জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১৯ /প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১৯

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী অখণ্ডানন্দ

স্বামী অখণ্ডানন্দ মহারাজের (গঙ্গাধর মহারাজ) হাত ধরেই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ দুর্ভিক্ষ-সেবাকার্যের সূচনা। এই বিষয়ে ‘‌শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থটিতে অতি প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়েছেন গ্রন্থকার স্বামী গম্ভীরানন্দজী। বর্ণনাটি এইরকম--“...পদব্রজে মুর্শিদাবাদ গমনকালে তিনি পথে দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ পরিচয় পাইলেন। ক্রমে কালীগঞ্জ ও পলাশী হইয়া দাদপুর আসিয়া যাহা দেখিলেন, তাহা স্বয়ং এইরূপে বর্ণনা করিয়াছেন--খুব সকালে গঙ্গায় হাত-মুখ ধুইয়া বাজারের দিকে আসিতে পথে দেখিলাম অতিশয় ছিন্ন মলিন বস্ত্র পরিহিতা প্রায় চৌদ্দ বছরের একটি মুসলমান মেয়ে হাপুস-নয়নে ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতেছে। তাহার কাঁকালে একটি মাটির কলসী; তলাটি খসিয়া পড়িয়াছে। আমাকে দেখিয়া সে বলিল, বাড়িতে জল তুলিবার দ্বিতীয় পাত্র নাই। মা আমাকে মারবে, সেই ভয়েই কাঁদছি। আমি তাহাকে লইয়া গিয়া দুই পয়সার একটি মাটির কলসী কিনিয়া দিলাম এবং দুই পয়সার চিঁড়ে-মুড়কিও দেওয়া হইল। (সঙ্গে আমার মাত্র একটি সিকি অবশিষ্ট ছিল)। আমার তিন আনা পয়সা ফেরত লইতে না লইতেই সমীপবর্তী মরাদীঘি-গ্রামের প্রায় দশ-বার জন ছোট-বড় ছেলে-মেয়ে দোকানে আসিয়া আমার কাছে সকাতরে ভিক্ষা চাহিয়া বলিল যে, তাহারাও অকালের জন্য খাইতে পায় না। আমি তখনই সেই দোকানীকে তিন আনার চিঁড়ে-মুড়কি প্রত্যেককে ভাগ করিয়া দিতে বলিলাম। তাহার পর আমি কপর্দকহীন সন্ন্যাসী।”
দাদপুর থেকে অখণ্ডানন্দজী যতই এগিয়ে যেতে থাকলেন ততই প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন দুর্ভিক্ষের করালমূর্তি। তাঁর অন্তর বিষাদাচ্ছন্ন হল। এমন মনের অবস্থা নিয়েই এই রিক্ত সন্ন্যাসী উপস্থিত হলেন ভাবতা গ্রামে। সেখানে রাত্রিযাপনের পর বহরমপুরের পথে চলতে গিয়ে দেখলেন যে, কে যেন তাঁকে নীচের দিকে টেনে ধরেছে। তিন- চারবার এই ঘটনা ঘটবার পর তিনি ওই অঞ্চলে সেবাকার্যে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কৃতসঙ্কল্প হলেন। দুর্ভিক্ষের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পত্র লিখলেন আলমবাজার মঠে। একসময় দুর্ভিক্ষ শেষ হল। কিন্তু দুর্ভিক্ষের ফলে বহু অনাথ বালক গৃহহারা হয়। এদের দেখে গঙ্গাধর মহারাজের প্রাণ কেঁদে ওঠে। এই সময় তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লেভিঞ্জ সাহেব তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। এইসব অনাথদের নিয়ে আশ্রম গঠনে সরকারি সাহায্যের কথা জানালেন। অখণ্ডানন্দজী ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই কাজে। স্বামী বিবেকানন্দের সম্মতি নিয়ে ১৮৯৭ সালের শেষভাগে দু'টি বালকের দায়িত্ব নিয়ে শুরু করলেন কাজ। পরের বছর মে মাসে দার্জিলিংয়ের আরও চারজন বালক যুক্ত হল। এদের সকলকে নিয়ে তৈরি হল অনাথ আশ্রম। মহুলা নামক স্থানে ভট্টাচার্যদের চালাঘরে। সেখান থেকে সারগাছি গ্রামে চওড়া রাস্তার উপর একটি পুরনো দোতলা বাড়িতে সেটি স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে বর্তমান সারগাছি আশ্রমের নিজস্ব ভূমিতে পাকাপাকিভাবে এটি স্থাপিত হয়। রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের ক্ষেত্রে সারগাছি আশ্রম নানা কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এটিই বেলুড় মঠের প্রথম শাখাকেন্দ্র যেখান থেকে সেবাকার্যের সূচনা, তারিখটি হল ১৮৯৭ সালের ১৫ মে। স্বামী অখণ্ডানন্দজী একবার দরিদ্রের দুর্দশামোচনে স্বামীজীর নির্দেশ চেয়ে পত্র লিখেছিলেন। উত্তরে স্বামীজী লেখেন--“দরিদ্রদেবো ভব, মূর্খদেবো ভব। দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞানী, কাতর-- ইহারাই তোমার দেবতা হউক, ইহাদের সেবাই পরম ধর্ম জানিবে।” স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত প্রীতির সম্পর্ক ছিল, যার মূল হোতা ছিলেন ঠাকুর স্বয়ং। একবার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ৺কালীর নিরামিশ প্রসাদ গ্রহণান্তে ঠাকুরের কাছে এলে ঠাকুর তাঁর হাতে পানের খিলি দিয়ে বলেন,“খা, খাওয়ার পর দুটো একটা খেতে হয়, নইলে মুখে গন্ধ হয়। দ্যাখ, নরেন একশটা পান খায়, যা পায় তাই খায়। এত বড় বড় চোখ-- ভেতর দিকে টান। কলকাতার রাস্তা দিয়ে যায় আর বাড়ি, ঘরদোর, ঘোড়া, গাড়ি সব নারায়ণময় দেখে। তুই তার কাছে যাস।” কলকাতায় ফিরেই ঠাকুরের কথানুযায়ী গঙ্গাধর নরেন্দ্রর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। পরে ঠাকুরের কাছে এলে এই সাক্ষাতের সংবাদ মহা উৎসাহে জ্ঞাপন করলেন। ঠাকুর শুনে খুশি হয়ে বলেন,“খুব যাবি, খুব তার সঙ্গ করবি।”
 অখণ্ডানন্দজীর সেবাকাজে সন্তুষ্ট হয়ে স্বামীজী আলমোড়া থেকে (১৫ জুন,১৮৯৭) লিখলেন, “তুমি আমার লক্ষ লক্ষ আলিঙ্গন আশীর্বাদাদি জানিবে। কর্ম কর, কর্ম, হাম আওর কুছ নহি মাঙ্গতে হেঁ--কর্ম কর্ম কর্ম...। ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম-ধাম সব রসাতলেও যায়, অহোভাগ্যমহোভাগ্যম।...ঐরকম কাজ করলেই আমি মাথায় করে নাচি-- ওয়া বাহাদুর!” স্বভাবতই অখণ্ডানন্দজী প্রভূত থপ্রেরণা পেলেন এই উদ্দীপনাময় পত্রে। মনে হয় অখণ্ডানন্দজীকে উপলক্ষ করে ভাবীকালের সমস্ত নরনারীর প্রতিই যেন স্বামীজীর এই অনুপ্রেরণাময় বার্তা! আবার স্বামী অখণ্ডানন্দজীর কাজের সমর্থন জানিয়ে একটি পত্রে (আলমোড়া,১০ জুলাই ১৮৯৭) স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখছেন--“বহরমপুরে যে প্রকার কার্য হইতেছে, তাহা অতীব সুন্দর। ঐ সকল কার্যের দ্বারাই জয় হইবে--মতামত কি অন্তর স্পর্শ করে? কার্য কার্য --জীবন জীবন--মতে-ফতে এসে যায় কি? ...ঐ যে কাজ, অতি অল্প হলেও বহরমপুর একেবারে কেনা হয়ে গেল--এখন যা বলবে, লোকে তাই শুনবে। ...দয়া আর ভালবাসায় জগৎ কেনা যায়; লেকচার, বই, ফিলসফি-- সব তার নিচে।” 
 ১২৭১ বঙ্গাব্দের ১৫ই আশ্বিন(১৮৬৪ সাল, ৩0 সেপ্টেম্বর) অমাবস্যা তিথিতে, মহালয়ার দিন, স্বামী অখণ্ডানন্দজীর জন্মদিন। পূর্বাশ্রমের নাম গঙ্গাধর গঙ্গোপাধ্যায়। পিতা শ্রীমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়। এই পরিবারের আদি বাড়ি ছিল যশোরে। এখানকার নড়াইল মহকুমার ব্রাহ্মণডাঙা গ্রামে। টোলে অধ্যয়ন করে শ্রীমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় ‘তর্করত্ন’ উপাধি লাভ করেন। শুদ্ধাচারী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। গঙ্গাধরের জন্ম হয় কলকাতার আহিরিটোলায় মাণিক বসু ঘাট স্ট্রিটে এক ভাড়াবাড়িতে। কেননা গঙ্গাধরের জন্মের প্রায় শত বৎসর আগে থেকেই পরিবারটি কলকাতাবাসী হয়েছিল। ১৮৭৭ সালে কোনও এক শুভক্ষণে তিনি কিশোর অবস্থায় প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্য দর্শনলাভে কৃতার্থ হন। এরপর দর্শনলাভ হয় ১৮৮৩ কিংবা ১৮৮৪ সালে। গ্রীষ্মকালের কোনও এক শুভ দিনে, দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর তাকে কাছে বসিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করেন,“তুই আমাকে আগে দেখেছিলি?“ উত্তরে তিনি বলেন,“হাঁ, একেবারে খুব ছেলেবেলায় আপনাকে একবার দীনু বোসের বাড়িতে দেখেছিলাম।” একথা শুনে ঠাকুর কাছে উপস্থিত গোপালদা-কে ডেকে বলেন,“ওহে, শোন শোন, এ বলছে কিনা আমায় খুব ছেলেবেলায় দেখেছিল, উঃ, এর আবার ছেলেবেলায়!”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments