জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন /পর্ব- ১৬ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 
 
পর্ব- ১৬ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)


মলয় সরকার


এখান থেকে বেরোলাম পিছন দিক দিয়ে। ঠিক উলটো দিকেই রয়েছে, অল্প দূরেই আয়া সোফিয়া। মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। বেশ কিছু চেয়ার আছে এখানে, দর্শক, ভক্ত বা মানুষজনের জন্য। আর আছে এক সুদৃশ্য ফোয়ারাকুণ্ড। বেশ বড় এক  গোলাকার জায়গা ঘিরে অনেক সুদৃশ্য ফোয়ারা অনবরত জল ছুড়ে যাচ্ছে পর্যায়ক্রমে সুন্দর ভাবে। রাত্রে বিভিন্ন রঙ্গীন আলো দিয়ে সাজানো থাকে। ভীষণ সুন্দর দেখতে লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও সময় কোথা দিয়ে কেটে যায়। রেলিং এর চারধারে ভিড়ও করেন বহু মানুষ। এখন দিনের আলোয় রঙ ছাড়া ফোয়ারা।এর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে আমরা স্থির করলাম, রাত্রে অবশ্যই আসতে হবে এখানেই। 

 আমরা চলে এলাম কাছেই তোপকাপি প্রাসাদে।এর আগেই সেই বাংলাদেশী দম্পতি বললেন,আর আমাদের সময় নেই। অল্প একটু সময়ই আমাদের দেওয়া ছিল, এখানের জন্য। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, এই তো সবে শুরু করলেন, এর মধ্যেই চলে যাবেন? উনি বললেন , কোন উপায় নেই। এর পরেই প্লেন ধরতে যেতে হবে।

অল্প সময়ের জন্য হলেও পরিচয় হয়েছিল। ছেড়ে দিতে দেখি আমাদের মনটাও খারাপ হয়ে গেল, ওনাদেরও। হায়রে, মানুষের মন, যাকে কোন দিন দেখি নি , হয়ত আর কোন দিন দেখাও হবে না,  কত সহজেই তার প্রতি টান এসে যায় আবার কত সারাজীবন ধরে পাশে নিয়ে চলা মানুষের প্রতিও টান জন্মায় না। 

তোপকাপি প্রাসাদ পর্ব

তোপকাপি প্রাসাদ কাছেই। আমরা গেট দিয়ে ঢুকলাম।

 এর ইতিহাসটা আগে একটু বলে নিই।

১৪৫৯ সালে তৈরী আরম্ভ হয় এই প্রাসাদের। এটিই অটোমান সম্রাটদের প্রধান প্রাসাদ এবং নতুন প্রাসাদ রূপে তৈরী হয়। ধীরে ধীরে এটি এর গুরুত্ব হারাচ্ছিল। কারণ সম্রাটরা অনেক সময়েই এখানে থাকতেন না। ১৮৫৬ সালে সম্রাট আবদুল মেজিদ যখন পুরোপুরি এটি ত্যাগ করে Dolmabahce Palace এ চলে যান এখানকার লাইব্রেরী, টাঁকশাল সব নিয়ে, তখন এটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়। ১৯২৩ সালে অটোমান  সাম্রাজ্যের শেষ হওয়ার পর থেকে এটি মিউজিয়াম রূপেই ব্যবহৃত হচ্ছে।


এখানে বহু মূল্যবান দর্শনীয় বস্তু আছে। এখানে ঢোকার পরেই দেখি, বিশাল এক চত্বর। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বাঁধানো পরিস্কার রাস্তা, সোজা পরের প্রধান দরজার দিকে। এখানে ধারে ধারে ছোট ছোট কক্ষে দর্শনীয় বস্তু গুলি আছে আর মাঝে রাস্তার পাশে রয়েছে বেশ কিছু বড় বড় গাছ এবং দুপাশেই বিশাল ফাঁকা চত্বর।তাতে সবুজ মখমলের মত ঘাস হয়ে রয়েছে।এখানে রয়েছে রাজাদের রাজত্বের প্রতীক চিহ্ণ, (যেগুলি খোদাই করা রয়েছে শ্বেত পাথরের উপর), হারেম, এবং রাণীমহল সত্যিই দেখার মত। তাতে এত সুক্ষ্ম কারুকাজ, আর সোনালী  রঙের বাহুল্য যে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গাইড বললেন, এগুলি আসল সোনার থেকে তৈরী রঙ। সত্য মিথ্যা জানি না। দ্রষ্টব্যের শেষ নেই। সব দেখাও বোধ হয় সম্ভব নয়। চারটি চত্বর আছে পর পর। একটি পেরিয়ে অপরটিতে প্রবেশ করতে হয়। চীনের নিষিদ্ধ নগরীতেও এরকম দেখেছিলাম। এক এক চত্বরে এক এক ব্যবস্থা।


আর হবে না-ই বা কেন! অটোমান সাম্রাজ্যের ৩০ জন সুলতান, মাহমুদ (দ্বিতীয়)  থেকে শুরু করে প্রায় ৪০০ বছর ধরে এই প্রাসাদকে ব্যবহার করেছেন।প্রত্যেকেই কিছু কিছু সংযোজন করেছেন নিজের মত করে। কাজেই এটাও বেড়ে উঠেছে। এতে হাত পড়েছে ইশ্লামিক, অটোমান ও ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের।এতে প্রায় ৪০০০ মানুষ থাকতে পারতেন।


এর মধ্যে প্রথম চত্বরে জনসাধারণের প্রবেশের অধিকার ছিল। এখানে সম্রাটদের প্রয়োজনে নানা কাজের মানুষ আসতেন, বা নানা ধরণের উৎসব সমাবেশও এখানে হত।

এরপর আছে দ্বিতীয় চত্বর। এখানে  বিচারশালা ছিল।মন্ত্রীরা এখানে আসতেন ও সুলতান এখানে মন্ত্রীদের কথাবার্তা, বিচার, আবেদন- নিবেদন শুনতেন। এখানে একটি উঁচু টাওয়ার আছে। সেটাতে নাকি সম্রাট বসতেন।এখানে রয়েছে চীনের দেওয়া সেই প্লেট, যাতে খাবার পরীক্ষা হত। খাবারে কোন বিষ দেওয়া হলে সেই বিষে ওই প্লেট বিবর্ণ হয়ে যেত। এই ভাবে খাবার পরীক্ষা করে সম্রাটরা খাবার খেতেন। এরকমটা মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারীতেও দেখেছি। এখানে নানা জিনিসপত্র রয়েছে। তার মধ্যে  কিছু উপহার পাওয়া , কিছু কেনা।

কত ঘর আর কত মহল যে এখানে রয়েছে, সেগুলো কখন কোন কাজে লাগত, তা  বোধ হয় জানা খুব মুস্কিল।রাজাবাদশার খেয়াল —-

তৃতীয় চত্বরে আছে সেই সব দুর্মূল্য জিনিস, যা হজরত মহম্মদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। তার মধ্যে আমরা দেখলাম, তাঁর একটা জোব্বা, একটা তলোয়ার ও দাঁত। আমি তো তলোয়ারের দৈর্ঘ্য দেখেই ঘাবড়ে গেছি। এত লম্বা যে তলোয়ার, তার ব্যবহারকারী  মানুষটি কত লম্বা ছিলেন! জোব্বাটিও বেশ লম্বা। এই সমস্ত বস্তুগুলি, ইজিপ্ট জয় করার পর সেখান থেকে সংগ্রহ হয়েছিল।হজরত মহম্মদ সম্বন্ধে আমার ধারণা অস্পষ্ট । আমি ভেবেছিলাম, তিনি হয়ত সাধু মানুষ, সাধনা নিয়েই থাকতেন। কিন্তু এত বড় তরোয়াল যাঁর, যিনি এটা চালাতেন, তিনি তো রীতিমত যোদ্ধা ছিলেন সেটা বুঝতে পারলাম। জোব্বাটিও বেশ বড়। অর্থাৎ মানুষটি বেশ লম্বা চওড়া শক্ত সমর্থ মানুষ ছিলেন।সাধু বলতেই যে আমাদের মনে কৃশকায় দীন চেহারার ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে মোটেই সেরকম নয়। অবশ্য তা তো হবেই । পরে জেনেছিলাম, সারা জীবনই এই মানুষটি নাকি যুদ্ধবিগ্রহেই কাটিয়েছিলেন, এবং তিনি তাঁর স্বজাতীয়দের একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন।   

এই তৃতীয় চত্বরেই ছিল সুলতানের নিজস্ব বসবাসের জায়গা। এখানে সবাই আসতে পারতেন না। একমাত্র রাজপরিবারের লোকজন এবং তাঁদের ছাড়পত্র দেওয়া পরিচিত ব্যক্তিরাই এখানে আসতে পেতেন।অথচ আজ সেখানে আমরা স্বচ্ছন্দে ঘুরছি। অনেকেই বারান্দায় বসে আছে, বিশ্রাম করছে । কেউ কেউ সামনের মাঠেও রয়েছে।ইতিহাসের কি বিচিত্র পরিবর্তন!


আমার এই রাজপ্রাসাদ, দুর্গ আর  শ্মশানে গেলে মনের এক বিচিত্র পরিবর্তন বুঝতে পারি। মনটা যেন কেমন একটা উদাস হয়ে যায় । বৈরাগ্যে ভরে যায় মন। মনে হয়, এত তেজ, অহংকার, দর্প, ধনরত্ন, লোভ রক্তপাত সব কিসের জন্য, ক’দিনের জন্য! সত্যিই কেউ কিছু সঙ্গে করে আনে না , কিছু নিয়েও যেতে পারে না। এই তো সব আমার সামনেই পড়ে রয়েছে , এত ধনসম্পদ কত রক্তপাতের ফলে সারাপৃথিবী লুণ্ঠন করে আহরণ করা হয়েছে। আজ তাদের কি পরিণতি। কোথায় আজ সেই রাজছত্র, রাজদম্ভ । তবু এই নিয়মই চলছে আজও সারা বিশ্বে। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা , বলদর্পী দুর্বলের উপর অত্যাচার করবেই এটাই সৃষ্টির চিরন্তন ছবি। 

ফিরে আসি বাস্তবের জমিতে ।এখানে সুলতান পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, নানা সুলতানের ছবি, এবং সব থেকে দামী যে জিনিসটি রয়েছে তা হল একটি বহু মূল্যবান হীরকখণ্ড, যার নাম Spoonmaker’s Diamond । এটি বিশ্বে সম্ভবতঃ আয়তনে চতুর্থ। এ ছাড়াও রয়েছে একটি এমারেল্ড ও হীরক খচিত ছোরা।সেগুলিও দেখে ধন্য হলাম। 

এখানে রয়েছে সম্রাটের বা রাজপরিবারের লাইব্রেরী।এইটি বহু মূল্যবান আঁকা ছবি, সুন্দর ক্যালিগ্রাফী আঁকা, দামী কাঁচ ও জিনিসপত্রে শোভিত। একেবারে প্রথম দিকের লেখা একটি কোরানও এখানে আছে।

এখানে যে পাকশালাটি রয়েছে সেটিও বিশাল। এখানে প্রায় চার-পাঁচ হাজার মানুষের জন্য রান্না হত প্রতিদিন ।এখানে তখনকার রান্নার বাসনপত্র সামগ্রীও রয়েছে দর্শনীয় হিসাবে।

চতুর্থ চত্বরটি হল সুলতানদের প্রমোদকানন বা উদ্যান। এখানের প্রশস্ত চত্বরে তাঁরা রমজানের উপবাস সমাপ্ত করতেন।এখান থেকে পাশের বসফরাসের দিকে চোখ রাখলে মন জুড়িয়ে যায়।কত বড় বড় সাদা উঁচু ক্রুজ চলেছে মরালীর মত ঘন নীল জলে সাঁতার কেটে। কি জানি কেন, বসফরাস আমার ভীষণ ভাল লাগে। সেই ভাল লাগাটাই আমি ছড়িয়ে দিতে চাই আমার প্রিয় জনের মধ্যে। এখান থেকে বসফরাস পাশেই, তবে অনেক নীচে, ঠিক যেমন আমাদের আগ্রা দূর্গ আর পাশের যমুনা নদী।

এই তোপকাপি প্রাসাদের উপর নির্মিত হয়েছে ১৯৬৪ সালে একটি বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র, যার নাম “তোপকাপি” এবং এটিতে মূলতঃ, এখানে যে হীরক ও এমারেল্ড  খচিত মূল্যবান ছোরাটি রয়েছে  সেটির চুরির পরিকল্পনার উপরে নির্মিত। ছবিটি Eric Ambler এর গল্প “ The Light Of Day”  টির উপর ভিত্তি করে Jules Dassin নির্মাণ করেন। বইটি পুরস্কারও পায়। 

এরপর এগোব পরের পর্বে–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments