জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-১৪/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ১৪

এদিকে আমার বিয়ে নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। আবুকাকা ও আরও ২/১ জন বললেন, ওই কয়েকটা জিনিস পাঠিয়েছে বলে ওর ওপর ভরসা করে মেয়েকে দু’বছর বসিয়ে রাখা বোকামি হবে। তখন যদি মত বদলে যায়? বিয়ে না করে? তখন কী হবে? ওই কটা জিনিস বড়লোকের ছেলের হাতের ময়লা। তখন এই সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা শুরু হল।

    বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমার বিপক্ষে বলার জন্য রামকৃষ্ণ নামে একটি ছাত্রকে ঠিক করা হল। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে গড়বেতা হাইস্কুলে। রিক্সায় করে আমি, রামকৃষ্ণ আর আমার ভাই মনি গেলাম। আমাদের সঙ্গে সাইকেলে গেলেন ইংলিশের শিক্ষক শীতাংশু স্যার। আমার সঙ্গে স্কুলের মেট্রন মায়াবৌদির যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু একজন ছাত্রীর জন্য মেট্রনকে পাঠিয়ে দিলে বাকি ছাত্রীদের অসুবিধা হবে। তাই বাবাকে বলে আমার ভাই মনিকে সঙ্গে পাঠানো হল। ভাইও সেই বছরই এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
  তখন সমাজ ব্যবস্থা আজকের মত এতখানি উদার ছিল না। তাই আমার সঙ্গে  আমার ভাইকে পাঠানোর প্রয়োজন হয়েছিল। সম্ভবত দ্বিতীয় হয়েছিলাম। প্রথম হয়েও লাভ হতনা। কে নিয়ে যেত আমাকে জেলা প্রতিযোগিতায়? কিছুদিন পরে পুরস্কার হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তর লেখা একটি বই ও ইংলিশে লেখা একটি সার্টিফিকেট স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমাকে  অফিসঘরে ডেকে পাঠালে গিয়ে দেখি পছলদা স্যারের সঙ্গে গল্প করছেন। সার্টিফিকেটে প্রথম নিজের নাম ইংলিশে টাইপ করা দেখে ভীষণ আনন্দ হল। স্যার কী বলেছিলেন, মনে নেই। আমি দুজনকে প্রণাম করে বেরিয়ে আসি।

    আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী পূর্বে মেয়েদের ক্ষেত্রে মানসিকতা অন্য রকম ছিল। সেখানে আমার মা ও আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয়য়ের ভাবনায় কোনও ফারাক ছিল না। মা আমাকে কোনদিন ছোটাছুটি খেলা খেলতে দিতেন না। হাত-পা ভেঙ্গে বা ছোড়ে যেতে পারে। কিন্তু যেটা ঘটার সেটা তো ঘটবেই। একদিন মা পাশের বাড়িতে গেছেন। আমি আর আবুকাকার মেয়ে মমতাজ একটা বাঁশ ধরে দোল খাচ্ছিলাম। হঠাৎ হাত ফস্কে ছিটকে পড়লাম উঠোনের শক্ত মাটিতে। মমতাজ ভয়ে পালিয়েছে। তারপর লোকজনের ভিড়। হাতের ওপর জল ঢালা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলনা। গ্রামে ভাঙ্গা হাত-পা সেট করার জন্য লোক থাকত। তাকেই ডেকে নিয়ে আসা হল। তিনি টেনে টুনে হাড় সেট করে জড়িবুটির  চাপান দিয়ে বেঁধে দিলেন। কিছুদিন পর চাপান খুলে বাবা রোজ সকালে পুরনো ঘি দিয়ে মালিশ করে দিতেন। এভাবেই হাত ঠিক হয়ে গেল। এখন আর মনেও নেই হাতের কোন জায়গাটা ভেঙ্গেছিল।
      শাড়ি পরে স্কুল যাওয়া শুরু করতে প্রায়দিন শাড়ির কুচি পায়ে আটকে যেত। আমদের স্কুলের দুই পাশে দুটো রাস্তা। একটা রাস্তা জঙ্গল থেকে উত্তর দিকে ভেঙ্গে সিংপাড়া হয়ে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে স্কুলের পিছন দিয়ে খড়কুশমা বাজারের ভিতরে চলে গেছে। আর জঙ্গলের ভিতরের সোজা রাস্তাটি স্কুলের দক্ষিণ পাশ দিয়ে এসে স্কুলের ত্রিকোনা প্রাচীরের কোনে এক সঙ্গে মিশেছে। কয়েক মিটার এগিয়ে আবার রাস্তার একটি শাখা মণ্ডল পাড়ার ভিতর দিয়ে চলে গেছে। আমাদের  স্কুলের দক্ষিণ দিকের গেট থেকে কয়েক মিটার পিছিয়ে গেলে রাজাদের কাছারিবাড়ি  ,তখন এই বাড়িটি স্কুলের প্রয়োজনে ব্যবহার হত। দুরের ছাত্ররা মেস করে থাকত। ২/১ জন শিক্ষকও থাকতেন। এছাড়া সামনের দুটি রুমে ক্লাসও হত। তখন স্কুলের বেশি ক্লাসরুম ছিলনা। আমাদের সময়ে একটা বহু পুরনো মাটির বাড়ি ছিল আর একটা ছিল পাঁচ ইঞ্চির দেওয়ালের ওপর করগেট টিনের ছাউনি দেওয়া লম্বা একচালা ঘর। আমরা থাকাথাকি একটি দোতলা বিল্ডিঙয়ের কাজ শুরু হয়ে ছিল। তখন নবম শ্রেণি থেকেই ঐছিক বিষয় ভাগ হয়ে যেত। তারজন্য বেশি ক্লাসরুমের দরকার হত। তখন কাছারি বাড়ির রুমগুলি ব্যবহার হত।

      এই কাছারিবাড়ির চারপাশে বড়বড় অনেক আমগাছ ছিল। এখানেই ছিল বাসস্ট্যান্ড। গড়বেতার ময়রাকাটা থেকে খড়কুশমা বাজার পর্যন্ত রাস্তায় পিচ ঢালা হলে বড় বড় বাস চলতে শুরু করে। এই বাস খড়কুশমার ঘিঞ্জি বাজারে ঢোকা  সম্ভব ছিলনা। তাই কাছারিবাড়ি সা্মনে বাসস্ট্যান্ড ছিল। ওখান থেকে বাস আবার ফিরে যেত। চানাচুরআলা, আইসক্রিমআলা ২/১ জন ওখানেই বসত। ওই আমগাছের নীচে মাঝে মাঝে যাযাবররা অস্থায়ী সংসার পাতত। অনেক সময় আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের রান্না দেখতাম। ওখানে বড় বড় কিছু পাথর ছড়ানো ছেটানো ছিল। জায়গাটাই পাথুরে। একদিন আমি আর এক সহপাঠী  অনিতা ওখানে চানাচুর কিনতে গিয়ে শাড়িতে পা আটকে পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আঙ্গুল কেটে রক্ত পড়তে লাগল। আনিতা বলল, অফিসঘরে চল, ডেটল লাগিয়ে দেব। অনিতা একটু বাচাল প্রকৃতির ছিল। অফিসঘরে গিয়ে পড়বি তো পড়, একেবারে হেড স্যারের সামনে! উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার পা থেকে রক্ত পড়তে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী করে পা কাটল? অনিতা বলে উঠল, স্যার ও আমগাছে চড়ছিল। ব্যস, স্যার খুব বকলেন, জানো না ?  মেয়েদের শো-কেশে সাজানো কাচের পুতুলের মত থাকতে হয়? হ্যাঁ, অর্ধ শতাব্দী পূর্বে বাড়িতে, স্কুলে, সর্বত্র মেয়েদের এভাবেই দেখা হত।

    ১৯৭১ আর ১৫ জানুয়ারি আমাদের ছোটভাই পাপু জন্ম হয়। প্রত্যেক বার বড়মাসি আসত মাকে দেখাশোনা করার জন্য। এবার মাসি আসেননি বা মাসিকে ডাকা হয়নি। মেজদি এসেছে। তবে আমারও দায়িত্ব বেড়েছে। ভেবেছিলেম, এবার সরস্বতী পুজোয় স্কুলে যাওয়া হবেনা। কিন্তু পুজোর দিন সকালেই আমার আর এক সহপাঠী দেবযানী এসে বলে, স্কুলে চল, তোকে আলপনা দিতে হবে। স্যরেরা ডাকতে পাঠালেন। আমি তৈরি হয়ে বের হলাম। রাস্তায় যেতে যেতে দেবযানী বলল, একটা জিনিস দেখতে যাব চল,ফিরে স্কুলে ঢুকব। ও আমাকে কী দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে, কিছু বলল না। খড়কুশমা বাজারটা কেমন যেন থম মেরে আছে। কিছু বুঝলাম না। আমাকে বাজার পার হয়ে চৌধুরী পাড়ার দিকে নিয়ে গেল। দেখলাম একজনের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। দশাশ্বয় চেহারার লোকটাকে কী নির্মমভাবে মেরেছে! পাগুলো উল্টো দিকে ঘুরে গেছে, একটা বল্লামের ফলা মাথার  তালু দিয়ে ঢুকে চিবুকের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। শুনলাম ও নাকি মাছ চুরি করতে এসেছিল। পরে অবশ্য জানা যায় পাশের গ্রাম জেমুয়াতে ওর বাড়ি। ভোরবেলা জেলে ডাকতে এসেছিল নিজের পুকুরে মাছ ধরার জন্য। ফলে ওই পাড়ার বহুলোকের নামে পুলিশ কেস হয়।

      সে যাইহোক, সেদিন স্কুলে পৌঁছে প্রতিমার সামনে চক দিয়ে আলপনা আঁকতে সুরু করলাম, একজন দিদি তার ওপর পিটুলিগোলা আঙ্গুল দিয়ে বোলাতে লাগল।

    আমাদের বাড়িতে সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল এখন দোয়াখানি  করে, মানে মোল্লা দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে রেখে দেওয়া হবে, দুবছর পর অনুষ্ঠান করে আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে। উনি রাজি হলেন। বল্লেন, উনি ওনার গ্রামের মাদ্রাসার দুজন মৌলানাকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। এঁদের একজনের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর, আর একজনের আমাদের এইপাশে। আসার দিন পূর্ব মেদিনী পুরের  মৌলানাকে পাওয়া গেলনা। তাঁর নাকি বাড়ি থেকে খবর এসেছিল, তিনি ভোরবেল  বাড়িচলে গেছেন। এদিকে আমাদের এলাকায় যার বাড়ি, বাবার পরিচিত সেই মৌলানা লোক মারফৎ চিঠি পাথিয়েছেন। লিখেছেন অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারছেন না। আসলে ওনারা আমার ভাবি শ্বশুরমশাইয়ের ভয়ে আসেননি। উনি  ছিলেন গ্রামের ‘মহলদার’। তখন মহলদারের অনেক ক্ষমতা ও সম্মান ছিল। উনি একজন দক্ষ বিচারক ছিলেন। আশপাশের গ্রাম থেকেও ডাক পেতেন বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য। তাঁর ছেলের লুকিয়ে বিয়ে দিলে শেষপর্যন্ত চাকরিও চলে যেতে পারে।

    কী আর করা যাবে? আমাদের গ্রামে যে মোল্লা বিয়ে পড়ান, তাঁকেই ডাকতে হবে। খড়কুশমা বাজার থেকে নতুন শাড়ি জামাকাপড় কেনা হল। দুজনকেই হলুদ লাগানো হল।ক্ষীর(পায়েস)খাওয়ানো হল, তারপর বিয়ে পড়ানো হল। এদিকে মেজদির ভাশুরকে ডাকা হয়েছে কাবিলনামা করার জন্য। উনি এতক্ষণ সব মেনে নিয়েছিলেন। এবার বললেন, আমার বাবা মায়ের জন্য কিছু বাকি রাখুন? তখন কে কার কথা শোনে। কাবিলনামাও হয়ে গেল। এরপর যেটা হল, তারজন্য আমরা দুজনের কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। রাতে সব ঝামেলা মিটতে, মেজদি আমাকে ওনার রুমে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। সে রাতটা আমরা দুজনে গল্প করেই কাটিয়েছিলাম।
                                            (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments