জ্বলদর্চি

আর আর আর (RRR) : ইতিহাসের ক্যানভাসে আঁকা কল্পনার ছবি /রাকেশ সিংহ দেব

আর আর আর (RRR) : ইতিহাসের ক্যানভাসে আঁকা কল্পনার ছবি

রাকেশ সিংহ দেব


পরিচালক - এস এস রাজামৌলি
অভিনয় -জুনিয়র এন টি আর, রাম চরন, অজয় দেবগন, আলিয়া ভাট, রে স্টিভেনসন প্রমুখ।
মুক্তি - ২৫ মার্চ ২০২২

রেটিং -  4/5


 হলিউড যে দেশ বা সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে তার নিজস্ব কোনও পুরাণ নেই। তাদের ইতিহাসেও রয়েছে বিবিধ বৈচিত্র্যের অভাব। তাইতো লোকমুখে প্রচলিত নানা গল্পগাথা, বিভিন্ন কমিক্‌স  সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দিয়ে তারা বানিয়ে চলেছে নিজেদের ‘মিথলজি’। ভারতের পুরাণ আছে, আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস, হাজারো মহাকাব্য এবং বৈচিত্রপূর্ণ বর্ণাঢ্য সংস্কৃতির আবহ। একবাক্যে আমাদের দেশ কাহিনীর দেশ, এখানে 'লার্জার দ্যান লাইফ' গল্প বা চরিত্র কোনও কিছুরই অভাব নেই। আর এই সমস্ত দেশীয় লার্জার দ্যান লাইফ গল্পকে দক্ষিণী পরিচালক এস এস রাজামৌলী বানিয়ে নিয়েছেন তাঁর সিনেম্যাটিক ক্যানভাসের ঐশ্বর্য। 'মগধীরা'-র সেই দুর্ধর্ষ রাজকীয় গল্প দিয়ে তিনি প্রথম চমক দিয়েছিলেন। দর্শকরা যখন পরবর্তী মুভির জন্য অপেক্ষমান ছিল তখন এক সামান্য মাছিকে হিরো বানিয়ে 'ইগা' ছবিতে দর্শকদের মাথা ঘুরিয়ে দিলেন। দর্শকদের চাহিদা যখন তুঙ্গে তখন তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে নিয়ে এলেন 'বাহুবলী'। ভারতীয় সিনেমাকে তিনি দেখালেন সত্যিকারের লার্জার দ্যন লাইফ মুভি। কত রেকর্ড গড়লেন কত ভাঙলেন! এস এস রাজামৌলি হয়ে উঠলেন বক্স অফিসের ট্রেন্ড সেটার। সেই রাজামৌলি স্যার   ‘বাহুবলী’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির পরে তাঁর নতুন ছবি ‘ট্রিপল আর’-এ তিনি ফের তুলে ধরলেন ভারতীয় গল্পের জয়গাথা। তবে এ বার নিখাদ ফ্যান্টাসি নয়। তার সঙ্গে মিশিয়েছেন দেশের পরাধীনতার ইতিহাস, পুরাণ এবং দক্ষিণী অস্মিতা। অতীত ভারতীয় ইতিহাসের উপর গড়া তাঁর নিজস্ব কাহিনীর নায়ক বানিয়েছেন দুই প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামী আল্লুরি সীতারাম রাজু আর কোমরাম ভীম কে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বলে জল জঙ্গল জমিনের অধিকার নিয়ে লড়াই করা পরাধীন ভারতের এই দুই প্রণম্য স্বাধীনতা সংগ্রামী কখনও সামনাসামনি মিলিত হননি। কিন্তু রাজামৌলি স্যার তাঁর কাহিনীতে সেটা করে দেখিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দেখিয়েছেন বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অসাধারণ গল্প। 


মুভিতে দেখা যায়, ১৯২০ সালের প্রাক্-স্বাধীন দেশের আদিলাবাদের জঙ্গল থেকে আদিম গোন্ড জনজাতির এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় ব্রিটিশ গভর্নর স্কট (রে স্টিভেনসন) এবং লেডি স্কট (অ্যালিসন ডুডি)। তাদের জনজাতির মেয়ে মাল্লীকে জঙ্গলে ফিরিয়ে আনতে ছদ্মবেশে দিল্লি পাড়ি দেয় কোমরাম ভীম (জুনিয়র এন টি আর)। গোন্ড সম্প্রদায়ের নেতা সহজ সরল ভীমের দুই বাহুতে ভীমের মতোই বল। এদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়কে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে উত্তাল তৎকালীন দিল্লি। হাজার হাজার উন্মত্ত জনতার মধ্য থেকে একজন নেতাকে ধরে হাজির করতে বলে ব্রিটিশ আধিকারিক। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্তব্যরত সীতারামা রাজু ওরফে রাম (রাম চরণ) একাই হাজারের ভীড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই অসাধ্য সাধন করে। রামারাজুকে একদিকে যেমন ব্রিটিশ পুলিশ সম্মান করে তেমনই ভয়ও পায়। আবার সেই রামারাজুকেই নেটিভ হওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে হেয়ও করা হয়। মাল্লীর খোঁজে বেরিয়ে ভীম ইংরেজ অফিসারদের আক্রমণ করে বসে। ভীমের উপস্থিতি টের পেয়ে ইংরেজ সরকার তাকে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়। জংলি বাঘ ভীমকে ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয় পুরুষ সিংহ রামকে। এদিকে একে অপরের সঙ্গে অচেনা দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে বন্ধুত্বপূর্ণ ভ্রাতৃত্ববোধ। কি হবে এবার? তারা কি নিজেদের কর্তব্য পূরণ করতে সক্ষম হবে? গল্প শুধুমাত্র এটুকুই নয়। পরাধীন ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকার ব্রিটিশদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার সশস্ত্র লড়াই দেখানো হয়েছে।


  তবে এবারে যেন রাজামৌলি স্যার তাঁর মুভিতে বাহুবলীর মতে টানটান ভাব আনতে পারলেন না। ছবির দৈর্ঘ্য আর একটু ছোট হলে টানটান ভাবটা বজায় থাকত। যার ফলে চিত্রনাট্যে বহু দুর্বলতা চোখে পড়ে। যেমন, দুই নায়কের মধ্যে জোরালো বন্ধুত্ব দেখাতে একটু বেশিই সময়ই নিয়ে ফেলেছেন রাজামৌলি। আলিয়ার চরিত্রটি এত কম সময়ের জন্য পর্দায় আসে যে দর্শকদের মনে হতেই পারে আলিয়া ছবিতে না থাকলেও কোনও সমস্যা হতো না। অজয় দেবগণ অল্প পরিসরে বেশ ভাল। অলিভিয়া মরিসের অভিনয়ও নজর কাড়বে। তবে এই মুভিতে যেন জীবনের সেরা অভিনয়টা করলেন জুনিয়র এন টি আর। মাল্লীকে খোঁজার সময়ে তাঁর চরিত্রের যে নরম মানবিক দিক দর্শকদের সামনে এসেছে তা যেমন তারিফযোগ্য, তেমনই মন ছুঁয়ে যায় রামারাজুর জন্য তাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। VFX-ও তেমন আহামরি কিছু নয়। বেশ কিছু জায়গায় তা বেশ অপরিণত লাগে। এই ছবির একটা বড় প্লাস পয়েন্ট সেন্থিল-এর ক্যামেরার কাজ। তবে হ্যাঁ, গল্প যেমনই হোক, ঝকঝকে উপস্থাপনায় এই ছবি বসিয়ে রাখে দর্শকদের। শেষমেশ বলা যায়, ছবি দেখতে বসে বার বার ‘বাহুবলী’র তুলনা আসবেই। আর এটাই পরিচালক রাজা মৌলির কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেদিক থেকে দেখলে ‘আর আর আর’-এর কপালে লেটার মার্কস না হলেও সম্মানজনক পাশমার্ক জুটে যাবে। তাই সেই তুলনা সরিয়ে রেখে বরং উপভোগ করুন এই দুরন্ত অ্যাকশন প্যাকড পিরিয়ড ড্রামা। মুভির নির্মাতা যেহেতু এস এস রাজামৌলি তাই দর্শকরা পদে পদে সারপ্রাইজড হবেন এটা নিশ্চিত। এককথায় বলা যায় 'আর আর আর' এক বাণিজ্যিক অ্যাকশন ড্রামা যা দর্শকদের সম্পূর্ণ বিনোদন দেবে।


রেটিং

5 - অসাধারণ 
4 - বেশ ভালো 
3 - ভালো 
2 - দেখতে পারেন 
1 - না দেখলেও চলবে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments