে দাদা দেবেন বসেছিলেন, তিনি কুমারের পড়াশোনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। তার ভাই কলকাতার বড় স্কুলের মাস্টার হয়েছে, আহ্ এ যে কী বুক ভরা খুশির খবর।সে গাঁয়ের মধ্যে কাউকে বাদ রাখেননি, ভাইয়ের এমন সাফল্যের কথা।তিনি বলে উঠলেন,যা বাবা! মা,তুমিও যেমন,যেখানে চাকুরী পেয়েছে, সেখানেই ঠিক থাকার জায়গা জুটে যাবে

কুমার মাথা নাড়ল।
তারপর কী যেন চিন্তা করে বলল,কিন্তু দাদা,এটা কি ঠিক হচ্ছে?তুমি একা একা এভাবে খেতে পারলে? 

দেবেন অবাক। একা একা কী খাওয়ার কথা বলছে, তিনি বুঝতে পারলেন না!

কী বলছিস তুই? 

কী বলছি,এই যে আমি ঘরে না থাকাতে তুমি দিনের পর দিন মায়ের হাতের ছানার ঝোল খেলে,সেটা কী ঠিক? ভালো করে জানো, কুমার ভাইটি ঐ একটা ঝোল কী পরিমাণ ভালোবাসে।

দেবেন হেসে বললেন,ও হরি!  এই ব্যাপার,তারপর মায়ের দিকে ঘুরে বলে উঠলেন,মা তুমি আজ এমন ছানার ঝোল রাঁধো আর তাতে এতো জল দিও, যাতে কুমারকে গামছা পরে ঝোলে নামতে পারে!

লক্ষ্মীদেবী হেসে বললেন,দোর পাগল,পারিস বটে! ঠিক আছে, আজই রাঁধব, তবে বাবা কুমার তোর পড়াশোনার কী হবে? সেটা তো শেষ হল না!

সত্যি তাই,সারা রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে আমিও সেকথা ভাবছিলাম বউঠান, এই কথা বলতে বলতে গৃহের উঠোনে এসে দাঁড়ালেন প্রধান শিক্ষক ক্ষীরোদচন্দ্র। তাঁকে দেখেই কুমার উঠে গিয়ে প্রণাম করল,বলল,মাস্টারমশাই আপনি? কেমন আছেন?

ভালো আছি খুব,আনন্দেও,কিন্তু চিন্তা হচ্ছে, তুমি এখন কলকাতার নামকরা বিদ্যালয়ের মাস্টার, তোমার সঙ্গে কী দুদণ্ড কথা বলতে পারব!

কী বলেন মাস্টারমশাই,আমি আপনার কাছে সেই ছোট্ট কুমারই আছি,আপনার অনুগত ছাত্র 

বাহ্ বেঁচে থাক বাপ,সত্যিকারের বড় হও

দেবেনও প্রণাম করে একটা মাদুর পেতে দিল।

ক্ষীরোদচন্দ্র তাতে বসলেন।লক্ষ্মীদেবী লেবুর সরবত এনে সযত্নে সামনে রাখলেন।সেই সরবত সম্পূর্ণ শেষ করে ক্ষীরোদচন্দ্র আবার প্রশ্ন করলেন,কী কুমার উত্তর এলো না যে! তোমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার কী হবে?

আমি পড়ব মাস্টারমশাই,পড়াশোনা বন্ধ হবে না

এই তো চাই, আগে নিজেকে গড়ো,তারপর ছাত্র গড়বে,মনে রাখবে, 

"বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদবেদোভয়ং সহ।
অবিদ্যা মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যায়াহমৃতমশ্নুতে।।

কী ঠিক বললাম তো?

কুমার মৃদুকণ্ঠ অর্থটা আওড়ে নিল," অর্থাৎ যিনি বিদ্যা ও কর্ম এই উভয়কেই একই জীবনের অনুষ্ঠেয় বলে জানেন তিনি অবিদ্যার মাধ্যমে মৃত্যুকে অতিক্রম  এবং বিদ্যার দ্বারা অমরত্বের অনুভূতি লাভ করেন।

বাহ্, অপূর্ব, বলে উঠলেন ক্ষীরোদচন্দ্র। তারপর কুমারের মাথায় হাত রেখে বললেন,বউঠান,এই ছেলে আপনার ধুলোবালি দিয়ে গড়া নয়, একেবারে খাঁটি এঁটেল মাটি দিয়ে গড়া,একটা কিছু মূর্তি একদিন ফুটে উঠবেই।

ঘোমটার আড়াল থেকে খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন লক্ষ্মীদেবী। 

সত্যি, এই দিনগুলো ঠাকুরদাস দেখে যেতে পারল না!খুব কষ্ট হয়, ঐরকম দরাজ বুকের লোক গাঁয়ের পর গাঁ খুঁজলে পাওয়া যাবে না।

লক্ষ্মীদেবী চোখটা মুছে গৃহের ভেতরে চলে গেলেন।

ক্ষীরোদচন্দ্র একটু থামলেন।তারপর দেবেনকে বললেন,আমার কথায় তোমার মা বোধহয় দুঃখ পেলেন,আমি আসলে এই আনন্দের দিনে ঠাকুরদাসকে বড় মনে করছিলাম।

না, না মাস্টারমশাই,সে ভাবনা আমাদেরও, এই তো কুমার বলছিল

বাবার খুব ইচ্ছে ছিল,বাসুদেবপুর গ্রামে একটা বড় বিদ্যালয় স্থাপনের,তাতে শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও পড়াশোনা শিখবে,সে ইচ্ছে পূরণ হল না!

বলল কুমার।

ক্ষীরোদচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,এ কি বলছ কুমার,কেন ইচ্ছে পূরণ হবে না,তুমি তোমার বাবার ইচ্ছে পূরণ করবে,আমি বলছি,তুমিই একদিন এই অপূরনীয় স্বপ্ন সার্থক করবে।এমন বিদ্যালয় গড়বে,যেখানে শুধু পড়াশোনা নয়, প্রতিটি ছাত্রছাত্রী যেন হাতের কাজ শেখে,প্রত্যেকে স্বনির্ভর হতে পারে।করবে তো কুমার?

কুমার আবার এগিয়ে এসে মাস্টার মশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শুধু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

ক্ষীরোদচন্দ্র তারপর তাঁর চটের ঝোলা থেকে একটা বই বের করে কুমারের হাতে দিয়ে বললেন,আমাদের মতো পরাধীন দেশের হতদরিদ্র জাতির জন্য একটা বই লিখেছেন এক কবি।এবং তুমি কি জানো,তিনি সেই বই লিখে বাংলায় নয়, ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র এশিয়ায় মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

হ্যাঁ,জানি।

সেই কবির বই,গীতাঞ্জলি, তোমাকে উপহার দিলাম,গরীব মাস্টারের এ-র বেশি তো সাধ্য নেই বাবা

একি বলছেন!  মাস্টারমশাই,আপনি যদি এক মুঠো ধুলোও আমাকে আশীর্বাদক হিসেবে হাতে তুলেন দিতেন, তাই আমি মাথায় করে রেখে দিতাম

আহ্ একি কথা শোনালে কুমার,এই জন্য তোমাকে বড্ড ভালোবাসি, মানুষের মতো মানুষ হও, তুমি যেন নিজেই একটা পথ হয়ে উঠতে পারো।বলেই মাস্টারমশাই গৃহ থেকে ধীর পায়ে চলে গেলেন।
দেবেন এগিয়ে গেলো।

কুমার 'গীতাঞ্জলি' বইটি হাতে নিয়ে সেই কবির নাম,'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' তার ওপর হাত বোলালেন।একটা দারুণ গর্ব ও আনন্দ অনুভব হল।তারপর ঘরের ভিতর ঢুকে কুমার পিতার সাদাকালো ছবির নিচে গিয়ে দাঁড়াল এবং গীতাঞ্জলি খুলে  পড়তে লাগল

"আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাইও চোখের জলে।।
নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলই করি অপমান
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাইও চোখের জলে।। "

ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments