জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়/ পর্ব -৮/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব -৮                               

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

১৯০৪-০৫ সালের কথা। সেই সময় কলকাতার মত বোম্বেও বহু শিল্পী, গায়ক ও থিয়েটারের অভিনেতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সংস্কৃতিমনস্ক মারাঠীরা এইসব ব্যক্তিত্বদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই সময়ে গওহর বোম্বে এসে দেখা পেলেন হিন্দি ও গুজরাটি মঞ্চের বলিষ্ঠ অভিনেতা, সুদর্শন নায়ক অমৃত কেশব নায়েকের। যদিও অমৃত গওহরের থেকে চার বছরের ছোট ছিলেন তবুও এক অনুষ্ঠানে তারা প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। অবশ্য এর আগেও অমৃতের সাথে গওহরের সাক্ষাৎ হয়েছিল লক্ষ্মৌয়ে যখন বৃন্দাদিন মহারাজের কাছে গওহর গান ও নাচের তালিম নিতেন। সেইসময় দশ বৎসরের অমৃত বৃন্দাদিন মহারাজের কাছে কত্থক নাচ শিখতে গিয়েছিলেন। পরিবারের মতে অমৃত যদিও বিবাহ করেছিলেন পার্বতী নামের একটি মেয়েকে কিন্তু শিক্ষা, মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় সে অমৃতকে কোনভাবে সঙ্গ দিতে পারেনি যার ফলে সংসার জীবনে মনের শান্তি না পেয়ে অমৃতা আরো বেশি লেখালেখি, থিয়েটারের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি এমন একজন মহিলাকে খুঁজছিলেন যার সাথে তিনি সাংস্কৃতিক জগতের চিন্তা ধারা ভাগ করতে পারবেন। অমৃত ও গওহর যেন অনেক দিনের হারানো বন্ধুর মতো একে অপরের দেখা পেলেন। একই গুরুর শিষ্য হওয়ার জন্য দুজনে যেন দুজনকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। গওহরও এমন একজন মনের মানুষ খুঁজছিলেন যে তার যোগ্য সঙ্গী হবে এবং অমৃতের মধ্যে তিনি সেই মানুষের সন্ধান পেয়েছিলেন। দুজনের দুটি মন এক বিন্দুতে মিলিত হতে প্রেমের রোমাঞ্চকর দিনগুলি যেন আবার ফিরে এলো গওহর ও অমৃতের জীবনে। অমৃত নিজে ভালো গায়ক ও অভিনেতা ছিলেন এবং অবসর সময়ে গীত রচনা করতেন। অমৃত গান লেখার পরে দুজনে মিলে সেই গানের সুর সংযোজন করতেন। গওহর নিজস্ব আঙ্গিকে সেই সুরের উপরে কারুকার্য করে গানগুলি গাইতেন। এই সময়ে গওহর বোম্বেতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং অমৃতের একটি বাড়িতে থাকতেন। অমৃতের লেখা বিভিন্ন গানের মধ্যে গওহরের সর্বাপেক্ষা পছন্দের ছিল এই গানটি।                  
"আন বিনা জিয়া যেঁ লাগি              
পেয়ারি চিত কৌন দিয়া, আন বসি ক্যায়সে ফাসি                                    পদন লাগি ছাব কে পইয়াঁ, মেহেরবান সইয়াঁ                          
তুম বিন মোহে কল না পড়ে, তুমহারে কারন জাগি                     
আন বান হিয়া মেঁ লাগি।"    

  অর্থাৎ প্রেমের শর যখন আমার হৃদয়ে এসে বিঁধল বুঝলাম যে আমি নিরুপায়, আমি তোমার ক্রীতদাস হতেও প্রস্তুত, হে প্রিয়, তোমার পদতলে বসে তোমার করুনার প্রার্থী, চতুর্দিকে তোমায় না দেখে আমার প্রাণ অস্থির হয়ে ওঠে এবং আমি তোমার জন্য কত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি।       
               
  চটুল দাদরা তালের এই গানটি গওহরের মিষ্টি সুরেলা গলায় এত সুন্দর সুরে আন্দোলিত হতো যে অমৃত ঘন্টার পর ঘন্টা সেই গানটি শুনতেন। ছোট থেকে গওহরের শখ ছিল ঘোড়ায় চড়া। সেই শখ মিটিয়েছিলেন নিমাই সেন। বোম্বে এসে গওহরের সেইসব আবার একবার মিটলো। বোম্বের মহালক্ষ্মী রেসকোর্সের মাঠে অমৃত ও গওহর প্রায়ই যেতেন। অমৃতের মত গওহরের বেপরোয়া মনোভাব এবং নিজেকে প্রশ্রয় দেওয়ার স্বভাবের কারণে এই রেসকোর্স মাঠ দুজনের সাপ্তাহিক গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এত সুখ গওহরের জীবনে সইল না। কলকাতা থেকে আসা অপ্রত্যাশিত এক টেলিগ্রাম গওহরের জীবনকে নাড়া দিল। 

   গওহরের অদর্শনে তার মা মলকাজান অবসাদে ভুগে মদ্যপানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একদিন কলকাতার মতিঝিলের এক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় মলকাজান হঠাৎ করে রক্ত বমি শুরু করেন। ডাক্তার দেখাতে ধরা পরলো 'সিরোসিস অফ লিভার' হয়েছে। টেলিগ্রাম পেয়ে গওহর অমৃতের অনুমতি নিয়ে কলকাতা ফিরে এলেন। গওহরকে ফিরে আসতে দেখে মলকাজান মনের দিক দিয়ে শান্তি পেলেন কিন্তু ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও লুকিয়ে মদ্যপান বজায় রাখার ফলে ১৯০৬ সালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে এক সময়ের কলকাতায় আলোড়ন তোলা বঢ়ি মলকাজান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মায়ের মৃত্যুতে গওহরএকাকী হয়ে গেলেন। বিশাল পৃথিবীতে মা ছাড়া তিনি তার জীবন কল্পনাও করতে পারছিলেন না। মানসিক দিক দিয়ে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। তার মনের অবস্থা উপলব্ধি করে অমৃত গওহরকে কলকাতার সম্পত্তির অপ্রয়োজনীয় অংশ বিক্রি করে বম্বে চলে আসার জন্য বললেন। অমৃতের কথামতো তিনি কলকাতার অপ্রয়োজনীয়' সম্পত্তি বিক্রি করে সেই অর্থ ও জিনিসপত্র নিয়ে বোম্বেতে অমৃতের কাছে চলে গেলেন। সেখানে যেয়ে দুজনে আনন্দ ছিলেন। বোম্বে যেয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে গওহর নিজেকে নিমগ্ন রাখলেন। সেই সময়ে বোম্বের টাউনহলে একটি অনুষ্ঠানে তিনি রাগ ভূপালীতে খেয়ালের মাদকতা ও সুরেলা কন্ঠস্বরে যে গানটি গেয়েছিলেন সেই গান গ্রামোফোন কোম্পানি 'লাইভ রেকর্ডিং' করেছিলেন এবং অনুষ্ঠানের শেষে দর্শকেরাও মুগ্ধ হয়ে সহর্ষ হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে স্টেজ থেকে নেমে সামনে উপস্থিত অমৃতের বাহুডোরে ধরা দিয়ে গওহর কেঁদে ফেলেছিলেন। অমৃতের সাহচর্য গওহরকে তার মায়ের প্রয়াণের গভীর অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল এবং মায়ের অভাব সে ভুলতে পেরেছিল। কিন্তু গওহরের জীবন তো বিধাতা অন্যভাবে লিখেছেন। সুখের সময়েই আসে একের পর এক আঘাত। গওহর যে সময় কলকাতায় ছিলেন তার অনুপস্থিতিতে অমৃত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়াও থিয়েটারের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা যাবত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। ১৯০৭ সালের ১৮ই জুলাই অমৃত নাটকের মহড়া চলাকালীন বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে 'কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট' হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। ডাক্তার ডাকার সময় ও সুযোগও হল না। অমৃতের মৃত্যুর খবর পেয়ে গওহর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লেন। এক বৎসরেরও কম সময়ে জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রিয়জনকে হারালেন। মানসিক দিক দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। জীবনের এই দুঃসময়ে কে তাকে প্রবোধ দিবে? সামনে পিছনে কেউ নেই। 

   তার এই দুঃসময়ে কলকাতায় তার কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী বোম্বে এসে গওহরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং তাতে সে শক্ত হাতে জীবনের হাল ধরতে পারে সেই ভাবে বুঝিয়ে তাকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গওহর বিদায় নিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনের সাথীর বাসস্থান থেকে। গওহরের জীবন কখনোই সোজা পথে অগ্রসর হয় নি। প্রতিটি বাঁকে যেন দুঃখ বিপর্যয় ওৎ পেতেছিল। তার চরিত্রের ঔজ্জ্বল্য, সহজগামিতা, এবং আত্মপ্রত্যয়ই হয়তো তাকে সব দুর্ঘটনা ভুলিয়ে দিয়ে, সব দুঃখকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে জীবনকে পুর্ণমাত্রায় উপভোগ করার শক্তি যোগাতো। শুভানুধ্যায়ীদের আশ্বাসে গওহর অবশেষে কলকাতায় ফিরে এলেন, যে কলকাতা তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রভূত সাহায্য করেছে। কিন্তু দুঃখের দিন যেন তার পিছু ছাড়ছিল না।    
 
    (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. এই প্রথম আপনার লেখা পড়লাম। অসাধারণ লাগলো। এবার থেকে প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই সব লেখা পড়ব। ভালো থাকুন।

    ReplyDelete