জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-১৩/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

পর্ব ১৩

বিয়ে আমার কিছুতেই পিছন ছাড়ছিল না, সর্বত্র তাড়া করে ফিরত, এমন কী  মেলাপ্রাঙ্গণ পর্যন্ত। দেউলের বেদীতে যখন বসেছিলাম, হঠাৎ দেখি আমার পরিচিত একজন (রাজবাড়ির) আর একজন অপরিচিত যুবককে আমার দিকে আঙ্গুল  বাড়িয়ে কী যেন বলছেন। কতজনই তো দ্যাখে, তাই ও নিয়ে কিছু ভাবিনি।  কিন্তু ভাবতে আমাকে হল। ঝাড়গ্রামের রাজপরিবারের সঙ্গে আমদের গ্রামের রাজপরিবারের আত্মীয়তা রয়েছে। সেইসূত্রে কেউ একজন তাঁর এক অবিবাহিত বন্ধুকে(মুসলিম) সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। সেই যুবককেই দূর থেকে আমাকে দেখানো হচ্ছিল। পরদিন বাবাকে সবিস্তারে জানানো হয়, অবস্থাপন্ন বাড়ির শিক্ষিত  ছেলে। ভাল চাকরিও করে। আমাকে ওঁর পছন্দ। এদিকে মামাবাড়ি  থেকেও চিঠি আসে, সেই পাত্রপক্ষ প্রথমে কিছু দাবি করে থাকলেও এখন তাঁদের কোনও কিছু দাবি নেই। উপরন্তু তাঁরা হিরের গহনা দিয়ে তাঁদের বৌমাকে সাজিয়ে নিয়ে যাবেন। একটা কথা বলা হয়নি, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই বাড়িতে আমাকে শাড়ি পরতে হত। বাবা খড়কুশমা বাজারের সাহাদের দোকান থেকে একখানি ডুরেশাড়ি কিনে দিয়ে ছিলেন। দাম ছিল ১৪ টাকা। ব্লাউজের দাম ৩ টাকা। 
    এই রাজপরিবারেই জ্ঞাতি পছল সিং( ছত্রধারী সিংহ দেব) শিক্ষকতা করতেন কেশপুর থানার ধলহারা গ্রামের পাগলিমাতা হাইস্কুলে। এখানে ওনার শ্বশুরবাড়িও। তবে মা, স্ত্রী ও দুইছেলে গ্রামে নিজেদের বাড়িতেই থাকতেন। বড়দা  ওঁদের দুই ছেলেকে টিউশন পড়াত। ধলহারার পাশের গ্রাম দোগাছিয়ার ওয়ারিশ  খানের বড়ছেল সাজাহান খানও এই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। স্কুলের সেক্রেটারি বাড়ি গিয়ে ডেকে এনে এই চাকরি দিয়েছিলেন। উনি এই স্কুলেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন এবং প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম হতেন। এই স্কুল থেকে উনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই ভর্তির বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ওনার মেসোমশাই শওকত শাহ্‌। সমাজের ওপর তলার মানুষজনদের সঙ্গে ওনার  ওঠা বসা ছিল। উনি তখন বিভিন্ন মামলার রায়ের সময় জুরি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। 
  যাইহোক, সাজাহান খান কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ার পর সহপাঠীরা জিজ্ঞেস করত, তোমারা বাবা কোথা থেকে বদলি হয়ে এসেছেন? উনি কী আর উত্তর  দেবেন? যা সত্যি তাই বলতেন। ওনাকে গাইড করার মত কেউ ছিলেন না। নিজে যা ভাল মনে করতেন, সেটাই করতেন। ওনার ঐচ্ছিক বিষয়ে জীবন বিজ্ঞান ছিলনা বলে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাননি। মেদিনীপুর কলেজে বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করে বি এস সি পরীক্ষা দিয়ে উনি টিউশন পড়াচ্ছিলেন আর রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেইসময় পাগলিমাতা স্কুলের সেক্রেটারি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ওনাদের বাড়ি এসে ওনার বাবা ওয়ারিশ খানকে বলেন, খান সাহেব, একদিন আপনার ছেলেকে স্কুলের বেঞ্চ দিয়েছিলাম। আজ ওকে চেয়ার দিতে চাই। আপনার ছেলেটিকে আমাদের দিন। আরো দুটি স্কুল থেকেও উনি ডাক পেয়েছিলেন। ধলহারার স্কুলটি কাছে। এই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তাছাড়া বাড়ি বয়ে  ওনারা ডাকতে এসেছেন। তাই এই স্কুলেই বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্কুলে গিয়ে দেখেন, বেশ কয়েকজন ছাত্র ওনার থেকেও বয়সে বড়। ওনার বয়স তখন ১৮/১৯ হবে।
      ওনার শিক্ষকতা করার মোটেও ইচ্ছে ছিলনা। ওনার স্বপ্ন ছিল আই,এ,এস বা ডবলু, বি, সি, এস অফিসার হওয়ার। তার জন্য বইপত্র কেনা ছাড়াও অন্যান্য খরচের কথা ভেবে চাকরিটা নিয়েছিলেন। কারণ ওনার পরিবার সম্পূর্ণ কৃষি নির্ভর। ফসল বলতে শুধু ধান। এই ধান বিক্রি করে সুচ থেকে লাঙ্গলের ফাল, সবই কেনা হত। সেই জায়গায় পড়ার খরচ বাড়ি থেকে দেওয়া সম্ভব ছিল না। পরীক্ষার পর মাত্র কয়েক মাস বাড়িতে বসে থাকায় ওনার বাবা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কী আর করব? জানব একটা খোঁড়া ছেলে ঘরে বসে খাচ্ছে। ওনার বাবার কাছে পড়াশোনার বিশেষ  গুরুত্ব ছিলনা । তবে একেবারেই ছিল না, তা  কিন্তু নয়। তাঁরও দারোগা-পুলিশ, উকিল-মোক্তারদের সঙ্গে দহরম মহরম ছিল। প্রায় তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। বড়ছেলে এসব অহেতুক খরচ পছন্দ  করতেন না। একথা জানতে পেরে বাবা ছেলের ওপর রুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, ও আমার মানসম্মান রাখতে দেবেনা।
      শুধু চাকরির প্রস্তাব আসেনি, চাকরির পর বিয়ের প্রস্তাবও আসতে থাকে। সেইসময় পছলদা(পছল সিং) ওনাকে আমার কথা বলেন। উনি বিশেষ পাত্তা দেন না। কিন্তু পছলদার থেকে ওনার বিষয়ে জেনে আমার বাবা মা আশান্বিত হয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেন। গোপনে আমিও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি। আমি ‘ডব্লিউ বি সি এস’ পরীক্ষা দিলে কী হয় জানতাম না। জানা সম্ভবও ছিলনা। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, এটা কোনো বড় পরীক্ষা। পাশ করতে পারলে ভাল কিছু হবে। তাই আমার আপত্তি ছিলনা। মনে মনে ভাবলাম, বিয়ে না করে আমার রেহাই নেই যখন, তখন এখানেই বিয়ে করব। কিন্তু আমি চাইলেই তো হবে না, ওনার তো  আমাকে পছন্দ হতে হবে? গত শীতে ওনার আমাদের এক দূর সম্পর্কের মামার সাথে আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল, কেন জানিনা শেষ পর্যন্ত আসেননি।

    ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস। আমাদের বাৎসরিক পরীক্ষা চলছে। পছলদা বাবাকে বললেন, সাজাহানবাবু ৫ ডিসেম্বর আপনার মেয়েকে দেখতে আসবেন। কথাটা শুনে বাড়ির সবাই নড়ে চড়ে বসলেন। নতুন করে আশান্বিত হলেন।  ওইদিন আমার বাৎসরিক পরীক্ষার শেষ দিন ছিল। বিকেল চারটের বাসে আমাদের বাড়ির সামনে পছলদার সঙ্গে উনি নামলেন। হ্যারিকেনের আলোয় উনি কী দেখলেন জানিনা, পরদিন বিকেলে আমাকে আর একবার চা দিতে পাঠানো হল। আমি  পড়াশোনা করতে চাই কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বাসের সময় হয়ে গেছে, উনি চলে যাবেন। আমার কন্যাদায়গ্রস্থ বাবা তাঁর মেয়েকে পছন্দ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, উনি বললেন, চিঠি লিখে জানাবেন। উনি চলে যাওয়ার পর বাবা পছলদাকে বললেন, ওর মনে হয় বেবিকে পছন্দ হয়নি। পছন্দ না হলেই তো পাত্রপক্ষ এভাবে এড়িয়ে যায়। পছলদা বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, না না তা কেন হবে? পছন্দ  না হওয়ার কারণই নেই।
    কয়েকদিন পর ওনার চিঠি এলো। লিখেছেন, মেয়ে আমার পছন্দ, কিন্তু ও  একেবারেই ছেলেমানুষ, তাছাড়া নিদেনপক্ষে একটা পাশ তো চায়? ওর স্কুল  ফ্যাইনাল পরীক্ষা দিতে এখনো দু’বছর সময় লাগবে। বিয়েটা স্কুল ফ্যাইনাল পরীক্ষার পর হবে। এখন বিয়েটা হয়ে গেলে আমার বাড়ি থেকে বাড়ির বৌকে আর পড়তে দেবেনা। এদিকে আমার বাড়ির কেউ এই প্রস্তাবে রাজি নন। কিছুদিন পরে উনি পছলদার হাতে একটা অ্যাটাচিতে দু’খানা শাড়ি, একখানা সোয়েটার, কিছু প্রসাধন সামগ্রী, একটি রিষ্ট ওয়াচ, চিঠি লেখার প্যাড ও একটি দামি কলম ভরে দিয়ে পাঠালেন। আমার তখন নতুন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আমি শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়া শুরু করলে একজন বাদে এক এক করে ক্লাসের সব মেয়েই শাড়ি পরে আসা শুরু করল। তবে আমার মত বিভিন্ন ধরণের শাড়ি নয়, ওরা লাল  ইঞ্চিপাড়ের সাদা শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরে আসত। নিচু ক্লাসেও দেখতাম  বেশিরভাগ মেয়ে একটা ফ্রক পরেই সারা সপ্তাহ ক্লাস করত। মাসের পর মাস ওটাই পরত। স্কুলে খুব যে ভাল পড়াশোনা করতাম, তা নয়। তবে আমার অন্যান্য গুণগুলির জন্য প্রধান শিক্ষক শরৎচন্দ্র পাল মহাশয় ও অন্যান্য শিক্ষকেরা আমাকে বিশেষ নজরে দেখতেন। আমরা ছেলেদের সঙ্গে খুব একটা মিশতাম না। মেয়েরা মেয়েদের মত থাকতাম। জানিনা আমার মধ্যে কী ছিল, সবাই আমার  সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইত। স্কুলের বড় দিদিরাও আমাকে ‘তুমি’ করে কথা বলত। কোন মাস মনে নেই, তবে এই বছরের(১৯৭১) শুরুর দিকেই এক রবিবার স্কুল  থেকে আমাকে ডাকতে পাঠানো হল। আমি তো ভেবে পেলাম না আমাকে কেন রাধারমণ স্যার(সহ প্রধান শিক্ষক) ডেকে পাঠিয়েছেন? যাইহোক, স্কুলের পিওন মহিনদার সঙ্গে স্কুলে গিয়ে দেখি, রাধারমণ স্যার আর কয়েকজন উঁচু ক্লাসের ছাত্র বসে আছেন। স্যার আমাকে বসতে বললেন। তারপর আসল কথায় এলেন। বললেন, ব্লকে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হচ্ছে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায়  তোমাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। তোমার দাদা শামসুর খুব ভাল বলতে পারত।  তুমিও তো তারই বোন, তুমিও নিশ্চয় পারবে। বিষয় হল ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতি  বর্জনীয়’। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পক্ষে না বিপক্ষে বলতে চাও? আমি বললাম, পক্ষে। উনি তখন, কেন আমি পক্ষে, সেবিষয়ে কিছু বলতে বললেন। সেদিন ওই পর্যন্তই  হল। স্যার বললেন, বিপক্ষে বলার জন্য আর একজনকে চাই।

                                                                                                                ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments