জীবনের গভীরে বিজ্ঞান -২
বিজ্ঞানের আলোয় আধ্যাত্মবাদ: Ecotheology
নিশান চ্যাটার্জী
বিজ্ঞান কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেই জড়িত এমন কিন্তু নয়। এর ব্যাপ্তি আরও গভীর। এক মহীরুহকে আমরা বাইরে থেকে দেখে তার শাখাপ্রশাখার বিস্তার দিয়ে অনুভব করি। কিন্তু অনেকেই তার মূলের বিস্তৃতি অনুধাবনের চেষ্টা করিনা। কারণ তার অবস্থান মাটির গভীরে যা চর্মচক্ষুর দৃশ্যমানতার বাইরে। কিন্তু কখনও কখনও একটি মহীরুহের মূলভাগের বিস্তার আমরা অনুধাবন করতে পারি দূরবর্তী কোনো স্থানে খননের সময়, যখন দেখি সেই মহীরুহের মূলদেশের কোনো অংশের বিস্তৃতি প্রায় কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত।
একই ভাবে বিজ্ঞানের মূলদেশের বিস্তৃতিও ব্যক্তি জীবনকে ছাড়িয়ে সমাজ জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন, কূটনৈতিক জীবন এমনকি ধর্মীয় জীবনের মধ্যেও প্রবেশ করেছে বহুকাল ধরে। ধর্মীয় আলোচনার মাঝে আমরা বিজ্ঞান কে অনেক সময় তুচ্ছ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করি। যদিও উল্টোটির উদাহরণও যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু মানুষের ধর্মীয় জীবনের অনেক উপাচারই বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত একথা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারিনা।
বর্তমানে আধ্যাত্মিকতাবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের একটি অন্যতম দিক হলো-"Ecotheology"এই শাখাটির মূল উদ্দেশ্য হল পরিবেশের সঙ্গে ধর্মীয় উপাচারের যোগসূত্রের প্রতিষ্ঠার অন্বেষণ করা, অর্থাৎ আমরা যাকে শুধুই ধর্ম বলে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি, তার মধ্যেও বিজ্ঞান বিরাজমান।১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ এই সময়কালের মধ্যেই সৈয়দ হোসেন নাসার, লিন হোয়াইট তাদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন "Ecotheology"-র কথা। যার মূল বক্তব্য হল- আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মীয় আচার, হতে হবে পরিবেশবান্ধব। যার মাধ্যমে পরিবেশের সুস্থিতি বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের এই শাখাটির মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে- "পৃথিবী একা মানুষের জন্য নয়, এই পৃথিবীটা হোক সকলের"। প্রাচীনকালে আমাদের বহু ধর্মীয় উপাচার ছিল পরিবেশের পক্ষে সুখকর। যেমন বৈশাখ মাসে তুলসী গাছে মাটির ঘট বেঁধে জল দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ছিল গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহ থেকে গাছটিকে রক্ষা করা। কারণ তুলসীর ভেষজ গুণ প্রশ্নাতীত।
সুতরাং এই ধর্মীয় উপাচার কিন্তু বিজ্ঞান ভিত্তিক জীব সংরক্ষনের বার্তাই দিত। কিন্তু যদি ধর্মের নামে আমরা পরিবেশের ক্ষতিতে মদত দিই, তাহলে তার ফলাফল কিন্তু আমাদের পক্ষেই ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে। যেমন উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি বাঘ হরিণ খায় এই অজুহাতে আমরা যদি কোন অরন্যের সব বাঘেদের মেরে ফেলি তাহলে তার সবথেকে বড়ো প্রভাব কিন্তু হরিণের ও পরবর্তী সময়ে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের ওপর পড়বে। "Ecotheology" বা "পরিবেশ ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার" মূল বক্তব্যই কিন্তু এইটা।
বিজ্ঞানী লিন হোয়াইট "Historical Root Of Our Ecological Crisis" শীর্ষক গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রাচীন গ্রিসের বেশীর ভাগ বাড়ির ছাদটি গম্বুজাকৃতির বানানো হতো। আসলে এটিই ছিল তখনকার সৌন্দর্য। এই গম্বুজাকৃতি উপরিভাগ কে ধরে রাখত একটি পাথরের স্তম্ভ যাকে ওখানকার ভাষায় বলা হতো "Key stone ("কি-স্টোন")। আমাদের পরিবেশেও এরকম একাধিক "Key stone" প্রজাতি রয়েছে, যারা একটি বাস্তুতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিবেশে বিরাজ করে। ঠিক পরিবারের অভিভাবকের মতো। কোনো ভাবে সেই সকল প্রজাতি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সমগ্র পরিবেশের ওপরেই তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে বাধ্য। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ্য করেছি ধর্মীয় অন্ধ উপাচার এই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। "Ecotheology" বলে, ধর্মীয় উপাচার হোক এমন, যা এই সকল জীবজগত তথা পরিবেশের বেঁচে থাকার উপাদান হিসেবে কাজ করবে। আদিম মানুষেরা প্রকৃতিকে দেবতা জ্ঞানে পূজো করতো। কারণ তারা বিশ্বাস করতো প্রকৃতি বা পরিবেশ তুষ্ট থাকলে সমগ্র জীবজগত টিকে থাকবে। কিন্তু আমরা আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করতে পারিনা।
১৯৯০ এর সময় জেমস ফক্স, যিনি একজন খৃষ্টান ধর্মগুরু "Ecotheology" চর্চার মধ্যে দিয়ে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত প্রচলিত ধর্মীয় রীতি, যেগুলো পরিবেশের সুস্থিতি বজায় রাখতে ও বাস্তুতন্ত্রের সাম্যাবস্থা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, সেগুলিকে পুনরায় উজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এই কাজের নাম তিনি দিয়েছেন "Creation spirituality"। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো "Green theology" অর্থাৎ বৃক্ষকে ঈশ্বর মনে করে বৃক্ষরোপণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ধর্মভীরু মানুষদের দিয়ে সহজেই করিয়ে নিচ্ছেন। যার ফলে উপকৃত হচ্ছে কিন্তু বিজ্ঞান এবং সর্বোপরি পরিবেশ। এক্ষেত্রে তিনি পুরোনো ধর্মীয় মতবাদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সেতু বন্ধন ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন। আমরা যারা বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বাসী তারা যদি এই কাজকে নিছক ধর্মীয় উপাচার মনে করে দূরে ঠেলে দিই তাহলে তা বিজ্ঞানেরই অবহেলার সামিল হবে, আর এখানেই "Ecotheology" নামক বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। একথা ভুলে গেলে চলবে না প্রকৃতিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ও জল ছিল বলেই কিন্তু একসময় প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই আজও বিজ্ঞানীরা যখন কোনো ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান করেন, তখন সর্বপ্রথম সেখানে জলের উপস্থিতি আছে কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমিত মাত্রায় উপস্থিতি সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখার সহায়ক, যা ছিল প্রাণ সৃষ্টির চাবিকাঠি। এই "Ecotheology" আমাদের যেমন ধর্মের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক সুনির্দিষ্ট করে তেমনি আরো এক শিক্ষা দেয় যা হলো সকলে একসাথে মিলে থাকার শিক্ষা। এই জীবজগতের মূল ভিত্তিই হলো সকল প্রকার জীবের সহাবস্থান। এই সহাবস্থানই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার মূল মন্ত্র। জলের গভীরে যে জেলিফিশ থাকে তারাও তাদের নরম আবরণে করে শৈবালদের সূর্যের আলোর সংস্পর্শে নিয়ে আসে। কারণ জলভাগের গভীরে সকল স্থানে সমান ভাবে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। জেলিফিশের কিন্তু সূর্যের আলোর কোনো প্রয়োজন নেই কিন্তু তাদের এই কর্মব্যস্ততা, শুধু শৈবাল যাতে সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে তাদের খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা যাকে আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি "symbiosis"বা "মিথোজীবিতা"। এটাই তো আমাদের প্রকৃতির মূল শিক্ষা।
তাই এই শিক্ষার এক ধারক ও বাহক রুপে "Ecotheology" নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। না হলে অচিরেই মানবজীবন পৃথিবী থেকে অবলুপ্তির কোলে ঢোলে পড়বে, যেমন করে জুরাসিক যুগের অবসান ঘটেছিল। ই.ও.উইলসন তার "বায়োডাইভার্সিটি" নামক বইতে তথ্য দিয়ে বুঝিয়েছেন- এখন পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির যা সংখ্যা তার থেকেও বেশি সংখ্যক প্রজাতি বিভিন্ন সময়ে অবলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এর প্রধান কারণ কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব। বলা হয় পৃথিবীতে মানুষই, সর্বাপেক্ষা উন্নত জীব তাই "Ecotheology" যে সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়, তার ধারক ও বাহক মানুষকেই হতে হবে এবং তার জন্য পরিবেশ বিজ্ঞান সচেতনতাকে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহ সমস্ত ক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে।
একথা মনে রাখা প্রয়োজন, পরিবেশে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি দাবী করার অধিকার আমাদের নেই। যদিও আমরা তাই করে চলেছি। তাই এখন সময় এসেছে পরিবেশকেও কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার। একজন শিল্পী যেমন তিলে তিলে তার শিল্পকর্মকে গড়ে তোলে যা কিছু ভালো তাই দিয়ে, আমাদেরও কর্তব্য পরিবেশকে যা যা ভালো তাই দিয়ে সুন্দর করে গড়ে তোলা। তবেই না বিজ্ঞান জীবনের গভীরে প্রবেশের স্বার্থকতা প্রকাশ পাবে।
0 Comments