জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব-৫৩/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব(৫৩)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম

জৈন ও বৌদ্ধধর্ম খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দের আগে সুশৃংখল ধর্মদর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। মহারাজ নন্দ ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য-র (খ্রিঃপূঃ ৩২১-২৯৬) রাজত্বকালে জৈন ধর্মের উথ্থান ঘটে। খ্রিঃ প্রথম শতাব্দে জৈনধর্ম দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর নামে পরিচিতি পায়। পাটলিপুত্রে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দে যে ধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে সিদ্ধান্ত নামে সুপরিচিত জৈন ধর্মের অনুশাসনগুলি গৃহীত হয়। শ্বেতাম্বর শাখার অনুগামীগণ এই অনুশাসনগুলি গ্রহণ করেন। দিগম্বর শাখার অনুগামীগণ এই অনুশাসন গুলি গ্রহণ করেননি। তাদের যুক্তি ছিল আদি জৈন ধর্মীয় নির্দেশাবলী বহু আগেই অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সম্রাট অশোকের (খ্রিঃ ৩০৪- খ্রিঃ পূঃ ২৩২ খ্রিঃ পূঃ) আমলেই বৌদ্ধধর্মের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধি ঘটে এবং ক্রমে তা আন্তর্জাতিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সমগ্র মানবজাতির এক তৃতীয়াংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিঃ ১০০ শতাব্দ পর্যন্ত কালসীমায় যে সমস্ত বহিরাগত জাতি ভারতবর্ষে অভিযান চালিয়েছিল, তারা ভারতবর্ষের প্রচলিত ধর্ম বিশেষ করে বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিল। যার প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিপুলভাবে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দ থেকে খ্রিঃ তিন শতাব্দ পর্যন্ত বহুধর্মের জাগরণ যে ঘটেছিল, কমপক্ষে পনেরোশত উদ্ধারপ্রাপ্ত শিলালিপি থেকে তা প্রমাণিত হয়। 

খ্রিঃ ৩০০-১২০০ শতাব্দ কালসীমাকে পৌরাণিক যুগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অধঃপতন ঘটে ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্থান হয় ও শৈবধর্ম শাক্তধর্ম বৈষ্ণবধর্ম ও অন্যান্য উপধর্মগুলির উন্নতি হয়। সর্বোপরি এই সময়ের মধ্যেই নব্যধর্মের উত্থান ঘটে, যার প্রভাব ও প্রসার সারা ভারতবর্ষের জনজীবনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বৌদ্ধধর্মের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হল তৎকালীন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং বহিরাগত ইসলাম ধর্মের উত্থান। বারবার মুসলিম আক্রমণের ফলে বৌদ্ধ মন্দির সহ অন্যান্য ধর্মস্থানগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অন্য আর একটি প্রধান কারণ, এই ধর্মে তান্ত্রিক আচরণের অনুপ্রবেশ ও বৃদ্ধি। এই অনুপ্রবেশের ফলে যৌনতার প্রবেশ ঘটে ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে। জৈনধর্মের পতনের কারণ হিন্দুত্বের জাগরণ ও নানা শাখায় ধর্মের অনুশীলনের সাধারণ মানুষের সহজ অংশ গ্রহণ। জৈনধর্মের অনুশাসনগুলি মেনে চলার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নানাভাবে স্খলিত হবার ভয়ে পিছিয়ে থাকার ফলে এই ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। তাছাড়া রাজাদের আনুকূল্য লাভেও ভাটা পড়ে। অপরদিকে পরম ব্রহ্মের উপাসনা সংক্রান্ত বৈদিক ধর্মের অনুশীলনের ভিতর দিয়ে হিন্দুদের ত্রিমূর্তি- ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের অভ্যুত্থান ও পরবর্তীকালে ব্রহ্মের বহুরূপ ধারণ, পৌরাণিক যুগের ধর্মীয় মানসকে পুষ্টি দান করেছিল। তিন থেকে তেত্রিশ ধীরে ধীরে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর আবির্ভাব ভারতীয় জনমানসে ধর্মের এক বিচিত্র প্রকাশ ঘটিয়েছিল যার কালোত্তীর্ণ প্রভাব আজও বর্তমান। 

এইসব ধর্মের দেব-দেবীদের উত্থানের পিছনে অতি সাধারন মানুষদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু পুরাণ উপপুরাণ এই সময়ে রচিত হয়েছিল এবং ধর্মীয় গীতিকাব্য লোক-কথারও সৃষ্টি হয়েছিল। দেবদেবীগণ একে অপরের অংশ বিবেচিত হলেও স্বতন্ত্র-ভাবে পূজিত হতে থাকলেন। ইতিমধ্যে ইসলাম পার্সি খ্রিস্ট ইহুদি ধর্মের সঙ্গে সংশ্লেষ ঘটার ফলে ভারতবর্ষের মানুষের ধর্মজীবনে ও সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে তার প্রভাব পড়ল। খ্রিঃ ১২০০ থেকে খ্রিঃ ১৭৫৭ পর্যন্ত কালসীমার ইসলাম ধর্মের উত্থান ও প্রসার ভারতবর্ষের জনজীবনকে একদিকে বিধ্বস্ত, অপরদিকে পরিশীলিত করল। ধর্মান্তর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়ে বহু হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। কখনও বা তারা স্বেচ্ছায় এই ধর্ম গ্রহণ করল। অপরদিকে খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপক প্রচারের ফলে ও ধর্মান্তরকরণের কাজ চলতে থাকল। 

হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বহু মানুষ ধর্মান্তরের কারণে নিজেদের ব্যক্তিপ্রাধান্য ও আত্মসম্পদ খুঁজে পাওয়ার প্রেরণা পেল। কারণ হিন্দুধর্মে বহু নিষ্ক্রমণের পথ ছিল, কিন্তু প্রবেশদ্বার একাধিক ছিল না, যা ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মে ছিল। মধ্যযুগের জাতপাতের প্রাধান্য ধর্মান্তরের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। এই ধর্মান্তর যাতে স্থায়িত্বলাভ না করে, তার জন্য ভক্তিবাদের বিশেষ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় এবং ধর্মীয় সংস্কার দ্বারা সাধারণের মধ্যে দিয়ে জন জীবনে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুস্থিতি আনার জন্যে সর্বস্তরে বহু জননায়ক, ধর্মীয় নেতা ও মহাপুরুষ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এগিয়ে আসেন। এই সংস্কারপন্থী বিশিষ্টজনেরা হলেন রবিদাস তুলসীদাস রামানন্দ সুরদাস ধর্মদাস মালুকদাস সুন্দরদাস রাজ্জব জ্ঞানদাস ধরণীদাস চরণদাস কবীর দাদু নামদেব তুকারাম নানক শ্রীচৈতন্য শংকরদেব প্রমূখ। পরবর্তীকালে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয় ও সামাজিক স্তরের ভারতীয়দের মধ্যে নানা ধর্মপন্থার উদ্ভব ঘটে। 

লোকজীবনে সেই সব ধর্মের প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে পড়েছিল। এই ধর্মপন্থাগুলি হল যোগীপন্থা, গোপীচন্দ্রের সঙ্গীত, নাথপন্থা, নিরঞ্জনপন্থা, স্বামী নারায়ণী মহিমাপন্থা, কুম্ভীপতিয়া পন্থা, সৎনামি অলখনামী লালদাসী প্রভৃতি। এইসব ধর্মাচরণের জাতপাতের ভেদ ছিল না, হিন্দু মুসলমান সহ সমাজের নানাস্তরের ভক্তগণ এইসব ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে ভারতধর্মের বিকাশকে এগিয়ে দিয়েছিলেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments